বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

সোনিয়া গান্ধী কি গ্রেপ্তার হবেন?
হিমাংশু সিংহ

পরতে পরতে নাটক দেখছে দেশের জনগণ। যার স্ক্রিপ্ট রচিত হয়েছে সাততারা দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গের ঝাঁ চকচকে অফিসের কনফারেন্স রুমে। তারই প্রতিফলন আজ দিল্লির রাজপথ থেকে রাজ্যে রাজ্যে অলিগলি তস্য গলিতে। মঞ্চস্থ নাটকের নাম ‘বিরোধী ধরো জেল ভরো’। আর টাকা ছড়িয়ে বিধায়ক কিনে সরকার ভেঙে দাও। ইন্দিরা ৩৫৬ ধারা দিয়ে রাজ্যে রাজ্যে সরকার বদলে দিতেন, তাঁর সমালোচনা বড় কম হয়নি। সংসদ থেকে সড়ক, সেই পরিসংখ্যান আজও জনসমক্ষে উপুড় করে দেন অমিত শাহরা। অথচ বাস্তব দেখাচ্ছে যাঁরা বলছেন, তাঁরাও সেই একই দোষে দোষী। শুধু পথটা আলাদা। অস্ত্রটা ভিন্ন। গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী বর্তমান শাসক ওপথে না গিয়ে দলটাকে বেমালুম আড়াআড়ি ভেঙে দিচ্ছেন। পার্থক্য বলতে শুধু ওইটুকুই। গোয়া, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্রে বিজেপির বিধায়ক কিনে সরকার কায়েমকে মোটেই নৈতিকতার কষ্টিপাথরে পাশ নম্বর দেওয়া যায় না। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের ঢক্কানিনাদের অভিযাত্রায় একে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা কঠিন। নেহরু গান্ধী পরিবারের সঙ্গে আদায় কাঁচকলা সম্পর্ক হলেও একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মৌতাতে এখানেই দু’তরফের আশ্চর্য মিল! মহারাষ্ট্রে ক্ষমতা দখল, সঞ্জয় রাউতের গ্রেপ্তার থেকে দিল্লিতে সোনিয়া-রাহুলকে বারবার জেরা, ইয়ং ইন্ডিয়ানের অফিস সিল করা, ঝাড়খণ্ডের তিন কংগ্রেস বিধায়কের গাড়ি থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা নগদ উদ্ধার, পরপর সেই চিত্রনাট্যেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সবগুলোকে এক ক্যানভাসে মেলালে শাসকের ক্ষমতার উন্মত্ত দানবীয় আস্ফালন স্পষ্ট। বাংলাকে না হয় এ যাত্রায় বাদই দিলাম। সে তো গত এক দশক ধরে নিত্য লেগে আছে। দুর্নীতি কেউ সমর্থন করে না, কিন্তু ইডি, সিবিআইয়ের অতি তৎপরতা দেখে মাঝে মাঝে মনে হয়, বঙ্গ বিজেপিকে দিয়ে কিচ্ছুটি হবে না বুঝেই সেই ভূমিকায় অভিনয় করতে পাঠানো হয়েছে গোয়েন্দা কর্তাদের। ওরা যেন এই বঙ্গে আগমার্কা গেরুয়া। অন্তত কাজে তো বটেই। এজেন্সি দিয়ে এ রাজ্যের নেতানেত্রীদের একটু সমঝে দেওয়ার কু-নাট্য। কান টানলে মাথা আসবে, এই থিয়োরি একুশের ভোটে ব্যর্থ হলেও চেষ্টার ত্রুটি নেই। চলছে তো চলছেই। কড়া নাড়ছে চব্বিশ। ভোট এলেই স্রোত জাগে, তারপর আবার সব নিস্তরঙ্গ, শান্ত নদীটি।
দেশজুড়ে এই মুহূর্তে সরকারের অগ্রাধিকার কোনটা? মূল্যবৃদ্ধি সামাল দিয়ে গরিবের খিদে মেটানো, চাকরি দেওয়া, উন্নয়নের ঘোড়া ছোটানো, নাকি বেছে বেছে বিরোধী নেতাদের জব্দ করা আর চব্বিশে বিরোধীশূন্য রাষ্ট্রে ফের ক্ষমতা দখল করে ‘মোগাম্বো খুশ হুয়া’র পথ প্রশস্ত করা? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গোল বাঁধারই কথা। তাই এদেশে পেট্রল, ডিজেল, কেরোসিন, রান্নার গ্যাস, সবের দাম লাফিয়ে বাড়লেও কারও কোনও হেলদোল নেই। মানুষের অসহায়তার সুযোগে এ সম্প্রদায়কে ও সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দাও, হাঙ্গামা বাধাও, বিভাজনের তাস খেলো আর গোটা কয়েক চোখ ধাঁধানো ধর্মস্থান গড়তে পারলেই সাতখুন মাফ। উল্টে দ্বিগুণ ভোট ঘরে আসবে। তৃতীয়বারও দিল্লি দখল কে আটকায়! কে দেখতে যাচ্ছে অর্থনীতি কতটা সফল, গরিবের থালায় ভাত আছে না নেই, আর পাশ করেও কাজ না পেয়ে যুব সমাজের নিষ্পলক হতাশ দৃষ্টির অব্যক্ত যন্ত্রণা।
আট বছর আগে ক্ষমতা দখল করেই কংগ্রেস মুক্ত ভারতের ডাক দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। রাজকীয় রাম মন্দির নির্মাণ যেমন এখন শেষ পর্যায়ে, তেমনি কংগ্রেসকে বহরে ও তাৎপর্যে ক্রমে শূন্যের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার অন্তহীন প্রচেষ্টাও ক্লাইম্যাক্সে। ন্যাশনাল হেরাল্ড সম্পত্তি হস্তান্তর মামলায় গুরুতর অভিযোগের সামনে নেহরু-গান্ধী পরিবার। দশ জনপথের বাইরে প্রচুর পুলিস, নিরাপত্তা বাহিনী। লাখ টাকার একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে, গ্রেপ্তার কখন, কবে? মামলাটা করেছিলেন সুব্রহ্মণ্যম স্বামী। মোদি ক্ষমতায় আসার আগে ২০১২ সালে। অভিযোগ ছিল, এর মাধ্যমে ঘুরিয়ে দলেরই কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন সোনিয়া গান্ধী ও তাঁর পরিবার। ন্যাশনাল হেরাল্ড কাগজের পরিচালন ভার ছিল নেহরুর হাতে গড়া অ্যাসোসিয়েটেড জার্নাল লিমিটেড (এজেএল) নামে একটি সংস্থার উপর। সেটির উৎপত্তি স্বাধীনতারও আগে, ১৯৩৭ সালে। প্রতিষ্ঠাতা জওহরলাল নেহরু। অফিস ৫-এ, বাহাদুর শাহ জাফর মার্গ। কাগজটিকে বাঁচাতে সংস্থাটি কংগ্রেস দলের কাছ থেকে বিনা সুদে প্রায় ৯০ কোটি টাকা ঋণ নেয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা ফেরত দেওয়া হয়নি। উল্টে কাগজের আধুনিকীকরণে এক পয়সা খরচ হয়েছে বলেও প্রমাণ নেই। ২০১০ সালের পর কাগজটি আর প্রকাশিত হয় না। তাহলে ওই টাকা গেল কোথায়? অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালের প্রচুর জমি জায়গা সম্পত্তি ছিল। বিজেপি এমপি সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর অভিযোগ, ইয়ং ইন্ডিয়ান লিমিটেড নামে একটি নয়া সংস্থা খুলে সোনিয়া গান্ধী ও তাঁর পরিবার ওই সংস্থার প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছে। অনৈতিকভাবে হাতবদল হয়েছে বিপুল পরিমাণ সম্পদ। বিতর্কটা এইখানেই। কিন্তু দশ বছর আগের মামলাকে হঠাৎ এভাবে চব্বিশ সালের সাধারণ নির্বাচনের দু’বছর আগে জাগিয়ে তোলায় যাবতীয় সন্দেহ ও প্রশ্ন উঠছে। সোনিয়ার গায়ে হাত দিয়ে কংগ্রেসকে অভিভাবক শূন্য করে দেওয়ার ঝুঁকি কি শেষ পর্যন্ত নেবেন নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল? উত্তরটা সময়ই বলবে। তবে রাজনীতিতে স্বাভাবিক মৃত্যুর তুলনায় কাউকে গুরুত্ব দিয়ে শহিদ বানালে নিউটনের তৃতীয় সূত্র মেনে পাল্টা প্রতিক্রিয়া ও অভিঘাতের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। ইতিহাস বারে বারে সেই শিক্ষা দিয়েছে। কৌশলী সঙ্ঘ পরিবার ও নরেন্দ্র মোদি চূড়ান্ত কিছু করার আগে নিশ্চয়ই সেই হিসেব কষছেন।
সেই সুবাদে ভারতীয় রাজনীতির এই সন্ধিক্ষণে লাখ টাকার প্রশ্ন একটাই, চব্বিশের লড়াই ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছনোর আগে কি সোনিয়া, রাহুল গ্রেপ্তার হবেন? মোটামুটি সামান্য কয়েকটি রাজ্য বাদে কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক লুট হয়ে গিয়েছে। ভল্টে যেটুকু রাখা আছে তাও কমছে। কয়েক বছর আগেও পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে যেটুকু সামান্য জনসমর্থন ছিল, সেটা আরও ক্ষয়ে যাওয়ার নিশ্চিত আশঙ্কা। মহারাষ্ট্রের পর ঝাড়খণ্ড ও রাজস্থানে ঘুরপথে সরকার দখলের ছক পাকা। ছত্তিশগড়েও ডামাডোল তুঙ্গে। কংগ্রেসকে অণু-পরমাণুতে ভেঙে ছোট ছোট আঞ্চলিক দলের মধ্যে সেই ভোটব্যাঙ্কের বিতরণ ও বণ্টন সঙ্ঘ পরিবারের ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’য়ের অঙ্গ। সার্থকভাবেই তা চলছে। 
এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সামান্য খোঁজ যাঁরা রাখেন, তাঁরা জানেন ১৯৭৭ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতা উত্তর সময়ের প্রথম বড় ধাক্কাটা খেয়েছিল কংগ্রেস। ইন্দিরা গান্ধী গোহারা হন। প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেছিলেন মোরারজি দেশাই। দেশের প্রথম অকংগ্রেসি সরকার। দেশজুড়ে চরম ইন্দিরা ও কংগ্রেস বিরোধী হাওয়া। সেই হাওয়াতেই পালাবদলের মাত্র সাত মাসের মধ্যে গ্রেপ্তার হন নেহরু কন্যা। হইচই পড়ে যায়। ৩ অক্টোবর, ১৯৭৭। অন্য আরও পাঁচটা কারণের সঙ্গে ওই একটা গ্রেপ্তারই নিমেষে হাওয়া ঘুরিয়ে দিয়েছিল ভারতীয় রাজনীতির। পায়ের তলার মাটি একটু একটু করে ফিরে পায় দেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দলটি। এরপর মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচনে সাড়ে তিনশো আসন নিয়ে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন হয় কংগ্রেসের। মুছে যায় কিছু কংগ্রেস ছেড়ে আসা, কিছু সোশ্যালিস্ট দল আর জনসঙ্ঘের মিলিত ফ্রন্ট। জরুরি অবস্থার পটভূমিতে যার রূপকার ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ। তাই রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা পূরণের জন্য এবারও হঠাৎ অসুস্থ সোনিয়া-রাহুলকে গ্রেপ্তার করলে হিতে বিপরীত হবে না তো? ঘুমন্ত কংগ্রেসকে শহিদ করে শেষে নরেন্দ্র মোদিকে হাত কামড়াতে হবে না তো! রাজনীতিতে কিন্তু শেষ কথা বলে কিছু হয় না!

7th     August,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ