বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

এই দুর্দিনে সোনার
ছেলেমেয়েরাই প্রেরণা

হারাধন চৌধুরী

সঙ্গত কৌতূহল: টিআরপি পড়ে যাচ্ছে কি বাংলা সিরিয়ালের? সৌজন্যে সাম্প্রতিক সংবাদ। খবর একঘেয়ে হয়ে এসেছিল খবরের কাগজে, টিভির পর্দায়। সব নাকি থোড় বড়ি খাড়া! দর্শককে সেখান থেকে বের করে এনেছে কোন‌ সংবাদ? কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার খবর। 
সারদা, রোজভ্যালিতেও টাকা ছিল। কিন্তু চোখ খুলে সেসব দেখা যায়নি। সবটাই পুলিস বা কোনও সরকারি তদন্তকারী এজেন্সি সূত্রে পাওয়া রুক্ষ তথ্য। ‘চিত্র ও উদাহরণসহ যাহা জানো লিখো’ ব্যাপারটা তাতে নেই। নারদের স্টিং অপারেশনে টাকা হাত বদলের দৃশ্য নিশ্চয় নয়নগোচর হয়েছে পাবলিকের, কিন্তু সে আর ক’টা টাকা! এই কলকাতা, বছর আড়াই আগে, টাকার বৃষ্টিরও সাক্ষী থেকেছে। বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের এক বহুতল থেকে ৫০০ ও ২০০০ টাকার গুচ্ছ নোট উড়েছিল। কিছু লোক হুড়োহুড়ি ফেলে দিয়েছিল সেই বেওয়ারিশ টাকা কুড়নোর জন্য। সৌজন্যে আয়কর হানা। তবে সেই টাকার পরিমাণ আহামরি ছিল না। পাবলিকের আলোচনার টেবিল গরম হওয়ার আগেই ঠান্ডা মেরে গিয়েছিল ইস্যুটা। ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ বহু মানুষকে মুগ্ধ করেছে, ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে রূপকথার জগতে। সেই অনুষ্ঠান সাময়িক বিরতিতে গেলে দর্শক ফের পর্দা ওঠার অপেক্ষায় থাকে। কোনও কোনও গরিবের হাতে লটারির লাখ কিংবা কোটি টাকা ওঠার খবর পড়তে গিয়ে পাঠক এক মুহূর্তের জন্যে চিচিংফাঁকের দেশে হারিয়ে যায়। এসবের কী আর জোশ যে, ‘টাকা টাকা’ জপে দিনরাত এক করে ফেলার পরেও রোজ নুন আনতে পানতা ফুরনো লোকজনের মন ভরায়?
সেই খেদ, চোখের খিদে রাতারাতি মিটিয়ে দিল বাংলার রাজনীতি। ২২ জুলাই এক তরুণীর দক্ষিণ কলকাতার এক ডেরা থেকে উদ্ধার হল নগদ প্রায় ২২ কোটি টাকা। চার-পাঁচদিন বাদে তাঁরই উত্তর শহরতলির অন্য-এক ডেরা থেকে মিলল আরও ২৮ কোটি। রাশি রাশি নগদের সঙ্গে পাওয়া গেল বিপুল পরিমাণ সোনা ও বিদেশি মুদ্রা। কলকাতা কখনও একসঙ্গে এত টাকা দেখেনি। এই কারবার তদন্তকারী এজেন্সিকেও অবাক করেছে নিশ্চয়। টাকার পরিমাণ এতটাই বেশি যে অনেকগুলি মেশিন, লোকলস্কর এনে গুনতে হয়েছে। দু’জায়গায় কেটে গিয়েছে পুরো দুটো দিন। টাকাগুলি অনেক ট্রাঙ্কে ভরে, কন্টেনার গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে নির্দিষ্ট ব্যাঙ্কে। দ্বিতীয়বার টাকা উদ্ধারের পর মানুষের কৌতূহল ডানা মেলেছে। সুযোগ পেলেই নিউজ চ্যানেল খুলে ক্ষুধার্ত চোখ রাখছে টিভির পর্দায়, মোবাইল ফোনে সোশ্যাল মিডিয়ায়। খবরের কাগজ খুলেই খুঁজছে যকের ধন উদ্ধারের নতুন নতুন খবর। যাঁর বিলাসবহুল ফ্ল্যাট থেকে এসব পাওয়া গিয়েছে, তিনি যেমন তেমন কেউ নন—এই রাজ্যেরই সেদিনের এক হেভিওয়েট মন্ত্রী এবং শাসক দলের বিরাট নেতার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী! টাকার পাশাপাশি দিকে দিকে তাঁর একগুচ্ছ বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, বাগানবাড়ি, স্টুডিয়ো, কোম্পানি ইত্যাদির খবর ছড়িয়ে পড়েছে আগুনের মতো! 
শেষদিকে ব্যাপারটা গুজবেরই চেহারা নিচ্ছিল। তদন্তকারী এজেন্সির মুভমেন্টের খবর, এমনকী কিছু কানাঘুষো শুনেই বহু মানুষ জানতে মরিয়া হয়ে উঠেছে, আজকেও নতুন গুপ্ত ভাণ্ডারের সন্ধান কোথায় মিলল? সবকিছুরই শেষ থাকে। শেষের আন্দাজটাও সবসময় নিখুঁত হয় না। তবে, একটা বিরামচিহ্ন আমাদের সামনে খাড়া হয়। দ্বিতীয় ‘টাকার বাড়ির’ খবর পুরনো হয়ে এসেছিল দ্রুত। বাংলার রাজনীতিকেই বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছে যখন, ঠিক তখনই আসরে হাজির দুই পড়শি প্রদেশ: ঝাড়খণ্ড ও অসম। এই মানিকজোড়ই সামনে এনে দিল টাটকা টাকার খবর। ঝাড়খণ্ডের তিন বিধায়কের গাড়ি থেকে মিলল প্রচুর নগদ টাকা। এখানেও টাকার পাহাড় দর্শনের আশায় ছিল জনতা। কিন্তু দুর্ভাগ্য বঙ্গবাসীর, পাহাড়ের বদলে মিলল ছোট্ট একটা টিলা। কোটি কোটির সামনে লাখ পঞ্চাশ টিলা বইকি! তাই সই, টাকার নতুন গল্প তো! 
বেশিরভাগ বাংলা টিভি সিরিয়াল এমনিতেই একঘেয়ে। কাহিনি ও চিত্রনাট্যের দৈন্য পরতে পরতে। চমক দূর—অভাব বুদ্ধিমত্তা, এমনকী হাস্যরসেরও। রবার টেনে টেনে লম্বা করা কাহিনিতে হাসির নামে সুড়সুড়ির জবরদস্তি আর কী। তার থেকে বেশি চমক এখন নিউজ চ্যানেলগুলিতে। টাকা উড়ছে। আহা ডানা মেলা পাখি যেন! পাড়ায় পাড়ায় অঞ্চলে অঞ্চলে প্রতিযোগিতা। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইতে কে জেতে কে হারে দেখার জন্য মানুষ এখন গভীর রাত অব্দি টিভি খুলে বসে থাকে। বাড়ি কাজের মেয়ে, রাঁধুনিও আর ম্যাডামের কাছে সিরিয়াল দেখার বায়না করছে না। বরং নিউজ চ্যানেলে চ্যানেলে সফর করছে অনায়াসে। মোবাইলেও একই অবস্থা—ট্রেনে বাসে ফুটপাতে হাটে বাজারে। এমন রঙ্গ সত্যিই কেউ দেখেনি আগে। রূপকথা গল্পকথা যে সত্য ঘটনার সহোদর‌ ভাই—এ বস্তু হাল আমলের আবিষ্কার। এতে সিরিয়ালওয়ালারা রেগে গেলে, দুঃখ পেলে সত্যিই কিছু করার নেই নিরপেক্ষ দর্শকের।
কে বলে বাংলা গরিব, ভারত গরিব? নগদের জোগান কমে গিয়েছে? এখন নগদ জোগানের কম্পিটিশনে‌ নেমেছে কতিপয় রাজনীতির কারবারি সবান্ধবে, কিছু রাজনৈতিক দলও। টাকা গোনার মেশিন কিছু হয়তো বেকার হয়ে পড়েছিল। এবার তারা সচল হওয়ার মওকা পেল। আগামী দিনে নগদ টাকা গোনা একটা নতুন পেশা হয়ে উঠতে পারে। কোনও পেশাই চিরস্থায়ী নয়। সময়ের সঙ্গে মানুষের রুচি প্রয়োজন চাহিদা বদলে যায়। সময়ের দাবি মেনে কত পেশা হারিয়ে গিয়েছে, শূন্যস্থানে এসেছে কত নতুন নতুন পেশা। টাকা গোনা কি সেই স্থান নেবে অদূর ভবিষ্যতে? ভারতীয় রাজনীতি সেই ভরসা দিচ্ছে বইকি। ছোঃ ডিজিটাল ইন্ডিয়া!
শিক্ষিত যুব সম্প্রদায় অনেক দিনই রাজনীতি-বিমুখ। তাতে বস্তুত ধুনোর ধোঁয়া দিল সাম্প্রতিক রাজনীতি। শুধু দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার রাজাপাকসে ব্রাদার্স নন, বাংলাসহ ভারতের অনেক চেনা মুখও সমান দায়ী। রাজনীতির এই যে ক্ষতি হল, অদূর ভবিষ্যতে পূরণ হওয়ার নয়। এর দ্বারা সমাজ, রাষ্ট্রেরও অপূরণীয় ক্ষতি হল। কারণ সমাজ রাষ্ট্র রাজনীতির ক্রীড়নক মাত্র। নিম্নমানের রাজনৈতিক আবহে উৎকৃষ্ট সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রত্যাশা বাহুল্য। আসলে টাকা ওড়ে ভোটে, ভোটকে কেন্দ্র করে। নির্বাচন কমিশন, সেন্ট্রাল এজেন্সি, পুলিস, সিআইডি প্রভৃতিকে তার সামনে জাস্ট ফালতু মনে হয়। কালো টাকা আসলে সমান্তরাল অর্থনীতি। এই অপশক্তির তেজ রাষ্ট্রিক আর্থিক বুনিয়াদের থেকেও কোথাও কোথাও নিশ্চয় বেশি। আন্তর্জাতিক স্বচ্ছতার মাপকাঠিতে কেন ভারতের বরাবরের হতশ্রী দশা, রাজনীতির অকল্পনীয় দুর্বৃত্তয়ান একাই তার সদুত্তর দিতে সক্ষম।
বরং আমাদের প্রেরণা হয়ে উঠুন মীরাবাঈ চানু, জেরেমি লালরিনুঙ্গা, অচিন্ত্য শিউলিরা। তাঁরাই প্রকৃত সোনার মেয়ে ও সোনার ছেলে। আলোচনা চলুক কমনওয়েলথ গেমসে, আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতি নিয়ে। রাজনীতিকরা রোজই কোনও-না-কোনওভাবে আমাদের আশাহত করছেন, মুখ কালো করে দিচ্ছেন। সেই কালো মুখে এইটুকু আশার আলোর মূল্য মোটেই ন্যূন নয়। কমনওয়েলথ গেমসে ভারোত্তোলনে ভারতের জয়জয়কার। এঁদের দেখেই ভরসা হয়, যদি রাজনীতির মাতব্বররা এঁদের কাছা টেনে না-ধরেন, তবে এশিয়ান গেমস বা ওলিম্পিকসের আসরেও অব্যাহত থাকবে এই জয়ের ধারা। রাজনীতির ধারাবাহিক ব্যর্থতার দুঃসহ ভার উপড়ে ফেলার জন্য দেশ অন্তত একজন প্রকৃত বীরের অপেক্ষায় থাক আপাতত।

3rd     August,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ