গত ২৬ জুলাই জাতি ২৩তম কার্গিল বিজয় দিবস উদযাপন করল। বীরযোদ্ধা, বিশেষ করে শহিদদের স্মরণ করার উদ্দেশ্যে দিনটি পালন করার সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে। তিনমাস ধরে চলা এই যুদ্ধে ৫২৭ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত এবং ১৩৬৩ সেনা জখম হন। সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার জন্য এই দেশ যে মূল্য দিয়েছে তা মোটেই সামান্য নয়।
৫০ বছর আগে আমাদের দেশ আরও একটি যুদ্ধে জয়ী হয়েছিল—সেটা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী দুটি ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছিল: একদিকে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত করে বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য পূর্ব সীমান্তে মুক্তি বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়েছিল। অন্যদিকে, ১১টি ভারতীয় বিমান বিমানঘাঁটিতে পাকিস্তান বায়ুসেনার তরফে আকাশপথে হামলার প্রতিশোধ নিতে লড়াই করেছিল পশ্চিম সীমান্তে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে ভারত পুরোমাত্রায় আক্রমণ শানিয়েছিল। ভারতের তরফে জানানো হয় যে, আমাদের সৈন্য মারা গিয়েছেন তিন হাজার এবং জখম হয়েছেন ১২ হাজার। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ইস্টার্ন আর্মি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ভারতের লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এস অরোরার কাছে নিঃশর্তে আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষর করেন। এটা ছিল ভারতের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ জয়।
হাতি নয়, ড্রাগন
দুটি জয়ই পাকিস্তানের বিপক্ষে। অতীতে, ১৯৪৭ এবং ১৯৬৫ সালে দুটি যুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও ভারতের সঙ্গে শান্তিতে থাকতে শেখেনি পাকিস্তান। এবং, ১৯৭১ সালে ভয়ানক পরাজয় মেনে নিয়েও দেশটি ১৯৯৯ সালে কার্গিলে ভারতীয় ভূখণ্ডে চুপিসারে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। এমনকী, কার্গিল যুদ্ধে পরাজয়ের পর, পাকিস্তান এখনও ভারতে অনুপ্রবেশের নষ্টামি অব্যাহত রেখেছে। উভয় দেশ স্বাধীন হওয়ার ৭৫ বছর পরে, আজ ভারতীয়দের অবশ্যই একটি গোঁয়ার প্রতিবেশীর পাশে বসবাসের জন্য নিজেদেরকে ভাবসাব করে নিতে হবে, যে প্রতিবেশী দেশটি জানে যে তারা কোনও স্বাভাবিক যুদ্ধে ভারতকে কখনওই হারাতে পারে না। তাই পাকিস্তান কোনও ‘দি এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম’ নয়।
বিপদকে ‘এলিফ্যান্ট’ বা ‘ড্রাগন’ যে নামেই চিহ্নিত করা হোক না কেন, সেটা হল চীন। একটি বিষয় স্পষ্ট: বিজেপি সরকারের যাবতীয় বুক বাজানো কারবার শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, কিন্তু চীনা আগ্রাসন মোকাবিলার সময় পুরো দিশাহারা। ২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর তামিলনাড়ুর মাম্মাল্লাপুরমে দোলনায় পাশাপাশি বসেছিলেন দু’জনে। কিন্তু তবু জি জিন পিংকে ঠিকঠাক মেপে উঠতে পারেননি। এটা প্রধানমন্ত্রী মোদিকে অবশ্যই পীড়া দেয়। এমনকী, দোলনাটি যখন সমুদ্রের ঠান্ডা হাওয়ায় মৃদুভাবে দুলছিল, তখন চীনের লাল ফৌজ (পিএলএ) ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশের ছক নিয়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিল। প্রেসিডেন্ট জিন পিং ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি সামরিক পদক্ষেপ অনুমোদনের আদেশে স্বাক্ষর করেন। লাল ফৌজ ২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিলে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) অতিক্রম করে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েছিল।
উল্টো সুর
অনুপ্রবেশের হদিশ ভারত পায় ২০২০ সালের ৫-৬ মে। অনুপ্রবেশকারীদের হঠাতে গিয়ে ১৫ জুন ২০ জন বীর সেনাকে হারিয়েছিল ভারত। ১৯ জুন প্রধানমন্ত্রী একটি সর্বদল বৈঠক ডাকেন। সমাপ্তি ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোনও বহিরাগত ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করেনি এবং কোনও বহিরাগত ভারতের মাটিতে ছিলও না।’ তবুও, বেশকিছু সামরিক কর্মকর্তা এবং বিশেষজ্ঞের মতে, প্রায় এক হাজার বর্গ কিমির নিয়ন্ত্রণ আর ভারতের হাতে নেই, অথচ আমাদের সেনা বাহিনী ওই অঞ্চলে আগে টহল দিতে পারত। ভারত ও চীনের মধ্যে সামরিক পর্যায়ে ষোলো দফা আলোচনা হয়েছে। যদি কোনও বহিরাগত ভারতীয় ভূখণ্ডের ভিতরে না ঢুকেই থাকে তবে কেন ২০ জন সেনা চরমভাবে আত্মত্যাগ করেছিলেন? এই অন্তহীন দফা আলোচনায় মিলিটারি কমান্ডারদের মধ্যে কী কথোপকথন চলছে? বিদেশ মন্ত্রক ‘ডিসএনগেজমেন্ট’ (সরে আসার পরিস্থিতি) এবং ‘উইথড্রল’ (প্রত্যাহার) নামক শব্দগুলি বার বার ব্যবহার করে কেন? এটা কি সত্য নয় যে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের বিবৃতি এবং বিদেশ মন্ত্রকের অন্যান্য বিবৃতিতে ‘স্থিতাবস্থা’ পুনরুদ্ধারের দাবি ছিল?
আসুন, নির্মম বাস্তবটা স্বীকার করে নিই। চীন পুরো গলওয়ান উপত্যকার দাবি করে। চীন দাবি করে যে এলএসি ফিঙ্গার ৪ বরাবর গিয়েছে, ফিঙ্গার ৮ বরাবর নয়। (২০২০ সালের মে মাসের আগে ফিঙ্গার ৪ এবং ফিঙ্গার ৮-এর মধ্যবর্তী অঞ্চলটিতে ভারত টহল দিত এবং এলাকাটি ভারতেরই নিয়ন্ত্রণে ছিল)। ১৬তম রাউন্ডের আলোচনায় চীন হট স্প্রিংস সম্পর্কে কিছুই মানেনি। ডেমচোক এবং ডেপসাং নিয়ে ভারত আলোচনা চেয়েছিল, কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করেছিল চীন। আকসাই চীন এবং ভারতের সঙ্গে তাদের ৩,৪৮৮ কিমি সীমান্ত বরাবর সামরিক পরিকাঠামো নির্মাণ করছে চীন। দেশটি প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) অব্দি ৫জি নেটওয়ার্ক স্থাপন করে ফেলেছে। প্যাংগং হ্রদ বরাবর একটি নতুন সেতুও নির্মাণ করেছে তারা। দেশটি সীমান্তে আরও মিলিটারি হার্ডওয়্যার এবং সৈন্য মোতায়েন করছে। নতুন গ্রামে চীনা নাগরিকদের বসতি স্থাপন করছে তারা। চীন যে এভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, উপগ্রহের অনেক ছবি থেকেই সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়।
অভাব একটি চীন নীতির
প্রাক্তন বিদেশ সচিব শ্যাম সারনের সাম্প্রতিক বই ‘হাউ চায়না সিজ ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’ (ভারত এবং বিশ্বকে কীভাবে দেখে চীন) থেকে এই পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে যে, ‘এশিয়ার যে অংশে তার আধিপত্য কায়েম রয়েছে তার ভিতরে ভারতকে একটি অধস্তন বোড়ের ভূমিকায় দেখতে চায় চীন। এশিয়ায় বানানো মর্যাদার শ্রেণিবিন্যাস এবং চীনা আধিপত্যের বিশ্বকে ভারত রুখবে।’ একদম ঠিক কথা। তবে, চীনের এতটা জোরের যে কারণ শ্যাম সারন চিহ্নিত করেছেন তা হল, ‘দুই দেশের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির ব্যবধান চীনের অনুকূলেই বেড়ে চলেছে।’ আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের (আইএমএফ) মতে, ২০২১ সালে চীনের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) মূল্যমান ছিল ১৬,৮৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং অঙ্কটি ভারতের ক্ষেত্রে ছিল মাত্র ২,৯৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার!
ভারতের বিরোধী দলগুলি সর্বদাই—যে দলই ক্ষমতাসীন থাক না কেন—সেই সরকার এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়েছে। ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলি এবং নাগরিকদের মধ্যে সংহতি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এটা কোনও নীতির ভিত্তিতে নয়। চীনকে জবাব দেওয়ার উপযুক্ত একটি আত্মবিশ্বাসী ও কার্যকর নীতি শুধুমাত্র তখনই পাওয়া সম্ভব, যখন বিরোধী দলগুলির আস্থাভাজন হয় সরকার, তাদের সঙ্গে তথ্যাদি ভাগ করে নেয় এবং খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে পরিকল্পনা গ্রহণ করে। অন্যথায়, আমরা কেবল আলোচনার রাউন্ড গুনতে থাকব আর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই আত্মপ্রতারণাই চালিয়ে যাব যে, ভারতের একটি চীন নীতি রয়েছে।
লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত