বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

জনজীবন বিপর্যস্ত হলে
কার লাভ, কার ক্ষতি?
সমৃদ্ধ দত্ত

এই মাসেই আইপিএলের টেলিভিশন এবং ডিজিটাল রাইটস বিক্রি হয়েছে ৪৪ হাজার কোটি টাকায়। এই তো সেদিন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্লার্কশিপ পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশিত হল। বহু কর্মপ্রত্যাশীর কাছে সুসংবাদ এল। বহু যুবক-যুবতী হতাশও হলেন। তাঁরা আবার প্রাণপণে চেষ্টা করবেন পরবর্তী পরীক্ষার জন্য। এবার আসছে ডব্লুবিসিএস ক্যাডারের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা। দুরু দুরু বক্ষে ছেলেমেয়েরা এই শেষ মুহূর্তে জীবনপাত করে প্রস্তুতি নিচ্ছে হয়তো। পুরুলিয়ার কাইরা গ্রামের ভূমজি সম্প্রদায়ের গ্রামবাসীদের জীবনের সঙ্গে জড়িত একটি নদী। কংসাবতী। নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া। কারও কারও কাছে জাল নেই। আশ্চর্য দক্ষতায় তারা হাত দিয়েই মাছ ধরে। বিশেষ করে একমুঠো চিংড়ি মাছ উঠে আসে জলে হাত দিয়ে। অন্য সময় নাগপুর অথবা পাঞ্জাবে কখনও সখনও ঠিকাদাররা নিয়ে যায় কনস্ট্রাকশনের কাজ করাতে। আপাতত কয়েক বছর মাছও সেরকম নেই। বাইরে যাওয়ার ডাকও নেই। দাঁতে দাঁত চেপে তারা চেষ্টা করছে বিকল্প আর কী কী জীবিকায় প্রবেশ করা সম্ভব, সেই সন্ধানে। মাদুরকাঠি আসে পশ্চিম মেদিনীপুরের খাকুড়দা আর সবং থেকে। সুতো আসে রাধামণি বাজার থেকে। কাপড় নিয়ে আসতে হয় কলকাতার বড়বাজার থেকে। মেদিনীপুরের রামনগর কাঁথি এলাকার মাদুরশিল্পটি সাংঘাতিক সঙ্কটে পড়েছে। এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল খোলাবেড়িয়ার মাদুরশিল্পীদের কথা। প্রায় ২০০ পরিবার মাদুরশিল্পের উপর নির্ভরশীল তাদের সংসার চালানোর ক্ষেত্রে। কিন্তু লকডাউনের পর সেই যে ভাটা পড়লো জীবিকায়, আর ঘুরে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। বিদ্যুৎহীন, টিউশনহীন, দুবেলা পর্যাপ্ত খাবারহীন ছেলেমেয়েরা উচ্চ মাধ্যমিকে চমক লাগানো রেজাল্ট করছে। বিসিএস অফিসার অথবা অধ্যাপক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। 
এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা ও তথ্যগুলি তো কমবেশি আমাদের সকলেরই জানা। তাহলে আবার এখানে উত্থাপিত করার দরকার হল কেন? কারণ, একদিকে জীবন চলছে স্বাভাবিক নিয়মে। সুখ দুঃখকে সঙ্গে নিয়ে। আর অন্যদিকে, সমাজকে অস্থির করে দেওয়ার একটি প্রবল গোপন চক্রান্ত চলছে। হজরত মহম্মদের সম্পর্কে চরম নিন্দাসূচক মন্তব্য এবং তারপরই ৪৮ ঘণ্টা ধরে রেল অবরোধ, রাস্তা অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর আর পুলিসকে আক্রমণ করে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত করে দেওয়া। এই দুইই কি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অঙ্গ নয়? নূপূর শর্মা ওরকম মন্তব্য কেন করলেন? আর তারপরই মানুষকে বিপদে ফেলা আন্দোলন রাজ্যে রাজ্যে ছড়িয়ে গেল! কেন? কারা এই অবরোধ, সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ আর ইন্টারনেট হীন ৭২ ঘণ্টায় লাভবান হল? কারা ক্ষতিগ্রস্ত হল? জীবন তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলেছে। প্রতিদিন ধনী, দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত নিজেদের জীবিকা, শিক্ষা, পরিবারের সামান্য উন্নতির জন্য ছুটে চলেছে এই কাঠফাটা গরম উপেক্ষা করে। সকলের মনে একটি করে স্বপ্ন রয়েছে। সব কিছু একটি স্বাভাবিক নিয়মেই অগ্রসর হচ্ছে। আপনারা যে হাওড়া জেলা অচল করে দিলেন, সেই পথেই মল্লিকঘাটে ফুল নিয়ে আসে প্রতিদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলা মহিলার দল পাঁশকুড়া থেকে। এদের আপনারা চেনেন না? জানেন না বছরের পর বছর তাদের এই রুটিন? পাঁচলা, বাউরিয়ায় জরির কাজ লকডাউনের সময় কতটা ধাক্কা খেয়েছে সে সম্পর্কে আপনাদের ধারণা নেই? জানেন না নোটবাতিলের পর অন্তত ৭০০ এই জরি শিল্প ইউনিট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কয়েক হাজার নারী পুরুষকে অনাহার অর্ধাহারে ঠেলে দিয়ে। পশ্চিম চেঙ্গাইলের রমিশা বেগম বিনা চিকিৎসায় মারা যান সেকথা জানেন না? সমস্ত অর্ডার বাতিল হয়ে গিয়েছিল মুশিয়ার রহমানের। সেই আঘাত তিনি সহ্য করতে না পেরে স্ট্রোকে প্রাণ হারান। সেকথা জানেন? এমব্রয়ডারির কাজে সিদ্ধহস্ত কাজিপাড়ার শেখ কাশিম আলি সেই সময় কাজ হারানোয় দুবার হার্ট অ্যাটাকের সম্মুখীন হয়েছেন। নোটবাতিল ও করোনা মতো দুই কালান্তক ধাক্কার পর আবার খেটে খাওয়া মানুষ মরিয়া হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। সেদিনের ওই চরম দুর্দশা এবং দুর্ভোগ তৈরি করে এই সমাজের সামান্যতম উপকার করেছেন অবরোধকারীরা? বাংলার ব্যবসা বাণিজ্য শিক্ষায় অচলাবস্থা আসুক, এটা কারা চায়? কাদের লাভ? আপনারা কাদের সুবিধা করে দিচ্ছেন? ভাবুন! 
এখন আপনাদের ঠান্ডা মাথায় ভাবার সময় এসেছে যে, কেন আমরা এরকম করেছি? কাদের প্ররোচনায়? যারা আমাদের প্ররোচনা দেয় এভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত করে দিতে, তাদের কিছু অসুবিধা হয়েছে অবরোধ আন্দোলনের ফলে? তাদের নিজেদের ছেলেমেয়েরা কি এরকম আন্দোলনের সময় রাস্তায় নেমেছিল? রাজনীতি অথবা ধর্মীয় যে নেতারা এরকম আন্দোলন করতে বলেছিলেন, তাঁদের পরিবারের ছেলেমেয়েরা কে কোথায় পড়াশোনা করে? কোথায় চাকরি করছে? কোথায় থাকে? 
এরকম হাওড়া, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পার্কসার্কাসের সাধারণ দিন আনা দিন খাওয়া, জীবিকার জন্য হাহাকার করা জীবন কি কাটায়? নাকি বহাল তবিয়তে অন্য কোনও আধুনিক শহরে বাস করে? দেখবেন, তাদের জীবন সম্পূর্ণ মসৃণভাবে চলেছে। আপনাদের ধর্মীয় অনুভূতিকে, ক্রোধকে নিশ্চিতভাবে কেউ না কেউ ব্যবহার করছে বৃহত্তর স্বার্থে। কারা তারা?  ধর্মীয় নেতা? নাকি রাজনৈতিক নেতা? নাকি জোট বেঁধেছে দু পক্ষই! 
চক্রান্তটা ঠিক কোন প্রকৃতির? নয়ডার টেলিভিশন স্টুডিওর আলোচনায় এক বিজেপি মুখপাত্র হজরত মহম্মদের সম্পর্কে অসম্মানসূচক মন্তব্য করলেন। দেশবিদেশে প্রবল প্রতিবাদে কোণঠাসা  বিজেপি পর্যন্ত নিজেদের মুখপাত্রদের সাসপেন্ড এবং বহিষ্কার করল। এরপরও আন্দোলন করাই যায়। দাবি উঠতেই পারে যে, তাঁদের গ্রেপ্তার করতে হবে। খুবই স্বাভাবিক এই ক্রোধ। হিন্দু অথবা মুসলিম কোনও ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে বিন্দুমাত্র অসম্মান প্রদান করলেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত দরকার। তাহলেই সর্বস্তরে বার্তা যাবে যে, এসব সহ্য করা হবে না।  কিন্তু সেই দাবি ও আন্দোলন অন্য রাজ্যবাসীদের চরম বিপদে ফেলে করার এই সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপটির পিছনে কারণটি ঠিক কী? হঠাৎ কারা ঠিক একইদিনে গোটা দেশের বিভিন্ন শহরে একই ফরম্যাটের হিংসাত্মক বিক্ষোভ, অবরোধ, মানুষকে চরম বিপদে ফেলা আন্দোলনের কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নিল? কেন নিল? মানুষকে বিপদে ফেললে তারা বিরক্ত হবে। কাদের বিরুদ্ধে? যারা আন্দোলন করছে তাদের বিরুদ্ধে। আবার যে প্রশাসনের সামনে এসব ঘটছে, তাদের বিরুদ্ধেও বিরক্ত ও রাগ তৈরি হবে। যদি হয়, তাহলে রাজনৈতিক লাভ কোন কোন দলের হবে? ধর্মীয়ভাবেও কাদের মুনাফা হবে? এই সূক্ষ্ম বিশ্লেষণগুলি করতে হবে। দেশজুড়ে হঠাৎ করে সাধারণ গরিব পরিবারের হিন্দু ও মুসলিম পরিবারের ছেলেদের প্ররোচনা দিয়ে  রাস্তায় নামিয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত করে দেওয়া, মসজিদে শুকরের হাড় অথবা মন্দিরে গোরুর হাড় রেখে দিয়ে উত্তেজনা তৈরি করা হয় মাঝেমধ্যে। এসব কারা করছে? কী উদ্দেশ্যে করছে? সেটা বোঝা খুব কঠিন? তাহলে সেইসব ফাঁদে পা দিচ্ছেন কেন? আপনাদের কী লাভ হচ্ছে? হাওড়ায় লাগাতার ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রইল।  এর ফলে সবথেকে বিপদে পড়ে কারা? কোনও রাজনৈতিক নেতা? ধর্মীয় নেতা? নাকি অনলাইন ক্লাস করতে না পারা, পরীক্ষা দিতে না পারা, ট্রেন প্লেনের টিকিট কাটতে না পারা, প্রয়োজনীয় পেমেন্ট করতে না পারা, অফিস অথবা পড়াশোনার জন্য ডাউনলোড করতে না পারা লক্ষ লক্ষ মানুষ? করোনার বাড়াবাড়ি হলে কারা হাসপাতাল নার্সিংহোমে জায়গা পায় না? রাজনীতি অথবা ধর্মীয় নেতারা? নাকি আমরা? কারা অক্সিজেন পায়নি? সেদিন অবরোধে আটকে পড়ে ইন্টারভিউ মিস করে চাকরি হাতছাড়া অথবা বাউরিয়ার জরির অর্ডার মুম্বই পাঠাতে না পেরে কারা চরম দুর্ভোগে পড়ল? আমজনতা। আন্দোলনকারীদের উস্কানিদাতারা নয়। 
আমাদের মস্তিষ্ক হল একটি করে পার্সোনাল কম্পিউটার। নিজের শরীরের কম্পিউটার নিজেই প্রোগ্রামিং করুন। বাইরের কেউ নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে আপনার মগজ ধোলাই করবে, এটা কি সম্মানজনক? 

17th     June,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ