‘মসজিদে নামাজ শেষে বাবার বেরিয়ে আসার অপেক্ষায় বসে থাকত বহু মানুষ... নানা ধর্মের। তাদের হাতে থাকত জলের পাত্র। কাতর চাউনি ভরা চোখে বাবার দিকে সেই পাত্র এগিয়ে দিত তারা। অগাধ বিশ্বাস ছিল তাদের বাবার উপর। মনে করত, ওঁর ছোঁয়া জল খেলে কঠিন অসুখও সেরে যাবে। বাবা নিরাশ করতেন না। আঙুলগুলো ছুঁয়ে দিত সেই জলে... চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করতেন। আর মানুষও ফিরে যেত সেই বিশ্বাসের আধার সঙ্গে নিয়ে। মনে আছে, মাঝেমাঝেই আমাদের বাড়িতে আসত অজানা অচেনা বহু লোক। ধন্যবাদ জানাতে। ডাক্তার জবাব দিয়ে দেওয়ার পরও শুধু বাবার প্রার্থনায় সেরে ওঠার জন্য...।’
১৩৫ কোটি জনতা, প্রায় ১৯ হাজার মাতৃভাষা, নানা ধর্ম, বেশভূষা, সামাজিক আচার অনুষ্ঠান... এই অসীম সমুদ্রকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে একটি মাত্র শব্দ—বিশ্বাস। এই সহজ পাঠটুকু ছেলেবেলাতেই হয়ে গিয়েছিল আব্দুল কালামের। তাই জীবনের ওঠাপড়া খাতায় তোলার সময়ও মনটা ফিরে গিয়েছিল ছেলেবেলায়। বাবার স্মৃতি। জয়নুলআবদিন মারাকায়ার। রামেশ্বরমের স্থানীয় মসজিদের ইমাম। পড়াশোনা নেই, টাকা নেই... ছিল মনুষ্যত্ব! মানুষের প্রতি বিশ্বাস, আর অন্যের বিশ্বাসে আঘাত না দেওয়ার সাধারণ জ্ঞান। সেই ভাবনাটাই এক অক্ষয় ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল কালামকে।
মনে হতে পারে, হঠাৎ আব্দুল কালাম কেন? আসলে রাষ্ট্রপতি পদটা যখনই আমাদের মস্তিষ্কে আঘাত করে... মনে পড়ে দু’টি নাম। প্রথমজন রাজেন্দ্র প্রসাদ। কারণ ক্যুইজে প্রশ্ন আসে, স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতির নাম কী। আর দ্বিতীয়জন, এ পি জে আব্দুল কালাম। দেশের প্রথম মুসলিম রাষ্ট্রপতি, ভারতের সর্বকালের সেরা রকেট সায়েন্টিস্ট এবং জাতি-ধর্ম-রাজনীতি ছাপিয়ে একজন অসাধারণ মানুষ। রাষ্ট্রপতি কে হবেন, এই প্রশ্নটা মাথায় এলেই মুখ ভেসে ওঠে কালামের। রাষ্ট্রপতি নয়, কালামের উত্তরসূরি। আর তাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ খবর হওয়া উচিত ছিল রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। নির্ঘণ্ট ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। ১৮ জুলাই ভোট। কিন্তু কিছুতেই তা আর শিরোনামে আসতে পারছে না। কেন? সৌজন্যে নূপুর শর্মা। কে এই নূপুরদেবী? বিজেপির মুখপাত্র। হজরত মহম্মদকে নিয়ে তিনি আপত্তিকর কিছু মন্তব্য করেছেন। আর তারপর থেকেই দেশ উত্তাল। এফআইআর হয়েছে, প্রতিবাদ-বিক্ষোভও। তখনও ভারত সরকার তেমন একটা গা করেনি। ভাবটা এমন, এ তো কতই হয়। কিন্তু এড়িয়ে যাওয়া আর হল না। আরব দুনিয়ার দেশগুলি একে একে চেপে ধরতেই টনক নড়েছে। কারণ, এই দেশগুলি যদি বেঁকে বসে, সবার আগে টান পড়বে জ্বালানিতে। আর ভারতের কর্পোরেট রাজা-রাজড়াদের অধিকাংশেরই ব্যবসার সিংহভাগ চলে মধ্যপ্রাচ্যে। তাদের ব্যবসায় ঝাঁপ পড়লে অসন্তোষের ঢেউ আছড়ে পড়বে সরকারের উপর। সেটা মানিয়ে নাওয়া কিন্তু বেশ চাপের। তাই পদক্ষেপ নেওয়া হল—সাসপেন্ড নূপুর শর্মা।
লক্ষ করার মতো বিষয় হল, এরপর কিন্তু দেশজুড়ে বিক্ষোভের আঁচ বেড়েছে। এক সময়ে, এক প্যাটার্নে উত্তাল হয়েছে উলুবেড়িয়া, রাঁচি, প্রয়াগরাজ। স্থানীয় ইমামরা এসে বিক্ষোভকারীদের মাঝে দাঁড়িয়েছেন, অনুরোধ করেছেন... মানুষকে অসুবিধায় ফেলে, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করে প্রতিবাদ জানানোটা পদ্ধতি নয়। তাঁরা আর্জি জানাচ্ছেন... কিন্তু জমায়েতের অন্দর থেকে এরপরও চলছে উস্কানি। ফিসিফিসিয়ে। আদৌ কি এর পিছনে ধর্ম আছে? নাকি সবটাই রাজনীতি? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার বলছেন এর নেপথ্যে রাজনীতির কথা। বিরোধীরা একমত, ব্যর্থতা থেকে নজর ঘোরাতেই প্ল্যানমাফিক একটা উত্তেজনা তৈরি করা হচ্ছে। এর মাঝে চাপা পড়ে যাবে মূল্যবৃদ্ধি, প্রশাসনের গেরুয়াকরণ, বিরোধী নেতানেত্রীদের উপর এজেন্সির তড়পানি। যদি তা না-ই হতো, তাহলে এখনও কেন গ্রেপ্তার করা হয়নি নূপুর শর্মাকে? কেন তিনি গারদের বাইরে? এটাই তো বিক্ষোভকারীদের প্রধান দাবি—গ্রেপ্তার করতে হবে বিজেপির ওই মুখপাত্রকে। সাসপেনশনের ধোঁকাদারি চলবে না। এর থেকে অনেক কম অপরাধে... সোশ্যাল মিডিয়ায় নিরামিষ পোস্ট করার জন্যও গ্রেপ্তার হতে হয়েছে আম আদমিকে। তাঁদের কেউ ধর্মীয় বিভাজনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, আবার কেউ শুধু প্রশ্ন তুলেছিলেন আইন-প্রশাসনের দ্বিচারিতা নিয়ে। প্রধানমন্ত্রীর নামে কেউ কিছু লিখতে পারবে না, প্রশ্ন করতে পারবে না সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে। তাহলেই শেষ রাতে বাড়িতে হানা দেবে আইনের রক্ষকরা। তুলে নিয়ে যাবে। মাসের পর মাস পড়ে থাকতে
হবে জেলের অন্ধকারে। আর নূপুর শর্মা? তিনি দিনেদুপুরে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবেন। এফআইআরে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩এ, ২৯৫এ, ২৯৮, ৩৪ ধারায় মামলা রুজু হবে। জামিন অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি গ্রেপ্তার হবেন না। কারণটা কী? তিনি এতটাই প্রভাবশালী? সঙ্ঘ খেপে যাবে
বলেই কি এই উদাসীনতা? নাকি আছে অন্য অঙ্ক?
ইংরেজরা বিদায় নিয়েছে, কিন্তু আমাদের মোক্ষম একটা শিক্ষা দিয়ে—ডিভাইড অ্যান্ড রুল। বেকায়দায় পড়লেই হিন্দু-মুসলিমদের লড়িয়ে দাও। সাধারণ মানুষ গীতা-কোরান জানে না, সংবিধান বোঝে না। তারা জানে না, ধর্ম এবং ধর্মীয় আচার-আচরণ পালনের স্বাধীনতা আমাদের মৌলিক অধিকার। তাতে কোনও ব্যক্তি, সরকার বা রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে পারে না। সেই সুযোগটাই নিয়ে চলেছে কিছু ধান্দাবাজ, স্বার্থান্বেষী সম্প্রদায়। তারা হিন্দু, মুসলিম, শিখ কোনওটাই নয়। রাজনীতি নামক বৃত্তের অন্ধকার অংশে তাদের বসবাস। তারা শেখায়, আগে নাম জিজ্ঞেস করবে। নামে, গোত্রে, পরিধানে খুঁজে নেবে ধর্ম। সেখান থেকেই শুরুয়াত হবে বিভাজনের। হিন্দু-মুসলিম এক হয়ে গেলেই কিন্তু তা রূপ নেবে সেই একগোছা লাঠির। একটা-দু’টো লাঠি ভেঙে ফেলা সম্ভব। একগোছা লাঠি ভাঙা যায় না। বরং তা আছড়ে পড়ে ব্যর্থ, ধান্দাবাজ রাজনীতির কারবারিদের পিঠে।
আজকের সমাজ, রাজনীতি শুধু একে অপরকে হারাতে ব্যস্ত। তারা চায়, ক্ষোভ থাকুক, সমস্যা থাকুক, বেঁচে থাক অনাহার... তাহলেই আর কেউ ফিরে তাকাবে না। খুঁজবে না ব্যর্থতা। সমালোচনা হবে না। তাই ছক কষতে হবে... সবসময়। মসৃণ করতে হবে জয়ের পথ। পরীক্ষিত স্ট্র্যাটেজি—বিভাজন। ভারত যদি একবার ধর্মের ভিত্তিতে আড়াআড়ি দু’ভাগ হয়ে যায়, কেল্লাফতে। কিন্তু সত্যি বলতে এই দেশ তো কখনও তা চায়নি, চায়ও না। দেশ মানে কয়েকটা ধর্ম, জাতি, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট নয়। দেশ মানে একটা ভাবনা... আদর্শ। মিলেমিশে থাকার, একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার। রামেশ্বরম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ছিলেন কালামের বাবার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু... ‘আমার জীবনের সব স্মৃতি ছাপিয়ে যায় ওই দু’জনের আলাপচারিতা। দু’জনেই বসে আছেন তাঁদের ট্র্যাডিশনাল পোশাকে। লক্ষ্মণ শাস্ত্রীজির গায়ে পুরোহিতের বেশ, আর বাবার ইমামের। আলোচনা করছেন আধ্যাত্মিকতা নিয়ে। একটু বুঝতে শেখার পর বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, প্রার্থনার দরকার কেন হয়? বাবা হেসে বলেছিলেন, প্রার্থনায় কোনও রহস্য নেই। আসলে এর মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে মানুষ একাত্ম হয়... জাত, ধর্ম, বয়স ভুলে।’
এই সহজ পাঠটাই এখন আমরা ভুলে যাচ্ছি। আমাদের বাধ্য করা হচ্ছে ভুলতে। অশান্ত এই পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকা কী? আমাদের মহামান্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিজি যখন-তখন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। মন কি বাতে জ্ঞান বিতরণ করেন। কিন্তু এই ইস্যুতে একবারও তাঁকে মুখ খুলতে দেখা গিয়েছে? একবারও তিনি বলেছেন, হিংসার পথ নেবেন না! এটা ভারতের সংস্কৃতি নয়। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের নামই ভারত...!
রাজনীতি চলছে যে এখানেও। সামনে রাষ্ট্রপতি ভোট। বিরোধীরা যদি একজোট হয়ে যায়, চব্বিশের নির্বাচন অশনি সঙ্কেত হয়ে দেখা দেবে বিজেপির গেরুয়া রাজনীতির সামনে। কালাম বলতেন, ‘যদি কাউকে হারাতে চাও... সেটা সহজ। কিন্তু যদি কাউকে জিতে নিতে চাও... বড্ড কঠিন।’ গেরুয়া শাসককুল এখন শুধু হারাতে ব্যস্ত... বিরোধীদের, দেশবাসীকে, দেশকে। এটাই কি কলিকাল?