বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

চীনের দুর্নীতি আরও বেআব্রু
মৃণালকান্তি দাস

মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি ছিলেন ইরাক যুদ্ধের অন্যতম খলনায়ক। জর্জ বুশের ডান হাত। চৌ ইয়োং-খাং-কে বলা হতো ‘চীনের ডিক চেনি’। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক সংস্থা পলিটব্যুরোর স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেই চৌ ইয়োং-খাংয়ের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল তদন্ত। অভিযোগ, ক্ষমতা ব্যবহার করে চৌ শুধু শত-শত কোটি ডলার সম্পত্তির মালিকই হননি, তাঁর গোটা পরিবার দেশের তেল সম্পদের উপর একচেটিয়া দখল কায়েম করেছিল। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির রাঘব বোয়ালের দুর্নীতির তালিকা শুনে তাজ্জব বনে গিয়েছিল গোটা দুনিয়া। অথচ, এই চীনই তো কমিউনিস্টদের কাছে এ যুগে সমাজতন্ত্রের ‘স্বর্গ’!
সেখানে ঘুষ হিসেবে কেউ নেন সামুদ্রিক খাবারের বাক্সভর্তি মার্কিন ডলার। কেউ আবার প্রায় প্রতি মরশুমেই একের পর এক জমকালো বাড়ির মালিক হয়ে ওঠেন। কেউ আবার ভুয়ো কোম্পানি খুলে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেন। আর ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার আর বিপুল সম্পদের পাহাড় গড়ার অকপট ফিরিস্তি শোনান নির্লজ্জ সরকারি অফিসার, দেশের নেতাদেরই। ঘুষ, অবৈধ লেনদেন আর দুর্নীতির গল্পগুলি জানার পর আপনার মনে হতে পারে, গোটা চীন দেশটাই যেন দুর্নীতির ঘুঘুর বাসা!
সম্প্রতি দুর্নীতিবিরোধী একটি ধারাবাহিক তথ্যচিত্রে নিজেদের অপকর্মের কাহিনিগুলি তুলে ধরেছে চীনের সরকার। রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত এই তথ্যচিত্রে সরকারি অফিসারদের লাগামছাড়া দুর্নীতির বিবরণ উঠে এসেছে চীনের সরকারি অফিসার, নেতাদের স্বীকারোক্তিতে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ২০১৪ সাল থেকে দুর্নীতিবিরোধী প্রচার করতে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছে। তারই অষ্টম পর্ব জিরো টলারেন্স। উদ্দেশ্য চীনের প্রেসিডেন্ট জি জিনপিংয়ের দুর্নীতিবিরোধী প্রচারের সাফল্য তুলে ধরা। আর সেই সাফল্য তুলে ধরতে দিয়ে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছে ‘জিরো টলারেন্স’। তথ্যচিত্রটি দেখলে মনে হয়, দশকের পর দশক ক্ষমতায় থাকার পর চীনের কোণে কোণে ক্ষমতার লোভ, টাকার গন্ধ আর পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি জাঁকিয়ে বসেছে। আর সেই দুর্নীতিতে লাগাম টানতে কোনও পথ খুঁজে পায়নি চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। 
নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখছে, ‘জিরো টলারেন্স’-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালের নভেম্বরে জি জিনপিং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে দুর্নীতিসংক্রান্ত মামলায় প্রায় ৪৪ লক্ষ মানুষ তদন্তের মুখে পড়েছেন। খোদ কমিউনিস্ট পার্টির প্রায় ৪০ লক্ষ সদস্যকে সংশোধনের আওতায় আনা হয়েছে। তবে রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম ও পার্টির দুর্নীতিবিরোধী শাখা যে কমিউনিস্ট পার্টির নোংরা বিষয়গুলি প্রকাশ্যে এনে ফেলেছে, তা কেউ বুঝে উঠতে পারেননি। কখনও কখনও তথ্যচিত্রটিকে মনে হয়েছে রাজনীতি নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক অনুষ্ঠান। দুর্নীতি কীভাবে করা যায় এবং ক্ষমতাশালী অফিসাররা কীভাবে এতে জড়িয়েছেন, তার বিস্তারিত বিবরণ এখানে উঠে এসেছে। আর দলীয় নেতা ও আমলাতন্ত্রের তরফে ধনবান হওয়ার রুদ্ধশ্বাস প্রতিযোগিতায় বিপুল আর্থিক কেলেঙ্কারি, সরকারি সম্পদ হস্তগত করার অনাচার ক্রমশ চীনের আকাশকে মেঘাচ্ছন্ন করে তুলেছে। 
‘জিরো টলারেন্স’ জানাচ্ছে, চীনের সরকারি অফিসাররা অন্তহীন সুবিধা ভোগ করেন। খেয়ালখুশি মতো যে কোনও কাজে প্রশ্রয় পান। আর সুযোগ–সুবিধায় মোড়া এমন জীবনযাপন করেন, যা টাকাপয়সা দিয়ে কেনা যায় না। সান লিজুনের গল্প শুনলে আঁতকে উঠবেন। তাঁর উপর চীনের জাতীয় পুলিসবাহিনী দেখভালের দায়িত্ব ছিল। এক প্রাদেশিক পুলিস অফিসারের কাছ থেকে কীভাবে প্রতিবছর চার–পাঁচ বাক্স ‘সামুদ্রিক খাবার’ পেতেন, সেই ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে তথ্যচিত্রে। প্রতি বাক্সে তিন লাখ মার্কিন ডলার থাকত। এভাবে বছরের পর বছর ঘুষ নিয়ে দেড় কোটি ডলার পকেটে ভরেছেন এই অফিসার। সাক্ষাৎকারে হাসি মুখে সেই সান লিজুন জানিয়েছেন, ‘প্রতিবারই তিনি (প্রাদেশিক অফিসার) যখন বলতেন কিছু সামুদ্রিক খাবার পাঠাবেন, আমি জানতাম তাতে কী রয়েছে।’
ওয়াং ফুয়ু ছিলেন হুনান প্রদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ডেপুটি সেক্রেটারি। পরে গুইঝো প্রদেশেও একই দায়িত্ব পালন করেন। সেই নেতাকে ব্যবসায়ীরা একেক মরশুমের জন্য একেক শহরে বাড়ি কিনে দিয়েছিল। শীতকালে গ্রীষ্মপ্রধান হুনান দ্বীপে, গ্রীষ্মকালে গুইঝো মালভূমিতে, বসন্ত ও শরতে দক্ষিণের শহর শেনঝেনে। ওয়াং আবার গলফপ্রেমী। তাই একটি গলফ কোর্সেও অট্টালিকা ছিল তাঁর। যাতে ফটকের বাইরে পা রেখেই খেলায় মেতে উঠতে পারেন। ভিডিও ফুটেজে দেখা গিয়েছে, গলফের মাঠে তাঁর বিশাল অট্টালিকার দেওয়ালগুলি চীনা ক্যালিগ্রাফি দিয়ে সাজানো। সেখানে জনগণের প্রতি তিনি কতটা যত্নশীল ও অর্থ–খ্যাতির প্রতি তাঁর মোহ না থাকার কথা গর্ব করে লেখা।
‘জিরো টলারেন্স’ তথ্যচিত্রে স্পষ্ট, চীনের প্রশাসনের জটিল ব্যবস্থার কোথায়, কোন সুযোগে দুর্নীতি ঘটছে, তা চিহ্নিত করার এবং দৃঢ় হস্তে প্রতিকার করার কাজটিতে বহু ছিদ্র রয়ে গিয়েছে। সেই ছিদ্র দিয়েই এক-একজন নেতার রাজকীয় বাড়ি, টাকার পাহাড় তৈরি হয়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধের বিধিগুলি খণ্ডিত, বিকৃত প্রয়োগ হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা অসার নিয়মরক্ষায় পর্যবসিত হয়েছে। এই ব্যবস্থাই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে।
তথ্যচিত্রে এমন খোলামেলাভাবে সবকিছু সামনে আসায় চীনের অনেকেই দু’চোখ কচলাচ্ছেন। এ তো নাক কেটে যাত্রা ভঙ্গ! সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কেউ রসিকতা করে বলেছেন, তথ্যচিত্রটি দেখে মনে হয়েছে, সরকারি কর্মচারীরা কীভাবে ঘুষ নেবেন, তার একটি বিজ্ঞাপন। বজ্র আঁটুনির মধ্যেও বেসুরো হচ্ছেন নাগরিকদের একাংশ। ‘জিরো টলারেন্স’ তথ্যচিত্রে ১৬ জনের সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছে। ওয়াং ফুয়ু ও চেন গাংয়ের মতো বেশিরভাগ নেতাই এসব অপকর্ম করেছেন জি জিনপিং ক্ষমতায় আসার পর। বেড়েছে শাসক দলের ঔদ্ধত্য, ক্ষমতা দখলের আকাশচুম্বী ইচ্ছে, পেশিশক্তির প্রয়োগ— সবই।
রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত এই তথ্যচিত্রে দেখা গিয়েছে, সরকারি অফিসারের স্ত্রী, সন্তান ও ভাইবোনরাও সরাসরি ঘুষ নেন অথবা ভুয়ো কোম্পানি গঠনের মাধ্যমে সেই ঘুষ নেওয়ার পথ করে নিতেন। এমন অফিসারদের দুই ছেলে চীনের মঙ্গোলিয়া অঞ্চলে একটি কয়লা কোম্পানি গড়ে তুলেছিলেন। তবে সেই কোম্পানিতে কোনও কর্মী ছিল না। তাঁদের ‘কাজ’ ছিল শুধু কম দামে কয়লা কিনে বেশি দামে বিক্রি করার জন্য চুক্তিতে সই করা। সাক্ষাৎকারে ওই দুই ছেলেই স্বীকার করেছেন, ক্ষমতাধর বাবা না থাকলে তাঁরা এই সুযোগ আদৌ পেতেন না। ধরুন, চীনের হুনান প্রদেশের রাজধানী হাইকো নগরীর কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি ঝ্যাং কি-র কথাই। তিনি কানাডায় ছেলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। এই সফরে তাঁকে সঙ্গ দিয়েছিলেন একজন ব্যবসায়ী। ঝ্যাংয়ের ছেলের পিছনে তিনি ৮০ হাজার ডলার ঢেলেছিলেন। ওই ছেলে পরে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার নিয়েছিলেন। সেই অর্থ দিয়ে বিলাসবহুল গাড়ি কেনার পাশাপাশি ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছিলেন। ক্ষমতার জোরে তাঁদের পরিবার সব মিলিয়ে ১ কোটি ৭০ লক্ষ ডলার বেমালুম আত্মসাৎ করেছে। শুনলে অবাক হবেন, উত্তর–পূর্বাঞ্চলের লিয়াওনিং প্রদেশের প্রাক্তন ভাইস গভর্নর লিউ গুয়োকিয়াংয়ের নেওয়া ঘুষের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৫ কোটি ৫০ লক্ষ ডলার। এসবই নাকি হিমশৈলের চূড়া মাত্র।
গোটা ব্যবস্থাটিই যদি দুর্বৃত্তায়িত হয়ে পড়ে, তখন গাঁ উজাড় হওয়ার উপক্রম হয়। সেই কালি মুছতেই এখন নিজের ঢাক নিজে পেটাচ্ছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। এর আগে পার্টি প্রধান জি জিনপিং দুর্নীতির দায়ে যে-সব পার্টি-কর্মকর্তা ও আমলাকে বিচারের কাঠগড়ায় টেনে এনেছেন, তাঁরা নেহাতই চুনোপুঁটি। একই সঙ্গে কিছু ‘মাছি মারা’র পাশাপাশি কয়েকটি ‘শার্দূলকেও শিকার’ করতে শীর্ষ নেতৃত্ব বদ্ধপরিকর। তাই সামরিক কমিশনের সহ-সভাপতি, জাতীয় পেট্রলিয়াম নিগমের প্রধান, জাতীয় নিরাপত্তার বেজিং ব্যুরোর আধিকারিক কিংবা সরকারি টেলিভিশনের জনপ্রিয় তারকার পর আরও প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য পার্টি নেতাকে বিচারাধীন করা হয়েছে।
রাষ্ট্রনায়ক জিনপিং যে দল ও দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে ব্যগ্র, তাতে সংশয় নেই। তাঁর মতে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টিই ভবিষ্যতে অবান্তর ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, যদি এখনই দ্রুতবর্ধমান দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের প্রবণতা কঠোর হস্তে রোধ করা না যায়। কিন্তু দুর্নীতির উৎসে যাওয়ার চেষ্টা তিনি করেননি। বস্তুত, একদলীয় শাসনের স্বৈরাচারের মধ্যেই দুর্নীতির বীজ সুপ্ত থাকে। গণতন্ত্রে বহুদলীয় ব্যবস্থায় জনাদেশ নিয়ে শাসকদের ক্ষমতায় আসতে হয়, নির্বাচকমণ্ডলী বিরূপ হলে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকদের প্রত্যাখ্যাত হওয়ার শঙ্কাও বিলক্ষণ। জি জিনপিং চীনকে সেই বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যাবেন, সেই সম্ভাবনা নেই। ফলে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ারও শঙ্কা নেই। তিনি বড় জোর দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক ও আমলাদের একটি ক্ষুদ্র অংশকে তদন্ত ও বিচারের আওতায় আনবেন। তাঁদের জেলে ঢোকাবেন। এতে দলের ভিতর তাঁর প্রাধান্য আরও নিরঙ্কুশ হওয়ারই সম্ভাবনা।
শতবর্ষ পেরিয়ে আসা চীনের এই ‘দুর্নীতিগ্রস্ত বিজ্ঞাপন’ বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলির ক্ষতিই করবে, জি জিনপিংয়ের নয়! 

16th     June,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ