বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

মমতাকে বুঝে ওঠাই
চ্যালেঞ্জ বিরোধীদের
সমৃদ্ধ দত্ত

১৯৮৪ সালে যখন দাপুটে সিপিএম নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে পরাস্ত করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু রা‌জ্য নয়, গোটা দেশের রাজনৈতিক মহলকেই চমকে দিয়েছিলেন, সেই সময় সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক ছিলেন সরোজ মুখোপাধ্যায়। প্রদেশ কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি ছিলেন আনন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়। ভারতীয় জনতা পার্টির রাজ্য সভাপতি ছিলেন ড. বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী। সরোজবাবুর পর রাজ্য সিপিএমের সর্বোচ্চ পদাধিকারী অর্থাৎ সম্পাদক হয়েছেন একের পর এক অভিজ্ঞ, বুদ্ধিমান সংগঠক এবং অত্যন্ত তীক্ষ্ণ রাজনীতিক। শৈলেন দাশগুপ্ত, অনিল বিশ্বাস, বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র এবং সম্প্রতি মহম্মদ সেলিম। 
প্রদেশ কংগ্রেসের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করার সেই সময় থেকে অর্থাৎ ১৯৮৪ সালের পর যাঁরা প্রদেশ সভাপতি হয়েছেন, তাঁরা বাংলার রাজনীতির আকাশে খ্যাতনামা, জনপ্রিয়। এমনকী কয়েকজন দিল্লির জাতীয় স্তরের রাজনীতির অন্যতম প্রধান চরিত্র হয়েছেন। যেমন ১৯৮৫ সালে রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তারপর থেকে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, এ বি এ গণি খান চৌধুরী, সিদ্ধার্থ শংকর রায়, সোমেন মিত্র, মানস ভুঁইয়া, প্রদীপ ভট্টাচার্য, অধীর রঞ্জন চৌধুরী। এঁদের মধ্যে কয়েকজন কয়েক দফায় হয়েছেন প্রদেশ সভাপতি। পাশাপাশি রাজনৈতিক শক্তির বিচারে একেবারে তৃতীয় স্থানে থাকা বিজেপির সভাপতিরাও এই সময়সীমা থেকেই ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ নাম। তপন শিকদার, অসীম ঘোষ, তথাগত রায়, সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়, রাহুল সিনহা, দিলীপ ঘোষ এবং সুকান্ত মজুমদার। 
সিপিএম, কংগ্রেস এবং বিজেপির প্রাক্তন ও বর্তমান সর্বোচ্চ পদাধিকারীদের নামের তালিকা এখানে পেশ করার কারণ কী? কারণ হল, একুশে জুলাই নিয়ে প্রতি বছর বিরোধীদের মধ্যে যে হাসাহাসি, কটাক্ষ, ঠাট্টাবিদ্রুপ, ব্যঙ্গ শ্লেষ শোনা যায়, এই তালিকার দিকে চোখ রাখলে তাঁদের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে নিরন্তর হাসিঠাট্টা করার আত্মতৃপ্তি কিছুটা হলেও ধাক্কা খাবে। এই তালিকা প্রমাণ করছে ১৯৮৪ সাল থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কতজন জনপ্রিয়, প্রভাবশালী, রাজনীতিতে প্রবল অভিজ্ঞতা সম্পন্ন দাপুটে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে একটি একক লড়াই চালিয়ে আসছেন। অর্থাৎ এই তাবৎ নেতারা তাঁদের দলকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে চালিত করেছেন রাজনৈতিকভাবে, কিন্তু প্রতিটি দল ও নেতাদের ছাপিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবিশ্বাস্যভাবে বাংলার সবথেকে সফল রাজনীতিকে পরিণত হয়েছেন। শুধু গত দশ বছরেই বিরোধী দলগুলির নেতৃত্বে কতবার বদল হল? মমতা একাই রয়ে গেলেন! 
পরিসংখ্যানগতভাবে জ্যোতি বসু সবথেকে বেশি সময় ধরে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু তিনি একক দল গঠন করেননি। তাঁর সংসদীয় ও ব্যক্তিগত শক্তির অন্যতম স্তম্ভ ছিল প্রথমে সিপিআই এবং পরে সিপিএম নামক দল। বিধানচন্দ্র রায় বাংলার রূপকার। তিনি ছিলেন এক অসামান্য মুখ্যমন্ত্রী, যাঁকে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও সমীহ করতেন। তাঁদের প্রয়োজনে কড়া কথা বলতে দ্বিধা করতেন না বিধান চন্দ্র রায়। কিন্তু রাজ্যে এককভাবে দলের উপর সর্বময় নিয়ন্ত্রণ তাঁর ছিল না। তাঁর পাশাপাশি ছিলেন কংগ্রেসের একঝাঁক দোর্দণ্ডপ্রতাপ ও জনপ্রিয় নেতা। অন্যদিকে, অজয় মুখোপাধ্যায় থেকে প্রণব মুখোপাধ্যায়। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি অথবা সৈফুদ্দিন চৌধুরী, সমীর পুততুন্ড। এরকম অনেকেই দলের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে পৃথক দল গঠন করেছেন। কিন্তু কেউই নিজের দলকে বিপুল এক মহীরুহে পরিণত করতে পারেননি। বহু দল বিস্মৃতির অন্তরালে মিলিয়ে গিয়েছে। 
স্বাধীনতার পর বাংলার রাজনীতিতে একমাত্র ব্যতিক্রম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একক দল গঠন। সেই দলকে মাত্র তেরো বছরের মধ্যে সরকারে বসানো। এরপর একটানা তিনবার নির্বাচনে জয়। তারও আগে বহুবার এমপি হওয়া। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পদে বসা। ১৯৯২ সালের পর থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সিপিএম, বিজেপির পাশাপাশি, নিজের দল কংগ্রেসের একাংশের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে হয়েছে। 
অর্থাৎ আজকের বিরোধী নেতাদের মনে রাখতে হবে যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রাজনৈতিক জীবনে কতজন সিপিএমের সম্পাদক, কংগ্রেসের সভাপতি, বিজেপির সভাপতিকে দেখে এসেছেন। আর তাঁদের মধ্যে অনেককেই ব্যর্থ হতে, পদচ্যুত হতেও দেখলেন চোখের সামনে। অথচ তিনি রয়ে গেলেন। এবং ১৯৮৪ সালের পর থেকে এই বাংলার একমাত্র তাঁরই রাজনৈতিক গ্রাফ লাগাতার ২০২২ সাল পর্যন্ত ঊর্ধ্বমুখী হয়েই রয়ে গেল।
বাংলার বিভিন্ন দলের কত নেতা এলেন এবং চলে গেলেন। তাঁদের প্রত্যেককে মমতা দেখলেন। এই যে বিপুল এক অভিজ্ঞতা, এর দাম নেই?  পুরনো এবং নতুন যাঁরা এখন বিরোধী রাজনীতির মুখ হয়েছেন, তাঁদের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা মমতার সঙ্গে তুলনীয়? এঁদের একজনও঩ কি একক আহ্বানে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড কিংবা ধর্মতলার মোড় লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে ভরিয়ে দিতে পারবেন? তাঁদের একক নামেই মানুষ তাঁর দলকে ভোট দিচ্ছে, এরকম ক্যারিশমা, গ্ল্যামার, জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা আছে? নেই কেন? তৃণমূল সরকার ও দলের বিরুদ্ধে তো প্রচুর অভিযোগ ওঠে। কিন্তু এসব ইস্যুতে অনড় থেকে লাগাতার আন্দোলন, সরকারের ভিত নড়িয়ে দেওয়া কিংবা সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করার কাজটা করে ওঠা যাচ্ছে না কেন? বিরোধীদের সাধারণ মানুষ ও তৃণমূলস্তরে যোগাযোগই গড়ে ওঠেনি কেন? যা সর্বাগ্রে দরকার রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে!
বিজেপি বিগত বছরগুলিতে অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে উঠে এসেছে। কিন্তু সেই শক্তির এপিসেন্টার থেকে নরেন্দ্র মোদিকে ধরা যাক বাদ দেওয়া হল। তাহলে কী পড়ে থাকবে? নরেন্দ্র মোদির বিপুল প্রভাব প্রতিপত্তি জনপ্রিয়তা ছাড়া বিজেপির বাংলার কোনও নেতার পক্ষে সম্ভব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া? একুশে জুলাই নিয়ে বিদ্রুপ করার আগে ভাবতে হবে না যে, লাগাতার আঠাশ বছর ধরে কলকাতায় এই জনসমুদ্র অ্যারেঞ্জ করা রাজনৈতিকভাবে কতটা কঠিন? যার মধ্যে সিংহভাগ সময় বিরোধী নেত্রী হিসেবে? ১৯৯২ অথবা ২০২২, মমতার সভা থেকে ভিড় সরানো যাচ্ছে না কেন? বিরোধীদের নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে না? বাংলার রাজনীতিতে বিরোধীদের মধ্যে দুটি বিষয়ের অভাব। ম্যাচিওরিটি এবং বুদ্ধিমত্তার রাজনীতি। বিরোধীদের রাজনীতির প্যাটার্ন থেকে এই দুটোর কোনওটাই চোখে পড়ছে না। তাই তারা ক্রমেই কেউ ভোটে শূন্য হয়ে যাচ্ছে, কেউ ঘর সামলে রাখতেই নাকাল! 
তৃণমূল আজ বিপুল শক্তিশালী রয়েছে। কালের নিয়মে এরকম শক্তি একদিন থাকবে না। সেটাই রাজনীতির ইতিহাসে নিয়ম। সেই পতন বামফ্রন্টের মতো চৌত্রিশ বছর পরে হবে? নাকি তৃণমূলের আরও বৃদ্ধি ও গুরুত্ব বেশি হবে পরবর্তীকালে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে? অথবা আগামী কিছু বছর পর তৃণমূল দুর্বল হয়ে যাবে? এসব তো জল্পনা কল্পনা এবং জ্যোতিষবিদ্যার বিষয়। রাজনীতি সম্ভাব্যতার শিল্প। ভবিষ্যদ্বাণী অর্থহীন। কিন্তু যোগ্য বিরোধী কোথায়? সিপিএমের বিদায়কালের অনেক বছর আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যে, এরপর একদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উঠে আসতে চলেছেন রাজনীতি ও সরকারের ভরকেন্দ্র হয়ে। সেরকম কোনও লক্ষণ এখন দেখা যাচ্ছে বিরোধী কোনও দল অথবা নেতানেত্রীকে ঘিরে? কেন যাচ্ছে না? সেই ছাপ ফেলতে পারছেন না কেন তাঁরা? সমস্যাটা কোথায়? 
বিরোধীরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপুল অভিজ্ঞতা, রাজ্য ও জাতীয় স্তরের রাজনীতির জ্ঞান, তাঁর নেটওয়ার্ককে আন্ডারএস্টিমেট করে। মমতা বিরোধীদের নিশ্চিত ধারণা হয়েছে, তিনি প্রকাশ্যে যেমন নিজেকে প্রতিভাত করেন, যা যা বলেন, উচ্চারণ করেন অর্থাৎ যা নিয়ে বিরোধীরা হাসাহাসি করে,  শুধু সেটাই বুঝি তিনি। কিন্তু এসবের আড়ালে যে এক ক্ষুরধার রাজনীতির তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ ২৪ ঘণ্টাই কাজ করে তাঁর মধ্যে, সেটা বুঝে ওঠা অধরাই থেকে যাচ্ছে। বিরোধীদের সঙ্গে তাঁর সবথেকে বৃহৎ  ফারাক গড়ে দিচ্ছে ওই একক ভাবনার আড়ালে থাকা  রহস্যময় মমতাই! 

22nd     July,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ