পি চিদম্বরম: প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, একটি আইকনিক পোস্টার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছেয়ে গিয়েছিল: তাতে লেখা ছিল ‘আই ওয়ান্ট ইউ—ফর ইউএস আর্মি’। আর এই লেখাটির উপরে থাকত মাথায় টুপি পরিহিত এক ব্যক্তির ছবি, যাকে ভালোবেসে আঙ্কেল স্যাম ডাকা হতো। ভারত সরকারও প্রতিরক্ষা বাহিনীতে সৈন্য নিয়োগের ক্ষেত্রে তার নতুন পরিকল্পনার প্রচারের জন্য অনুরূপ পোস্টার ব্যবহারের চেষ্টা করতে পারে। তবে, তার সঙ্গে ক্ষুদ্র অক্ষরে ছাপা একটি লাইন যোগ করার প্রয়োজন হতে পারে, ‘দর্জি, ধোপা বা নাপিত হওয়ার জন্য।’
অগ্নিপথ নামক স্কিমটি সহজ, আসলে, খুবই সহজ। প্রতিরক্ষা বিভাগের তিনটি বাহিনীতে প্রতি বছর ৪৬ হাজার সৈন্য নিয়োগ করা হবে। তাঁদের ছ’মাসের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এবং মোতায়েন করা হবে ৪২ মাসের জন্য। ৪৮ মাস শেষে, চারভাগের একভাগ প্রশিক্ষিত সেনাকে বহাল রাখা হবে আরও ১১-১৩ বছরের জন্য এবং বাকি প্রায় ৩৪,৫০০ জনকে ছাঁটাই করা হবে প্রত্যেকের হাতে ১১ লক্ষ ৬৭ হাজার টাকা বরখাস্ত-ভাতা ধরিয়ে দিয়ে। এরপর তাঁদের জন্য কোনওরকম চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে না, থাকবে না পেনশন, গ্র্যাচুইটি এবং চিকিৎসা বা অন্যান্য কোনও সুবিধাও।
প্রথমে কাজ করুন, পরে ভাবুন
স্কিমটির নেতিবাচক দিকগুলি বেশ প্রকট এবং সুস্পষ্ট। সংগত অনুমান এই যে নিয়োগের এই আইডিয়াটি ‘সর্বোচ্চ’ মহল থেকে আরোপিত। ২০১৪ সাল থেকে এই সরকার এভাবেই কাজ করেছে। অতীত দৃষ্টান্তগুলির মধ্যে রয়েছে বিমুদ্রাকরণ, রাফাল চুক্তি, জমি অধিগ্রহণ আইনের সংশোধনী (এলএআরআর আইন) এবং তিনটি কৃষি আইন।
পূর্বানুমান মতোই প্রতিবাদ হয়েছে। প্রতিবাদীদের বেশিরভাগই যুবক। ডিফেন্স ফোর্সগুলিতে রেগুলার রিক্রুটমেন্টের জন্য তাঁরা প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে প্রস্তুত হয়েছিলেন, অথচ মহামারীর কারণে সেই পরীক্ষা একাধিকবার পিছিয়ে গিয়েছিল। অগ্নিপথের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ বয়সীমা ২১ বছর হয়তো তাঁদের অনেকেরই পেরিয়ে গিয়েছে। প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ার পরদিনই সরকার কিছু ছোটখাট পরিবর্তন ঘোষণা করতে শুরু করে এবং লজ্জার মাথা খেয়ে পরিবর্তনগুলিকে ‘পূর্বপরিকল্পিত’ আখ্যা দেয়। তবে তাতে অগ্নিপথের মূল আপত্তিগুলির কিছুই মান্যতা পায়নি:
প্রথমত, সময়। সমগ্র সীমান্তে নিরাপত্তা পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং সেখানে আগ্রাসন (চীনের) এবং অনুপ্রবেশের (পাকিস্তানের) কোনও শেষ নেই। রোদ থাকাকালেই ছাদ ঠিকঠাক করে নেওয়া জরুরি, বৃষ্টিপাতের সময় তা করা চলে না।
দ্বিতীয়ত, অগ্নিবীররা পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পাবেন না এবং ফ্রন্টলাইনে তাঁদের মোতায়েন করা যাবে না। অ্যাডমিরাল অরুণ প্রকাশ একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে, স্বাভাবিক নিয়মে নিযুক্ত সেনাদের পাঁচ-ছ’বছরের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এছাড়া নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী ক্রমে বেশি করে প্রযুক্তি-নির্ভর হচ্ছে। অতএব, কোনও নৌসেনা বা বায়ুসেনাকে ছ’মাসের প্রশিক্ষণে গড়ে নেওয়া সম্ভব নয়। লেফটেন্যান্ট জেনারেল পি আর শঙ্কর পদাতিক বাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেল হিসেবে অবসর নিয়েছেন। তথ্যে পরিপূর্ণ এক নিবন্ধে তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে, অগ্নিপথ প্রকল্পটি সম্পূর্ণরূপে চালু হওয়ার পর ভারতীয় সেনাবাহিনী ব্রহ্মোস, পিনাক বা বজ্রের মতো ‘ওয়েপন সিস্টেম’ পরিচালনা করতে অক্ষম সৈন্যে অথবা গোলন্দাজে কিংবা সেকেন্ড-ইন-কমান্ডে (2iC বা ডেপুটি কমান্ডার) ভরে থাকবে। তিনি নামকরণ করেছেন কিন্ডারগার্টেন আর্মি!
তৃতীয়ত, বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ডিফেন্স অফিসার উল্লেখ করেছেন যে, একজন লড়াকু সৈনিককে তাঁর ইউনিট নিয়ে অবশ্যই গর্বিত হতে হবে, তিনি ঝুঁকি-বিমুখ হবেন না এবং একটি সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা-ক্ষমতা তাঁর থাকতে হবে। উপর্যুক্ত গুণাবলি মাস ছয়েকের প্রশিক্ষণেই আত্মস্থ করা সম্ভব—মানবসম্পদ বিষয়ক কোনও পাঠ্যবই এই কথা বলে না। একজন পুলিস কনস্টেবলের ট্রেনিংয়ের জন্যও এর থেকে বেশি সময় লাগে।
চতুর্থত, প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলির মধ্যে, বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে একটি ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি রয়েছে। একজন সৈনিককে তাঁর দেশ এবং সহযোদ্ধদের স্বার্থে মৃত্যুবরণের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। রেজিমেন্টাল সিস্টেম প্রাচীনকালের ব্যাপার হতে পারে, কিন্তু এটাই ইন্ডিয়ান আর্মিকে বিশ্বের সেরা ফাইটিং ফোর্সগুলির অন্যতম করে তুলেছে। চার বছরের দায়িত্ব পালনের সময়, অগ্নিবীররা জানবেন যে মেয়াদ শেষে তাঁদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ অসুখী প্রাক্তন সৈনিক হয়ে যাবেন কিন্তু ‘এক্স-সার্ভিসম্যান’-এর মর্যাদা পাবেন না এবং হবেন আর্থিক নিরাপত্তাহীনতার শিকার। চার বছরে এই ধরনের সৈন্যদের মধ্যে কি সৌহার্দ্য অথবা শত্রুতার সম্পর্ক থাকবে? আপনি কীভাবে আশা করতে পারেন যে, এই ধরনের সৈন্যরা প্রয়োজনে চূড়ান্ত আত্মত্যাগই করবেন?
পঞ্চমত, অর্থনীতির স্বার্থে গুণমান, দক্ষতা এবং কার্যকারিতা ‘স্যাকরিফাইস’ করার পরিণতিটা কল্পনা করুন। ক্রমে বেড়ে যাওয়া পেনশন বিল সত্যিই একটি সমস্যা। কিন্তু এর পরীক্ষিত বিকল্প মডেলগুলি যে যাচাই করা হয়েছে তারও কোনও প্রমাণ নেই। অগ্নিপথ মডেলটি ইজারায়েলে চালাবার চেষ্টা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে বলে যে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তা নিতান্তই ছেলেমানুষি। ইজারায়েলের জনসংখ্যা সামান্য। সেখানে বাস্তবিক কোনও বেকারত্ব নেই। এছাড়া সে-দেশের যুবদের জন্য মিলিটারি সার্ভিস বাধ্যতামূলক। তিন বাহিনীতে নিয়োগের একমাত্র পন্থা করার আগে, অগ্নিপথকে কেন ‘পাইলট’ হিসেবে যাচাই করে নেওয়া হয়নি? সেনাবাহিনীর ভাইস চিফ জেনারেল রাজু এখন বলছেন যে, অগ্নিপথ একটি ‘পাইলট’ স্কিম, যেটি চার-পাঁচ বছর পরে কিছু উন্নতি-সহ খাপ খেয়ে যাবে!
একটি চুক্তিভিত্তিক বাহিনী?
সরকার যেসব তথাকথিত পরিবর্তন করেছে এবং কিছু ছাড় দিয়েছে তা থেকে এই মৌলিক প্রশ্নের উত্তর মিলছে না যে, যৎসামান্য-প্রশিক্ষিত, নামমাত্র অনুপ্রাণিত এবং মূলত চুক্তিভিত্তিক প্রতিরক্ষা বাহিনী দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ভীষণভাবে দুর্বল করে দেবে কি না। কর্মচ্যুত অগ্নিবীরদের জন্য কেন্দ্রীয় সশস্ত্র পুলিস বাহিনী (সিএপিএফ), প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কেন্দ্রীয় সরকার অধিগৃহীত সংস্থায় (সিপিএসইউ) ১০ শতাংশ চাকরি সংরক্ষণ—এই প্রশ্নের কোনও উত্তর নয়। ডিজি, রিসেটেলমেন্টের মতে (দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২১ জুন, ২০২২ থেকে উদ্ধৃত), প্রাক্তন সৈন্যদের জন্য বর্তমানে গ্রুপ সি পদে ১০-১৪.৫ শতাংশ এবং গ্রুপ ডি পদে ২০-২৪.৫ শতাংশ সংরক্ষণের জায়গায়, প্রকৃত নিযুক্তদের হিসেব এইরকম—গ্রুপ সি পদে ১.২৯ (বা তার কম) শতাংশ এবং গ্রুপ ডি পদে ২.৬৬ (বা তার কম) শতাংশ।
প্রতিরক্ষা বাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে পরিবর্তন-সংশোধন প্রয়োজন হলে, উপায় ছিল—একটি স্টেটাস পেপার প্রকাশ করা, ইস্যুগুলির তালিকা তৈরি করা, বিকল্প সমাধান খোঁজা, বিষয়টি সংসদের স্ট্যান্ডিং কমিটিতে আলোচনা, সংসদে বিতর্ক আহ্বান এবং একটি আইন প্রণয়ন অথবা একটি স্কিম তৈরি করা। ত্রুটিপূর্ণ ভাবনার ফসল অগ্নিপথ প্রকল্পটি অবশ্যই প্রত্যাহার করতে হবে এবং সরকারকে এগতে হবে একেবারে নতুন প্ল্যান নিয়ে।
লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত