বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

মাননীয় অর্থমন্ত্রী, মূল্যবৃদ্ধি কাকে বলে?
সমৃদ্ধ দত্ত

মূল্যবৃদ্ধিকে ঠিক কেমন দেখতে? জিডিপির মতো? পেট্রল ডিজেলের দামের মতো? ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের মতো? ডলার ও টাকার বিনিময় মূল্যের মতো? আমদানি রপ্তানি শুল্কের কঠিন অঙ্কের মতো? রেপো রেটের মতো? কেমন হয় মূল্যবৃদ্ধি? সরকার কী বলে আমাদের? তারা বলে, ভারতের মুদ্রাস্ফীতির হার আমেরিকার তুলনায় কম। বিশ্বের সর্বত্রই পেট্রল ডিজেলের দাম বাড়ছে। উন্নত দেশগুলির তুলনায় ভারতের জিডিপি বৃদ্ধিহার অনেক দ্রুত। যাকে বলা হয় ফাস্টেস্ট গ্রোয়িং ইকনমি। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অনেক ব্যবস্থা নিয়েছে। আমরাও নিচ্ছি। ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ মূল্যবৃদ্ধি মানেই হল উচ্চমার্গের অর্থনীতির বিশ্লেষণ। এখন যে কোনও বিবৃতি যখন তখন দেখা যায় ইউটিউবে।  ছ’মাস আগের রাষ্ট্রীয় বিবৃতি দেখতে চাইলে আমরা লক্ষ্য করব এগুলোই বলা হয়েছে। কখনও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কখনও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বলেছে, কখনও-বা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। কখনও স্ট্যাটিসটিক্যাল রিপোর্টের গ্রাফিক্স বলেছে। ছ’মাস পরও ঠিক অবিকল এগুলোই আবার শোনা যায়। এটাই নিয়ম। মোট তিনবার বছরে পার্লামেন্ট চলে। বাজেট অধিবেশন। বর্ষাকালীন অধিবেশন। শীতকালীন অধিবেশন। গড়ে একমাস করে। সেখানে কী হয়? বিরোধীপক্ষ মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরকারকে আক্রমণ করে এবং আলোচনা চায়। প্রথমে সরকার রাজি হয় না। কয়েকদিন সেটা নিয়ে হই-হট্টগোল হয় সংসদের অন্দরে ও বাইরে। চলে স্নায়ু এবং বিবৃতির লড়াই। তারপর সরকার দিন স্থির করে যে, ওইদিন হবে লোকসভায় মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা, পরদিন হবে রাজ্যসভায় আলোচনা। সেই আলোচনায় সমস্ত দলের এমপিরা মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে নিজেদের কথা বলেন। সরকারের অর্থমন্ত্রী দিনভর সেই প্রত্যেক এমপির যুক্তি, আক্রমণ, শ্লেষ, শের শায়েরি—এসব শোনেন। তারপর সরকার আত্মপক্ষ সমর্থনে জবাব দেয়। এই যে অর্থমন্ত্রী জবাব দিলেন, সেখানে উদ্বেগের চিহ্ন অথবা প্রতিজ্ঞার প্রতিশ্রুতি কম পাওয়া যায়। অনেক বেশি থাকে স্ট্যাটিসটিকস! 
এসব থেকে অনেক দূরে মূল্যবৃদ্ধি বসে বসে হাসে মিড ডে মিলের মেনুতে। উত্তরপ্রদেশের প্রান্তিক জেলা লখিমপুর খেড়ির ঈশানগর ব্লকের চিলকানপুরওয়া সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক  বিডিও, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা প্রশাসনের কাছে একটি সরল প্রশ্ন জানতে চেয়েছেন। ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীর জন্য ঩মিড ডে মিলের বরাদ্দ পড়ুয়াপ্রতি ৪ টাকা ৯৭ পয়সা। আর ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীপ্রতি মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ ৭ টাকা ৪৫ পয়সা। প্রধান শিক্ষক সন্তোষ মৌর্যের প্রশ্ন, এই টাকার মধ্যে আলাদাভাবে আবার বুধবার বুধবার দুধ দিতে হবে। দেড়শো মিলিলিটার করে প্রতি পড়ুয়া। সপ্তাহে ৬ দিন মিড ডে মিল এবং বুধবার করে অতিরিক্ত দুধ। অথচ প্রতি পড়ুয়ার বরাদ্দ ওই ৪ টাকা ৯৭ পয়সা এবং ৭ টাকা ৪৫ পয়সা। এখন দ্রব্যমূল্য যা হয়েছে, এই টাকায় কি চালানো সম্ভব? 
লখিমপুর খেড়ি, সুলতানপুর অথবা বিহারের ভাগলপুর। ঠিকানা এবং স্কুলের নাম আলাদা আলাদা হলেও একটি সাদৃশ্য এবার এসেছে সকলের মধ্যে। দুধ, ফল, ডিম যা আগে দেওয়া হতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, সেটা মিড ডে মিলের থালা থেকে বহু রাজ্যে উধাও হয়ে গিয়েছে। এখন সবথেকে কমন মেনু হল খিচুড়ি। কারণ, ৪ টাকা ৯৭ পয়সায় এর থেকে আর বেশি কী-বা দেওয়া সম্ভব একটি ক্রমেই শারীরিকভাবে বেড়ে চলা ছেলে অথবা মেয়েকে? তার উপর আর এক সমস্যা। সময়মতো সরকার থেকে মিড ডে মিল ফান্ড এসে পৌঁছয় না। কোনও কোনও রাজ্যে তিন মাস ধরে বকেয়া পড়ে থাকে। শিক্ষক শিক্ষিকারা নিজেরা চাঁদা তুলে কোনওমতে চালানোর চেষ্টা করেন। ভারতের গরিব প্রান্তিক মানুষের ছেলেমেয়েদের মিড ডে মিলের পাশে এভাবে প্রতিদিন মূল্যবৃদ্ধি এসে কড়া পাহারা দিয়ে বসে থাকছে, যাতে বেশি পুষ্টি কিছুতেই তাদের থালায় পৌঁছতে না পারে। আর তখন কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্বেগে কী প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে? প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে বাজেটে। ২০২২-’২৩ বাজেটে প্রধানমন্ত্রী পোষণ প্রকল্পে সরকারি বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কত দেওয়া হয়েছে? ১০ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা। ২০২১-’২২ বছরের বাজেটে কত দেওয়া হয়েছিল? ১১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা! আজকাল শুধু একটি ডিমেরই দাম কত? ৬ টাকা। একজন পড়ুয়ার গোটা মিলের জন্য কত বরাদ্দ হচ্ছে? ৪ টাকা ৯৭ পয়সা! 
মূল্যবৃদ্ধি ফেরিঘাটে বসে রয়েছে ওড়িশার মালকানগিরিতে। এই জেলার প্রত্যন্ত অন্তত সাতটি এমন ব্লক আছে যেখানে অনেক গ্রামই আসলে দ্বীপ। চারদিকে জল। ২ ঘণ্টা বোটে করে যেতে হয় নিকটবর্তী গঞ্জে। যেখানে বাজার কিংবা ব্লক প্রাইমারি হেলথ সেন্টার আছে। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির জন্য ফেরির ভাড়া এক ধাক্কায় অনেক বেড়েছে। এই গ্রামগুলির বাসিন্দাদের পক্ষে নদীতে লঞ্চে চেপে যাতায়াত তাই বিলাসিতা হয়েছে এখন। আর একটি রুট আছে। টিলা আর জঙ্গল পেরিয়ে যাওয়া। হেঁটে। ক্রমেই এই রুটের যাত্রীসংখ্যা বাড়ছে। অর্থাৎ হাঁটাপথে যাতায়াত করা। তাই ফেরিঘাটে ভিড় কমছে। কমছে জীবনের সহজতা। বাড়ছে মূল্যবৃদ্ধি। 
মূল্যবৃদ্ধি প্রতিদিন নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে দেখছে দূরদূরান্ত থেকে আসা পেশেন্টপার্টিকে। কখনও গ্রাম, কখনও শহরের ওষুধের দোকান থেকে যারা বেরয়, তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে মূল্যবৃদ্ধি মজা পায়। ২০২২ সালের ৭ এপ্রিল ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি অফ ইন্ডিয়া ৮০০টি জরুরিকালীন ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এই প্রতিটি ওষুধ ন্যাশনাল লিস্ট অফ এসেনশিয়াল মেডিসিনের অন্তর্ভুক্ত। যেগুলি থেরাপিউটিক। যেগুলি অসুস্থতা থেকে দ্রুত উপশমের জন্য ব্যবহার করা হয়। সবথেকে চেনা ওষুধের নাম প্যারাসিটামল। অ্যাজিথ্রোমাইসিন থেকে সিপ্রোফ্লক্সোসিন, হাইড্রোক্লোরাইড থেকে ফেনোবারবিটোন ইত্যাদি ৮০০ রকমের ওষুধের দাম বেড়ে গিয়েছে। ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়েছে স্বাস্থ্যবিমার প্রিমিয়াম। বিহারের নরেশ যাদব এইমস থেকে ডাক্তার দেখিয়ে  কাটিহারে ফেরার পর একটি রোগনির্ণয় পরীক্ষা কিছুতেই করতে পারছেন না। আল্ট্রা সাউন্ড। যা ছিল আগে ৭০০ টাকা , সেটি এখন চাওয়া হচ্ছে ১৫০০ টাকা। আউটলুক পত্রিকার সাংবাদিককে নরেশ যাদব জানিয়েছে, এই অতিরিক্ত টাকাটা আর বাঁচাতেই পারছি না। তাই হচ্ছে না আল্ট্রা সাউন্ড পরীক্ষাও। 
রান্নাঘরের বাইরে স্থায়ী আসন পেতেছে মূল্যবৃদ্ধি। প্রমাণ কী? গাঁও কানেকশন নামক একটি সংস্থা গ্রামীণ ভারতের সামাজিক সমস্যা নিয়ে ঘুরে ঘুরে সমীক্ষা করে। তাদের রিপোর্টে হরিয়ানার বল্লভগড়, উত্তরপ্রদেশের সীতাপুর, ছত্তিশগড়ের সরগুজা জেলাগুলির বহু মানুষের সাক্ষাৎকারে বলা হয়েছে, এখন ওইসব পরিবার দিনে একবার সব্জি রান্না করে। ডাল বাদ হয়েছে। একবার তৈরি করা সব্জি। আর তাতে দুই বেলা রুটির সঙ্গে কখনও শাকভাজা, নুন অথবা আচার। যখন ১০০ দিনের কাজের গ্যারান্টির কাজ পাওয়া যায়, সেই সময় পেমেন্ট পাওয়া গেলে আবার কিছুদিন ডাল খাওয়া সম্ভব হয়। সর্ষের তেল নিয়ম করে কেনা যায়। তবে সবথেকে তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য হল, রান্নার গ্যা঩সের সংযোগ নিয়ে। ২০২১-’২২ সালে সাধারণ এবং উজ্জ্বলা গ্যাস যোজনার গ্রাহক মিলিয়ে দেশের ৪ কোটি ৪৯ লক্ষ মানুষ গোটা বছরে একবারও সিলিন্ডার পূর্ণ করার জন্য গ্যাস ক্রয় করেনি। আর তাদের তুলনায় সৌভাগ্যবান অংশ আছে। তারা গোটা বছরে একবারই মাত্র গ্যাসের সিলিন্ডার কিনেছে। সংখ্যাটি হল ২ কোটি ২৮ লক্ষ। কেন? ঝাঁসির বীণা দেবী সমীক্ষক সংস্থাকে বলেছেন, আমাদের এক সপ্তাহের বাজার হয়ে যায় একটি সিলিন্ডারের যা  দাম, সেই টাকায়। 
মূল্যবৃদ্ধি সরকারের কাছে যেন নিছক ইকনমিকসের ডেটা। কিন্তু দেশবাসীর কাছে? সংসার চালানোর ডেবিট ক্রেডিটের অন্তহীন টেনশন!

5th     August,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ