নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণার চেয়ে বড় ব্যাধি নেই। নিরন্তর পরিপোষণে ব্যাধিটি দুরারোগ্যই হয়ে ওঠে। কোনও কোনও ধর্মীয় সমাবেশের আস্ফালনের উপর নজর রাখলে বিষয়টি বেশ মালুম হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় সম্প্রতি প্রচারিত একটি ভিডিয়ো ক্লিপিং থেকে অবশ্য বিপরীত বার্তা পাওয়া গেল। নূপুর শর্মা ইস্যুতে এক মুসলিম ধর্মগুরুর বক্তব্য, ‘ব্যাপারটি পুরোপুরি রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক। রাজনৈতিক ফায়দা তোলার মতলবে দুটি পক্ষ এই বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। মাঝখান থেকে অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে অসংখ্য নিরীহ মানুষ। অতএব প্রতিটি মানুষের উচিত, বিষয়টিকে সচেতনভাবে উপেক্ষা করা। অন্যথায়, পরোক্ষে মতলববাজদেরই সহায়তা করা হবে। দয়া করে কেউ পুতুলনাচের অংশ হবেন না।’ বক্তব্যের সমর্থনে তিনি একটি মনোজ্ঞ গল্পও শুনিয়েছেন: এক কাক তার শকুন-বন্ধুর কাছে আক্ষেপ করছে, ‘অন্যসব প্রাণীর মাংস খেয়েছি কিন্তু মানুষের মাংস খাওয়া হল না! জীবজন্তুর লাশ পগারে ভাগাড়ে মেলে, অমিল শুধু মানুষের লাশ। মৃতদেহ হিন্দুরা পুড়িয়ে ফেলে আর মুসলিমসহ অনেক ধর্মাবলম্বী কবর দেয়।’ দিন কয়েক পর শকুন একটি উপায় বাতলাল, ‘মনুষ্য চরিত্র স্টাডি করে বুঝেছি, তোমার স্বপ্নপূরণ হওয়া খুব সহজ! চলো, এক টুকরো গোমাংস কোনও হিন্দু মন্দিরে আর এক টুকরো শূকরের মাংস কোনও মসজিদে রেখে আসি। তারপর দেখবে খেলা জমে যাবে! হিন্দু ও মুসলিমের কেউই তলিয়ে দেখবে না, কীভাবে এটা হল। তারা শুধু একে অপরকে সন্দেহ করবে, দুষবে, আক্রোশে ফুঁসবে। তারপর চলবে বদলা নেওয়ার পালা। তাতে কত যে মানুষ মরবে গুনে শেষ করতে পারবে না। তখন কে কাকে পোড়াবে কিংবা কবর দেবে? সব লাশ পড়ে থাকবে। আমরা খেয়েই শেষ করতে পারব না!’
দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, সব জেনেও সময়কালে সত্য বিস্মৃত হচ্ছে মানুষ। শুধু ভারতবাসী নয়, বাংলাদেশ, পাকিস্তান মিলিয়ে গোটা উপমহাদেশ এই ভুলের ফাঁদে পা গলিয়ে বসে আছে। প্রজন্ম বদলাচ্ছে। বাড়ছে শিক্ষার হার। দেশ-বিদেশের সমীহ জাগানো ডিগ্রি পকেটে বহু তরুণ-তরুণীর। চেহারা ছবিতে উগ্র আধুনিকতারই আধিক্য। তবু গল্পের শকুনরা বাস্তবের মাটিতে সফল বাণিজ্য করে চলেছে।
২৪ জুন, শুক্রবার সন্ধ্যায় ‘কুঞ্জলতা’ এবং ‘বেগম রোকেয়া’ নামে দুটি ফেরির (মাওয়া ও জাজিরা ঘাটের মধ্যে) পদ্মা পারাপারের মাধ্যমে একটি সুদীর্ঘ যুগের অবসান হয়। পরদিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মাসেতুর উদ্বোধন করেন। সে-দেশের অর্ধশতকের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ যোগাযোগ প্রকল্পটি চালু হতেই ফুরিয়ে গেল এই সমস্যাসঙ্কুল ফেরি সার্ভিসের প্রয়োজন। এই সেতুর মাধ্যমে সড়ক ও রেলপথে ওপার বাংলার দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ নিশ্চিত হল। অত্যন্ত চওড়া ও খরস্রোতা নদীর বুকে এমন একটি সেতু নির্মাণের স্বপ্ন অতীতে অনেকে দেখেও তা রূপায়ণের বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন। মস্ত সমস্যা ছিল অর্থের। একটি উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে ৩০-৩১ হাজার কোটি টাকা জোগাড় করা চাট্টিখানি কথা নয়। সমস্যা আরও গভীর হয় বিশ্ব ব্যাঙ্কসহ একাধিক বিদেশি ঋণদান সংস্থা বিমুখ হওয়ায়। শেষমেশ ২০১২ সালে হাসিনা ‘দেশের অর্থে দেশের সেতু’ নির্মাণের সঙ্কল্প ঘোষণা করেন। কাজ শুরু হয় ২০১৪-য়। ৬.১৫ কিমি দীর্ঘ দোতলা সেতুটি চালু হল সম্প্রতি। পদ্মাসেতু শুধু বাংলাদেশের গর্ব নয়, গোটা উপমহাদেশের জন্যও একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। অর্থনীতিবিদদের আশা, এই সেতুই এখন সে-দেশের আর্থিক বিকাশের একটি উল্লেখযোগ্য হাতিয়ার। নদীমাতৃক দেশের অভ্যন্তরীণ যাতায়াত ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আসার পাশাপাশি, সুগম হবে কলকাতা ও ঢাকার মধ্যে যোগাযোগ। সুযোগটি ভারত ছাপিয়ে নেপাল ও ভুটান অব্দি পৌঁছে যাবে। ফলে বাণিজ্য বৃদ্ধির সুবিধা পাবে একত্রে চার চারটি দেশ।
বাংলাদেশের ধারাবাহিক আর্থিক শ্রীবৃদ্ধির লক্ষণ হাসিনা জমানাতেই স্পষ্ট হয়েছে। যে দেশকে অনেক রাষ্ট্র এই সেদিন পর্যন্ত করুণার দৃষ্টিতে দেখত, তারাই এখন সমীহ করে। আর এখানেই প্রশ্ন, শুরুতেই কি মাথা ঘুরে গিয়েছে বাংলাদেশের বর্তমান শাসকদের? শ্রীবৃদ্ধি সবসময়ই উদযাপনের অনুষঙ্গ। আনন্দ উদযাপন তখনই সার্থক হয়, যখন তাতে নিশ্চিত হয় প্রত্যেকের সমান অধিকার ও অংশগ্রহণ। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে বাংলাদেশের নানা স্থানে হিন্দুসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার নিপীড়ন বৃদ্ধির খবর কিন্তু বিপরীত সাক্ষ্য দিচ্ছে। কালো তালিকা লম্বা হচ্ছে ক্রমে—বরিশালের চকবাজার, চট্টগ্রামের কক্সবাজার, সীতাকুণ্ড, পটিয়া, নরিসিংদি, কুমিল্লা, সুনামগঞ্জ, মোংলা, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নড়াইল, ...। হিন্দু, বৌদ্ধ ও আদিবাসীদের জমি ও অন্যান্য সম্পত্তি কেড়ে নেওয়ার ফন্দিটা পুরনো। তাতে নতুন সংযোজন হল ‘ইসলামের অবমাননা’। কোথাও হিন্দুমন্দিরে হনুমানের পায়ের কাছে কোরান ‘আবিষ্কৃত’ হচ্ছে! একই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে কোথাও হিন্দু কলেজ ছাত্রের নামে নতুন ফেক অ্যাকাউন্ট খুলেই ফেসবুক মারফত ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ইসলাম-বিদ্বেষী কিছু মন্তব্য, আবার কোথাও শিক্ষক-অধ্যাপকের মুখে আপত্তিকর কথা বসিয়ে দিয়ে তাঁদের শাস্তির দাবিতে সরব হচ্ছে উন্মত্ত মৌলবাদীরা। এই ধুয়োর শিকার এখন হিন্দু ছাত্র-শিক্ষক-অধ্যাপকরাই সবচেয়ে বেশি। অথচ পূর্ববঙ্গের শিক্ষার উন্নয়নে হিন্দুদের অবদান অনস্বীকার্য। সম্প্রতি এক অধ্যক্ষের গলায় জুতোর মালা পরিয়ে তাঁকে কলেজ চত্বরে ঘোরানো হয়। অভিযোগ, এই পরিকল্পিত বর্বরতা সংঘটিত হয় পুলিসের সামনেই! নীলফামারিতে এক স্কুলশিক্ষককে চরমভাবে হেনস্তার পর চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়। তাঁর ফাঁসির দাবিতেও সরব এখন ধর্ম ব্যবসায়ীদের দল। আর এই মুহূর্তে নড়াইলের হিন্দুদের বেঁচে থাকাই দায় হয়ে উঠেছে। স্থানীয় হিন্দুদের অভিযোগ, সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে বহু হিন্দুর বাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন ধরানো হয়েছে। অথচ একাত্তরেও তাঁরা দেশ ছাড়ার কথা ভাবেননি।
সবচেয়ে অবাক ব্যাপার, বেশিরভাগ সাম্প্রদায়িক হিংসার পিছনে সে-দেশের শাসক দল আওয়ামি লিগের কিছু নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধেই আঙুল উঠেছে। অথচ বিএনপি, জামাত প্রভৃতি বিরোধী দল মনে করে, হিন্দুরা হাসিনার ভোটব্যাঙ্ক। তাদের এই অনুমান বহুলাংশে সত্যও—মনে করেন ভোটপণ্ডিতরা। এই বাংলাদেশ কি স্বাধীনতালাভ এবং উন্নয়নে হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের অবদান আর স্বীকার করে না? ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করার সঙ্গে সঙ্গেই সে সংশয় নিজগুণেই দূর হয়নি কি? তাই আজকের বড় জিজ্ঞাসা, হিন্দুসহ বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা তাহলে যাবেন কার কাছে? ৭৫ বছরে পূর্ববঙ্গের বেশিরভাগ হিন্দু ভারতের নানা জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন শরণার্থী হিসেবে। সবচেয়ে বেশি মানুষ সীমান্ত পেরিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের পর। অথচ, উল্টোটাই হওয়ার কথা ছিল। হাসিনা জমানায় সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার একটু কমেছিল বটে, দুর্ভাগ্য যে তা ফের পূর্ববৎ! তাই অনেকে বলছেন, দুর্গাপুজোর সময় লোক দেখানো পুলিসি প্রহরা ও সরকারি অনুদানের প্রয়োজন নেই, শুধু শাসক দলের ছাত্র-যুবরা কথা দিক যে তারা সংখ্যালঘু পীড়নের কারণ হবে না। এই প্রসঙ্গে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের কথা যত কম বলা যায় তত ভালো।
অধিকাংশ ভারতবাসী নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের (সিএএ) বিরোধী। কিন্তু বাংলাদেশসহ সমগ্র উপমহাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি সিএএ-র প্রাসঙ্গিকতা বাড়িয়ে দিচ্ছে না কি? রাষ্ট্রসঙ্ঘ ‘শরণার্থী’-র যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে এবং স্বাধীনতার উষালগ্নে শরণার্থীদের প্রতি গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল, ত্যাগী (নেহরুর পুনর্বাসনমন্ত্রী) প্রমুখ জাতীয় নেতৃত্বের প্রতিশ্রুতি এবং এআইসিসি-র তৎকালীন (১৫.১১.১৯৪৭) প্রস্তাব কার্যকর করার দাবি ফের জোরালো হলে কোন মানবিক মুখ তা নস্যাৎ করতে পারবে? বোঝা দরকার যে, ভারতের একার পক্ষে তার ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র আবহমানকাল অক্ষুণ্ণ রাখা কঠিন হতে পারে। ১৯৪৭-এ ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত ভারতের বাকি দুটি অংশের দায়িত্বও সমান। জলের মতো এই সত্যটি এখনও উপেক্ষিত হলে ভারতজুড়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের ঠেকানো একসময় অসাধ্য হতে পারে। তাতে নিশ্চিতভাবেই ধূলিসাৎ হবে ভারত, বাংলাদেশসহ গোটা উপমহাদেশের অগ্রগতির স্বপ্ন।