বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

অগ্নিশুদ্ধ হওয়াই অঙ্গীকার হোক তৃণমূলের
তন্ময় মল্লিক

অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলেই ‘দোষী’কে আড়ালের চেষ্টা, আর কড়া পদক্ষেপ করলেই ‘বলির পাঁঠা’। এটাই বিরোধী রাজনীতির বাঁধা গত। ইডি তল্লাশি চালিয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঘনিষ্ঠ বান্ধবী’র ফ্ল্যাট থেকে বিপুল টাকা উদ্ধারের ঘটনায় তাঁকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়াটাই ছিল বিরোধীদের মূল দাবি। তারজন্য বিরোধীরা রাস্তায় নেমেছেন। আন্দোলন করেছেন। কেউ মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন, কেউ আবার রাজ্যপালের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন। এই ঘটনায় শুধু মন্ত্রিত্ব নয়, দলের সমস্ত পদ থেকে পার্থবাবুকে সরিয়ে দিয়েছে তৃণমূল। আর সেটা দলীয় মুখপত্রের এক কোণায় চার লাইনের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নয়, রীতিমতো সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে। দোষ প্রমাণের আগেই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে এমন কড়া পদক্ষেপ করার সাহস আর কোনও দল দেখাতে পেরেছে? উত্তরটা ‘না’ বলাই যেত, তবুও প্রশ্নটা তোলা থাকল।
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, ‘অ-পা’ কাণ্ডে রাজ্যের শাসক দলকে চূড়ান্ত অপদস্থ হতে হয়েছে। মাথা হেঁট হয়েছে বললেও কম বলা হয়। কারণ রাজ্যের মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠের ফ্ল্যাট থেকে কোটি কোটি টাকা ও সোনার বার উদ্ধার বাংলা আগে কখনও দেখেনি। তাই পথেঘাটে, চায়ের দোকানে, পাড়ার মোড়ে আলোচনার একটাই বিষয়, এত টাকা! উঠছিল প্রশ্ন, এখনও পার্থর বিরুদ্ধে দল ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন?
পার্থ ঘনিষ্ঠের ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হওয়া টাকার পাহাড় দেখে সম্ভবত নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তৃণমূল সুপ্রিমো। দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের সঙ্গী, বহু আন্দোলনের সহযোদ্ধার এমন পদস্খলন তাঁর কল্পনার বাইরে ছিল। তাই কখনও দেখেছেন ষড়যন্ত্রের ছায়া, আবার কখনও দিয়েছেন পার্থর বিরুদ্ধে চরম শাস্তির হুঁশিয়ারি। তবে, ২২ কোটির সঙ্গে ২৮ কোটি যুক্ত হতেই তিনি বুঝে যান, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। তাই আদালতে প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করেননি। মন্ত্রিসভা থেকে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে সরিয়ে দিয়েছেন।
কেউ কেউ বলছেন, আরও আগেই প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। তাঁদের মতে, টাকা উদ্ধারের পর ৭২ ঘণ্টা সময়টা নাকি চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য অনেকটাই বেশি। তবে, সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হওয়ায় বিরোধীরা আন্দোলন করার কিছুটা সুযোগ পেয়েছে। প্রচার করতে পেরেছে, তৃণমূলনেত্রী ‘স্টেপ’ নিতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ এটা তৃণমূলের টাকা। দল কড়া পদক্ষেপ করলেই পার্থবাবু নাকি গড় গড় করে সেসব ফাঁস করে দেবেন। তাতে অনেক রাঘববোয়াল ফেঁসে যাবে। সেই ভয়েই কিছু করতে সাহস পাচ্ছে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও ঘাড় নেড়ে সেকথায় সায় দিয়েছিলেন। তবে, তাঁদের দোষ নেই। কারণ এতদিন তাঁরা যা দেখেছেন, তার ভিত্তিতেই ব্যক্ত করেছেন তাঁদের অভিমত।
এতদিন তাঁরা কী দেখেছেন? দেখেছেন, গড়বেতার ছোট আঙারিয়ায় বক্তার মণ্ডলের আত্মীয়দের জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনায় তপন ঘোষ, সুকুর আলি অভিযুক্ত হলেও সিপিএম কঠোর হতে পারেনি। উল্টে সিবিআইকে গ্রামে ঢুকতে বারবার বাধা দিয়েছে। নন্দীগ্রামে অপারেশন সেরে জখম আন্দোলনকারীদের পাচারের সময় এগরায় হাতেনাতে ধরা পড়েছিলেন ওই দুই নেতা। পরিচয় গোপন করে বাঁচানোর চেষ্টা করেও শেষরক্ষা হয়নি। জেল খাটার পরেও মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টে জেল থেকে বেরনোর সময় গলায় মালা পরিয়ে ‘দলের সম্পদ’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দেখেছিলেন, নেতাইয়ে রথীন দণ্ডপাতের বাড়ির হার্মাদ ক্যাম্প থেকে ছোড়া গুলিতে ন’জন গ্রামবাসীর মৃত্যুর পরেও সিপিএম ব্যবস্থা নেয়নি। তার বদলে অভিযুক্তদের বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছে।
বিশ্লেষকরা দেখেছেন, বেনাচাপড়ার কঙ্কাল উদ্ধার কাণ্ডে অভিযুক্ত সুশান্ত ঘোষের বিরুদ্ধে দল কোনও কড়া পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টে শূন্য থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য রাজ্য নেতৃত্ব তাঁকেই বসিয়েছেন দলের জেলা সম্পাদকের আসনে। 
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কোনও দোষ দেখছি না। কারণ তাঁরা দেখেছেন, লখিমপুরে আন্দোলনকারী চাষিদের পিষে মারার ঘটনায় অভিযুক্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ছেলেকে আড়াল করার চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেনি বিজেপি নেতৃত্ব। আদালতের ধমক খেয়ে মন্ত্রীর পুত্রকে গ্রেপ্তার করলেও তদন্তকারী অফিসারদের মাথায় আসেনি ‘প্রভাবশালী’ তত্ত্ব। তাই অমিত শাহের ডেপুটির চাকরিটা অজয় মিশ্রকে খোয়াতে হয়নি।
বিশ্লেষকরা দেখেছেন, উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ে নাবালিকাকে ধর্ষণ ও তার বাবাকে খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েছিল বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গার। কিন্তু বিধায়কের বিরুদ্ধে গেরুয়া শিবির কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। দু’বছর পর আদালত বিধায়ককে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল। তখন আর নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। তবে তার স্ত্রী এখনও বিজেপির প্রভাবশালী নেত্রী। আর এরাজ্যে কিছু ঘটলেই বিজেপি নেতৃত্বের পান থেকে চুন খসার তর সয় না। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিকার চায়। 
অভিযুক্ত দলীয় নেতাকে আড়াল করাই রাজনৈতিক দলের অলিখিত প্রথা। অতীতের দৃষ্টান্ত দেখে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ভেবেছিলেন, তৃণমূল নেতৃত্বও সে পথে হেঁটে নানা অজুহাত খাড়া করে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে রক্ষা করতে চাইবে। তাই বিরোধীরা একযোগে মন্ত্রিত্ব থেকে পার্থের অপসারণ দাবি করেছিলেন। তৃণমূল নেতৃত্ব শুধু অভিযুক্ত নেতাকে মন্ত্রিত্ব থেকেই ছেঁটে ফেলেনি, দলের সমস্ত পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত কোনও ‘আইওয়াশ’ নয়। কারণ তৃণমূল নেতৃত্ব জানিয়েছে, যতদিন তদন্ত চলবে ততদিন এই শাস্তি বহাল থাকবে। আদালতে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারলে দল ফিরিয়ে নেবে। হ্যাঁ, এটাই হওয়া উচিত। দেরি হলেও সিদ্ধান্তটা তৃণমূল নিতে পেরেছে। এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট কেবল একটা তদন্তকারী সংস্থা নয়, এটা কখনও কখনও হয়ে যায় কেন্দ্রীয় সরকারের ‘হাতিয়ার’। তাই বিরোধীদের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য সিবিআই, ইডির তদন্ত বছরের পর বছর চলতে থাকে। নির্বাচন এলেই হয় সক্রিয়। বাকি সময়টা চলে যায় ‘শীতঘুমে’। 
শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতি মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ করার দাবি জানিয়েছে তৃণমূল নেতৃত্ব। এই দাবি শুধু শাসক দলের নয়, রাজ্যবাসীর। বলা ভালো, দেশবাসীরও। কারণ তদন্ত প্রক্রিয়া বিলম্বিত হলে কমে ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ। তাছাড়া শাস্তির খাঁড়া মাথার উপর ঝুলিয়ে রেখে ভয় দেখানোটাও এক ধরনের ‘ক্রাইম’। লাইসেন্সপ্রাপ্ত আগ্নেয়াস্ত্র থাকলেই তা যখন তখন বের করে প্রতিপক্ষকে দেখানো যায় না। তার উদ্দেশ্য ভীতি প্রদর্শন। তাই পুলিস আইনগত ব্যবস্থা নেয়। তেমনই ইডির মতো একটা সংস্থাকে ‘জুজু’ হিসেবে ব্যবহার করাটাও সরকারের ‘অপরাধ’ বলে অনেকে মনে করেন।
কোনও ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটলে তা মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ করাই সরকার ও শাসক দলের কর্তব্য। সেটা পালন করলে সঙ্কুচিত হয় তা নিয়ে বিরোধীদের রাজনীতি করার রাস্তা। বগটুই, হাঁসখালি ও ঝালদার ঘটনায় রাজ্যজুড়ে ঝড় উঠলেও স্থায়ী হয়নি। কারণ সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছিল। তার উপর সিবিআই তদন্তের ঘোষণায় তিনটি ইস্যুই বিরোধীদের হাতছাড়া হয়ে যায়। একইভাবে ‘অ-পা’ কাণ্ডে তৃণমূল নেতৃত্ব কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে বিরোধীদের পালের হাওয়া কেড়ে নিল। 
এতদিন যাঁরা প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর অপসারণের দাবিতে রাস্তায় মিছিল করছিলেন এখন তাঁরাই বলছেন, পার্থকে ‘বলির পাঁঠা’ করা হল। কারণ তাঁরাও বুঝেছেন, পার্থর বিরুদ্ধে তৃণমূল ব্যবস্থা নেওয়ায় বাজার গরম করার মতো কোনও ইস্যু আর হাতে থাকল না। বাকি যেটুকু আছে সেটাও সম্ভবত যেতে বসেছে। সেটা আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের চাকরি। তৃণমূল নেতৃত্ব এর গ্রহণযোগ্য সমাধানসূত্র বের করতে পারলে আক্ষরিক অর্থেই বিরোধীদের হাতে থাকবে পেন্সিল। তবে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ ও বঞ্চিতদের চাকরির ব্যবস্থা করলেই তৃণমূলের দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে না। বরং বলা যায়, শুরু হল। কারণ ১১ বছর ক্ষমতায় থাকার সুবাদে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য ‘আগাছা’। নিতে হবে ব্যবস্থা। তৃণমূলকে হতে হবে অগ্নিশুদ্ধ। এটাই হোক ‘নতুন তৃণমূলে’র অঙ্গীকার। তবেই তৃণমূল ফিরবে সেই ‘মমতার তৃণমূলে’।

30th     July,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ