বছর তিনেক আগে তিনি যখন বিদেশসচিবের পদ থেকে অবসর নিয়েছিলেন, তখনও দেশবাসীর কাছে তাঁর পরিবার নিয়েই আগ্রহ ছিল বেশি। সুব্রহ্মণ্যম পরিবারে রয়েছে ব্রাহ্মণ্য পাণ্ডিত্য ও যুদ্ধবৃত্তির মিশ্রণ। তাঁর ভাই সঞ্জয় সুব্রহ্মণ্যম ইতিহাসবিদ। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস-এর অধ্যাপক। বাবা কে সুব্রহ্মণ্যমকে বলা হয় ভারতের ‘পারমাণবিক রণনীতির স্থপতি’। স্ট্র্যাটেজিক বিজ্ঞানের পণ্ডিত। তাঁর সমর্থন না থাকলে ১৯৯৮ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ির পক্ষে ‘পোখরান-২’ পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা করা সম্ভব হতো না। একদিকে তখন নড়বড়ে জোট সরকার, অন্যদিকে বিশ্বশক্তি খেপিয়ে তোলার ভয়। বাজপেয়ির পাশে তখন চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়েছিলেন কে সুব্রহ্মণ্যম। পোখরান-২’এর সমর্থনে সুব্রহ্মণ্যম দেশে-বিদেশে বিতর্কের আসর মাত করে দিয়েছিলেন।
জয়শঙ্কর রাজনীতির ময়দানে নেমেছেন সরাসরি। বিদেশসচিবের পদ থেকে অবসর নিয়ে বছর না ঘুরতেই তাঁর বিজেপিতে যোগদান এবং গুজরাত থেকে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়ে একেবারে বিদেশমন্ত্রী। ভারতের বিদেশনীতির স্তম্ভ। ফেলোশিপের জন্য দীর্ঘদিন আমেরিকায় থেকেছেন তাঁর বাবা। ফলে বাবার একটি বড় প্রভাব পড়েছে তাঁর জীবনেও। জয়শঙ্করের কথায়, ‘পারিবারিক পরিবেশ আমার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে আগ্রহ তৈরি করেছে। বিদেশের প্রতি আমার আগ্রহ তৈরি হয়েছে সঙ্গীতচর্চা থেকে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গীতচর্চার মাধ্যমে সেই দেশের শেকড় সম্পর্ক জানার আগ্রহ বাড়ে। ১৯৫৯ সালে প্রথম মার্কিন অ্যালবাম শুনেছিলাম। নাম ছিল হিটমেকার্স। এখনও মাঝে মধ্যে সময় পেলেই ওই অ্যালবামের গানগুলি শুনি। এটা আমার কাছে নস্টালজিয়ার মতো। ১৯৬০-৭০ সালের গানের কথা শুনলে প্রাগৈতিহাসিক মনে হতে পারে, তবে ওই সময় থেকেই ধীরে ধীরে গ্লোবালাইজেশনের ধারণা শুরু হয়েছিল। একাধিক দেশভ্রমণ, সেই দেশগুলির সংস্কৃতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা আমার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রত্যেকবার কোনও নির্দিষ্ট কাজে মনোনিবেশ করার আগে আমি এমনই একাধিক বিষয় নিয়ে ডুবে থাকি। বলা যায় না, এমনই কোনও একটা বিষয় ঘাঁটতে ঘাঁটতেই নয়া কোনও তথ্য মিলে যেতে পারে।’
কূটনীতিক হিসেবে ভারতের বিদেশমন্ত্রীকে ১০০-তে ১০০ নম্বর দেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা। তাঁর বিদেশনীতি এবং কূটনৈতিক কৌশল গোটা বিশ্বে একবাক্যে প্রশংসিত। নেটিজেনদের মতে, কাশ্মীর ইস্যুতে মার্কিন সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহামকে দেওয়া জয়শঙ্করের জবাব এখনও পর্যন্ত অন্যতম সেরা উক্তি। সেবার মার্কিন সিনেটর মন্তব্য করেছিলেন, ‘কাশ্মীরের প্রসঙ্গ উঠলে আমি জানি না, দু’টি গণতান্ত্রিক দেশ এটা কীভাবে শেষ করবে। তবে আমাদের দায়িত্ব এটা যাতে শেষ হয় তা নিশ্চিত করা।’ জবাবে ভারতের প্রতিনিধি জয়শঙ্কর বলেছিলেন, ‘আপনি চিন্তা করবেন না সিনেটর। একটা দেশই এটা শেষ করতে পারবে আর আপনি জানেন সেটা কোন দেশ হতে পারে।’ সম্প্রতি রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ তো বলেই ফেলেছেন, ‘জয়শঙ্কর দুঁদে কূটনীতিকই নন, একজন প্রকৃত দেশপ্রেমী।’
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে ভারতের অবস্থান কী? দীর্ঘ তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে এই প্রশ্ন বারবার উঠেছে। যুদ্ধ নিয়ে ভারত কেন নিশ্চুপ? এমন আঙুলও উঠেছে একাধিকবার। অনেকেই বলছেন, জয়শঙ্করের হাত ধরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রুশ-ইউক্রেন প্রশ্নে চাচা নেহরুর চটিতেই পা গলিয়ে ফেলেছেন। নেহরুর সোভিয়েত প্রেম, ভাঙা সোভিয়েতের রাশিয়ার প্রতি তাই-ই দেখিয়ে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। একদিকে আমেরিকার চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে রাষ্ট্রসঙ্ঘে রাশিয়া বিরোধী প্রস্তাবে বারবার ভোটদান থেকে বিরত থাকা। অন্যদিকে, বিভিন্ন মঞ্চে অবিলম্বে হিংসা বন্ধের আবেদন করে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগোলিক অখণ্ডতার জয়গান করা। শ্যাম এবং কুল রাখতে চাওয়া বিদেশনীতি এখনও পর্যন্ত চালিয়ে যাচ্ছে নয়াদিল্লি। সরকারের সেই ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিদেশমন্ত্রী বলেছেন, ‘তবে এর মানে এই নয়, অন্যদেশের সঙ্গে মতবিরোধ ঘটার সম্ভাবনা এড়াতে আমরা বেড়ার উপর বসে রয়েছি। আমরা নিজেদের মাটিতেই রয়েছি।’
চলতি জুনের প্রথম সপ্তাহে দু’টি ঘটনা ঘটেছে। এর একটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভারতের বিদেশনীতিকে সামনে এনেছে। আরেকটি ভারতের অভ্যন্তরে ক্রমাগত বাড়তে থাকা বিষাক্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতির চোরা খানাখন্দকে প্রকাশ্যে এনে ফেলেছে।
স্লোভাকিয়ার ব্রাতিস্লাভাতে অনুষ্ঠিত গ্লোবসেক ২০২২ ফোরামের ফাঁকে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। সাক্ষাৎকারটিতে ইউক্রেন যুদ্ধে ভারত কেন কোনও পক্ষ বেছে নিল না, সেই বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছিল। জয়শঙ্কর তাতে যা বলেছেন, তাতে ভারতীয় বিদেশনীতির পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত হয়েছে। জয়শঙ্করের প্রতিক্রিয়া এত জোরালোভাবে অনুরণিত হয়েছে যে, তা শুধু ভারতে নয়, ইউরোপ এবং অন্যান্য অনেক দেশেও অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় ভাইরাল হয়েছে। কিছু আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক রসিকতার সুরে একে ‘ভারতের সাবালকত্বের মুহূর্ত’ বলতেও ছাড়েননি।
জয়শঙ্কর সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে ভারত। যে কোনও একটি পক্ষ বেছে নেওয়ার জন্য ইউরোপীয় দেশগুলি বারবার ভারতকে চাপ দিয়ে এসেছে। কিন্তু নিজের অবস্থান থেকে সরেনি ভারত। কিছু দেশ হয়তো ভারতের বিদেশনীতি পছন্দ করে না, কিন্তু তাতেও কূটনৈতিক দিক থেকে সমস্যায় পড়ছে না ভারত। বরং বিশ্বের অন্যান্য দেশের সমস্যার প্রতি ইউরোপীয় দেশগুলির দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো দরকার। আমরা দড়ির উপর হাঁটছি না। ইউরোপীয় দেশগুলি মনে করে, ইউরোপের সমস্যাই বিশ্বের সমস্যা। কিন্তু নানা প্রান্তে আরও অনেক জটিলতা রয়েছে, সেগুলি নিয়ে একটুও চিন্তিত নয় ইউরোপ। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। আজকের বাস্তবতা, ইউরোপের সমস্যা ইউরোপের কাছে, বাকি বিশ্বের সমস্যা বাকি বিশ্বের কাছে। বিশ্ব এখন আর আগের মতো ইউরোপকেন্দ্রিক নয়।
রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণে অশোধিত তেল কেনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন সাংবাদিকরা। তাঁদের অভিযোগ ছিল, রাশিয়াকে আর্থিকভাবে সাহায্য করছে ভারত। জবাবে জয়শঙ্কর বলেছেন, ‘তাহলে তো রাশিয়া থেকে গ্যাস কেনা মানে আর্থিক সহায়তা করা। অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশ রুশ গ্যাসের উপর নির্ভরশীল। তাদের দিকে আঙুল উঠছে না কেন? আপনারা যদি রাশিয়া থেকে তেল কেনার বিষয়ে তাকান, তাহলে আমি পরামর্শ দেব, আপনারা ইউরোপের দিকে নজর দিন। আমরা একমাসে যে পরিমাণ তেল কিনি, তা এক বিকেলেই কেনে ইউরোপ।’ অর্থাৎ, ইটের বদলে পাটকেল।
জয়শঙ্করের সেদিনে বক্তব্যে ছিল স্পষ্ট আত্মবিশ্বাস ও প্রতিবাদ। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ছিল, জয়শঙ্করের মন্তব্য মুসলিম প্রধান কিছু দেশকেও মুগ্ধ করেছিল। ইরানি এবং আরবরা তো তাদের নিজস্ব ভাষায় সাবটাইটেল করা ওই সাক্ষাৎকারের ভিডিও ক্লিপ সোশ্যাল মিডিয়ায় চালচালি করেছে। ভারতের এই স্পষ্টবাদী বিদেশনীতির জন্য বিশ্বজুড়ে যখন করতালি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, ঠিক তখনই ক্ষমতাসীন বিজেপির দুই মুখপাত্রের মুখে উচ্চারিত মহানবী সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য সব ওলট–পালট করে দিয়েছে। এক লহমায় মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে জয়শঙ্করের সাফল্য।
কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি নেতারা যে সংখ্যাগুরুদের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষ ছড়িয়ে ভোটে ফায়দা তুলতে মরিয়া, তা তারা আরও একবার স্পষ্ট দিয়েছে। এর আগে বহুবার মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য রেখে বিজেপির নেতারা পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার চেষ্টা করেছেন। তবে এবারের আক্রমণ একেবারে সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। ফলে মুসলিম দেশগুলির ক্ষোভে ফেটে পড়তে সময় লাগেনি। উপসাগরীয় চারটি দেশসহ ন’টি মুসলিম দেশ ভারতীয় রাষ্ট্রদূতদের তলব করেছে। তাঁদের ভর্ৎসনা করেছে অভিযুক্তদের শাস্তির দাবি করেছে। ভারতের উপরাষ্ট্রপতির পূর্বনির্ধারিত আনুষ্ঠানিক মধ্যাহ্নভোজ বাতিল করেছে কাতার সরকার। অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি) তাৎক্ষণিকভাবে এর নিন্দা করেছে এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘকে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন শুরু হয়েছে এবং উপসাগরীয় দেশগুলিতে কর্মরত কিছু ভারতীয়কে চাকরি খোয়াতে হয়েছে। আশি লাখ ভারতীয় প্রবাসী কর্মী এসব দেশে কাজ করেন এবং তাঁদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার উপর ভারতের অর্থনীতি অনেকখানি নির্ভর করে।
এই ঘটনা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের ইসলামবিদ্বেষী চেহারাকে তুলে ধরেছে এবং মুসলিম বিশ্বে ভারতের অবস্থানের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। খোদ আমেরিকাও ভারতের নিন্দা করতে ছাড়েনি। সরকারের অষ্টম বর্ষপূর্তিতে চেনা সুর, লয় ও ছন্দের পতন যে এভাবে হতে পারে, ভারতের মোদি সম্ভবত তা ভাবেননি। কালি লেগেছে ভাবমূর্তিতে। প্রশ্ন জেগেছে তাঁর সদিচ্ছাকে ঘিরে। মুসলিম দেশগুলিকে শান্ত করতে বিজেপির অভিযুক্ত দুই মুখপাত্রকে তাঁদের পদ থেকে সরানো হয়েছে। তাঁদের একজনকে সাময়িক বরখাস্ত এবং অন্যজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে (অচিরেই তাঁরা পুরস্কার পেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না)। তাতেও ক্ষোভ কমেনি। আন্তর্জাতিক সমালোচনার চাপে বিজেপি এবং তার সহযোগীরা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার কুপথ থেকে সরে আসবে, তার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আরব দুনিয়ার ধনী ইসলামিক রাষ্ট্রগুলির চাপের ঠেলায় বিজেপি আপাতত বলছে, তাদের হৃদয় নাকি সমস্ত ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমদৃষ্টিতে টইটম্বুর! বিজেপির মুখপাত্রদের সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক মন্তব্যের জন্য গোটা বিশ্বে ভারত সরকারকে সাফাই দিতে হচ্ছে— বলতে হচ্ছে যে, পয়গম্বর সম্পর্কে বিজেপির নেতানেত্রীদের মন্তব্য ভারত সরকারের মন্তব্য নয়।
এমন আত্মসংশোধনের ‘তৎপরতা’ নিশ্চয়ই বিশ্বে নিন্দিত হওয়ার লজ্জায় বা অনুতাপে নয়। আন্তর্জাতিক কূটনীতির মঞ্চে, নিরাপত্তার পরিসরে এবং বিশ্ব বাজারে সমস্যা বাড়তে পারে— এই সত্যটি টের পেয়েই গেরুয়া শিবির পরিস্থিতি সামাল দিতে তৎপর হয়েছেন। বুঝেছেন, এখনই সাম্প্রদায়িতার বিষ ঢালা বিজেপি নেতাদের মুখ না বন্ধ করাতে পারলে ভারতকে অনেক বড় খেসারত দিতে হবে। দুঁদে কূটনীতিক জয়শঙ্করও নিশ্চিত জানেন, ওৎ পেতে রয়েছে ওয়াশিংটন, মার্কিন মিত্ররা।
তারা কিছুতেই রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধে ভারতের অবস্থান মেনে নেবে না!