বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

যুদ্ধের অস্ত্র যখন জ্বালানি তেল
মৃণালকান্তি দাস

ইউরোপ এক সন্ধ্যায় যতটা অশোধিত তেল রাশিয়া থেকে আমদানি করে, গোটা মাসে ভারত করে তার থেকে কম। ওয়াশিংটনের মাটিতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। আর সম্প্রতি জি-৭ মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়ে দিয়েছেন, জ্বালানির ব্যবহার ধনী ব্যক্তিদের একচেটিয়া নয়। দরিদ্রদেরও অধিকার আছে জ্বালানি ব্যবহারের সুবিধা ভোগ করার। নাম না করেই বুঝিয়ে দেন, রাশিয়া বিরোধী দেশগুলি যতই চাপ দিক না কেন, জাতীয় স্বার্থে কম দামে রুশ তেল কিনবে ভারত। তাতে অবশ্য ভারতের গরিব জনতা কী সুবিধা পাচ্ছে তা কেউ জানে না। তবে মোদি নিশ্চিত বুঝে গিয়েছেন, যুদ্ধের ‘অস্ত্র’ হয়ে উঠেছে জ্বালানি তেল। এই তেলই হয়ে উঠতে পারে ভারতের নির্বাচনী সাফল্যের অস্ত্রও। সেই অঙ্কও হয়তো কষা শুরু হয়ে গিয়েছে...।
ইউক্রেন হামলার পর ভ্লাদিমির পুতিনকে শিক্ষা দিতে রাশিয়াকে ‘ভাতে মারা’র পরিকল্পনা করেছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সহ অন্য শক্তিশালী দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা। সেই প্ল্যান কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। তথ্য বলছে, ইউক্রেনে হামলার পরবর্তী ১০০ দিনে ৯ হাজার ৭৭০ কোটি ডলারের জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানি করেছে রাশিয়া। অর্থাৎ গড়ে প্রতি দিন প্রায় ৯৮ কোটি ডলারের জ্বালানি অন্য দেশে রপ্তানি করেছে পুতিনের দেশ। এই রপ্তানি হওয়া জ্বালানির অর্ধেকের বেশিই অপরিশোধিত তেল। কিন্তু কারা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও জ্বালানি কিনছে রাশিয়া থেকে?
সমীক্ষা বলছে, এই তালিকায় সবার আগে রয়েছে চীন, তারপরেই জার্মানি এবং ভারত। রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলিও। ইউক্রেন হামলার পর যে আড়াই হাজার কোটি ডলারের পাইপলাইন গ্যাস রাশিয়া অন্য দেশে রপ্তানি করেছে, তার ৮৫ শতাংশ গিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলিতে। বিস্ময়ের কথা হল, এই আমদানিকারী দেশগুলির তালিকায় রয়েছে জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডসের মতো বহু ন্যাটোভুক্ত দেশের নাম। রাশিয়ার সঙ্গে লড়ার জন্য যাদের সাহায্যপ্রার্থী ইউক্রেন। জানা গিয়েছে, গত দু’মাসে উরাল ক্রুডের গুণগত মানোন্নয়ন করেছে রাশিয়া। জ্বালানি তেলকে আরও বেশি লাইট অ্যান্ড সুইট (কম ঘনত্বের ও ০.৫ শতাংশেরও কম সালফারযুক্ত জ্বালানি তেল) করার কারণে এশিয়ার ক্রেতাদের কাছেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
শুনলে অবাক হবেন, রাশিয়ার ‘সস্তার তেল’ কিনতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সৌদি আরবের মতো দেশও। এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাসে রাশিয়া থেকে দ্বিগুণ জ্বালানি তেল আমদানি করেছে সৌদি আরব। রেফিনিটিভ এইকন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ‘শিপ ট্র্যাকিং ডেটা’ বিশ্লেষণ করে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স। রেকর্ড অঙ্কের তেলের ক্রেতা মিশরও। আর যে আমেরিকা রাশিয়ার তেল না কেনার জন্য বিশ্বকে চাপ দিচ্ছে, তারাই মার্চ-এপ্রিলে রেকর্ড পরিমাণ রাশিয়ার অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে রিজার্ভার ভরিয়ে ফেলেছে।
আসলে যে প্রশ্নের এখনও উত্তর মেলেনি তা হল, রাশিয়ার তেলের বিকল্প কোথায়? ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এ একই প্রশ্ন তুলেছেন এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের সহ-সভাপতি এবং ‘দ্য নিউ ম্যাপ’ গ্রন্থের রচয়িতা ড্যানিয়েল ইয়েরগিন। অথচ, এই জ্বালানি তেলের সঙ্কটে আজ দেশে বিদেশে শোরগোল। পণ্য পরিবহণ ও উৎপাদনের দুইয়ের খরচ বাড়ছে তাতে। চড়া মূল্যস্ফীতির আঘাতে ক্ষুদ্ধ জনতা, অনেক দেশেই চলছে বিক্ষোভ। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের মতো খাদের কিনারায় প্রায় এক ডজন দেশ। রাশিয়ার জ্বালানি নিয়ে বর্তমান অচলাবস্থা বিশ্বজুড়ে ‘মহামন্দা’ ডেকে আনতে পারে। সেই আতঙ্কও ক্রমশ বাড়ছে।
ইউরোপ তার পূর্ব দিকের প্রতিবেশী রাশিয়া থেকে সমুদ্রপথে জাহাজে করে দুই-তৃতীয়াংশ জ্বালানি আমদানি করে। সেটা তারা বন্ধ করে দিতে চায়। পোল্যান্ড ও জার্মানিও পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করতে সম্মত হয়েছে। এই দু’টি সিদ্ধান্ত যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে রাশিয়ার জ্বালানি ইউরোপে প্রবেশে একটি পথই খোলা থাকবে। সেটা দক্ষিণ দিকের দ্রুজবা পাইপলাইন। এই পাইপলাইন দিয়ে স্লোভাকিয়া, চেক রিপাবলিক এবং ক্রেমলিন-সমর্থিত হাঙ্গেরিতে জ্বালানি সরবরাহ হয়। কিন্তু তাতেও কি রাশিয়াকে ‘ভাতে মারা’ সম্ভব?
পশ্চিমের ক্রেতারা যখন রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করছে, রাশিয়া তখন তার তেলের বাজার এশিয়াতে সম্প্রসারণ করছে। বিশেষ করে ভারতে। এর আগে রাশিয়ার জ্বালানির প্রধান ক্রেতার তালিকায় ভারত ছিল না। এশিয়ায় জ্বালানি বিক্রি বাড়াতে রাশিয়া ব্যারেল প্রতি ৩০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম এতটাই বেড়ে গিয়েছে (মার্চ থেকেই ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারে উঠে গিয়েছে) যে যুদ্ধ শুরুর আগেই রাশিয়া জ্বালানি রপ্তানি করে বিপুল আয় করে ফেলেছে। গত বছরের প্রথম চার মাসের তুলনায় এই বছরের প্রথম চার মাসে তেল রপ্তানি করে ৫০ শতাংশ বেশি আয় করে ফেলেছে রাশিয়া।
আপাতত রাশিয়ার কাছে এশিয়ায় নতুন বাজারকে নিরাপদ বলে মনে হচ্ছে। রীতিমতো দর-কষাকষি করে চুপিসারে রাশিয়ার তেল কেনা বাড়িয়ে দিয়েছে চীনও। তেল কিনেছে চীনের ইউনিপেক ও ঝেনহুয়া অয়েল। ইউনিপেক হল এশিয়ার সর্ববৃহৎ তেল পরিশোধনকারী কোম্পানি সিনোপেক কর্পোরেশনের বাণিজ্যিক শাখা। আর ঝেনহুয়া চীনের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সংস্থা নরিনকোর অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। ব্যারেল প্রতি প্রায় ২৯ ডলার কমে রাশিয়ার তেল পাচ্ছে তারা। গত মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত তিন মাসে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল, গ্যাস ও কয়লা কিনতে ১ হাজার ৮৯০ কোটি ডলার খরচ করেছে চীন, যা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। পশ্চিমীরা যদি এশিয়ার বাজারে সমুদ্রপথে রাশিয়ার জ্বালানি আসার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তাহলে চীন, ভারতের মতো আমদানিকারকদের মধ্যেও ক্ষোভের সৃষ্টি হবে। এটা এড়াতে গেলে ইরান ও ভেনেজুয়েলার তেলের উপর কয়েক বছর ধরে যে নিষেধাজ্ঞা চলছে সেটা তুলে নিতে হবে। সেটা কি সম্ভব? না হলে এখন বিশ্বে তেলের দাম যতটা উঁচুতে উঠেছে, সেটাকে আরও উঁচুতে উঠতে দেওয়া ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই।
সম্প্রতি জার্মানিতে অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলনে রাষ্ট্রপ্রধানরা রাশিয়ার তেল যাতে নির্দিষ্ট একটা দামের উপরে আমদানিকারকরা কেনে, সেই জন্য ‘প্রাইস ক্যাপ’ (সর্বনিম্ন মূল্য বেঁধে দেওয়া) বসানোর ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। এতেই নাকি রাশিয়াকে শায়েস্তার করা যাবে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা অত সহজ নয়। ‘দ্য মিথ অব দ্য অয়েল ক্রাইসিস’ বইয়ের লেখক রবিন মিলস বলছেন, রাশিয়ার তেলের উপর প্রস্তাবিত ‘প্রাইস ক্যাপ’ অনেক বেশি। তারা পশ্চিমী দুনিয়ার চাপানো ‘প্রাইস ক্যাপ’ মানবে কেন? প্রাইস ক্যাপ বসানো কিংবা শুল্ক আরোপ তখনই কার্যকর হবে, যখন রাশিয়া চুপ করে সেটা মেনে নেবে। কিন্তু জ্বালানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মস্কো তো অন্য খেলা শুরু করেছে।
১৯৯০-এর দশকে ইরাকেও ‘তেলের বিনিময়ে খাদ্য’ কর্মসূচির ক্ষেত্রে প্রাইস ক্যাপ বসানো হয়েছিল। কিন্তু তা টেবিলের নীচের লেনদেনের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। এটা ক্রেমলিনের অজানা নয়। প্রাইস ক্যাপ বসানো হলে রাশিয়া তার ভূরাজনৈতিক স্বার্থে তেল বিক্রির ক্ষেত্রে ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ নীতিতে এগবে। আবার তেল রপ্তানি রাশিয়া নিজ থেকেই কমিয়ে দিতে পারে। ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির ক্ষেত্রে এরই মধ্যে রাশিয়া এই কৌশল প্রয়োগ শুরু করেছে। ইতিমধ্যে রাশিয়া জাপানকে সতর্ক করে দিয়েছে যে, প্রাইস ক্যাপ বসানোর প্রস্তাবে সমর্থন করলে জাপানে তেল সরবরাহ কমিয়ে দেবে রাশিয়া। তাতে জাপানে ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম ৩০০-৪০০ ডলারে গিয়ে ঠেকবে।
রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি রাখার খেসারত হিসেবে আগামী শীতে ব্রিটেনের অন্তত ৬০ লাখ পরিবারকে হাড় হিম করা ঠান্ডায় সকাল-সন্ধ্যা, যখন-তখন বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় কাটাতে হতে পারে। শুধু ব্রিটেন নয়, গোটা ইউরোপের বিদ্যুৎ–গ্রাহকরা এই অবস্থায় পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা। যে নিষেধাজ্ঞাগুলি পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপের দেশগুলি রাশিয়ার উপর চাপিয়েছে, তা ব্যুমেরাং হয়ে আঘাত করেছে গোটা ইউরোপেই। ইতিমধ্যেই জ্বালানির অভাবে হাঙ্গেরি জানিয়ে দিয়েছে, রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে প্রকারান্তরে হাঙ্গেরির উপর ‘পারমাণবিক বোমা’ ফেলা হয়েছে। হাঙ্গেরির নেতারা মনে করছেন, নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য অস্পষ্ট। কত দিনের মধ্যে এর সুফল পাওয়া যাবে, তার কোনও সময়সীমা অনুমান করা যাচ্ছে না। জ্বালানি তেলকে রীতিমতো প্রতিরোধের অস্ত্র বানিয়ে ফেলেছেন পুতিন। নিষেধাজ্ঞার সহজাত প্রবণতা, দিন যত যায় তা তত কঠিন হতে থাকে এবং তা একসময় ভেঙে ফেলা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। তাই যদি হয়, বিশ্বের আগামীর দিনগুলি আরও খারাপের দিকে।
তা সত্ত্বেও ইইউ যা করছে, তা স্রেফ পাগলামি ছাড়া কিছু নয়! বলছেন, ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকার কলামিস্ট সাইমন জেনকিন্স। 

21st     July,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ