বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

চাকরির ভরসা... দায় সরকারের
শান্তনু দত্তগুপ্ত

‘সত্যজিৎ রায় জন-অরণ্য চলচ্চিত্রায়িত করবার কথা ভাবছেন জেনে বিগত রাতে যতটা আনন্দিত হয়েছিলাম, আজ সকালে ঠিক ততটাই দুঃখ হলো। দেশের লক্ষ লক্ষ বিপন্ন ছেলেমেয়েদের আশার আলো জ্বালিয়ে দেবার ক্ষমতা আমার নেই ভেবে লজ্জায় মাথা নিচু করে অসহায়ভাবে বসে রইলাম।’—শংকর
এই অনুভূতি কেন হয়েছিল শংকরের? কারণ তিনি দেখেছিলেন, সংসারের এই প্রাণঘাতী সংগ্রামের সঙ্গে পেরে উঠছে না যুব সমাজ। বেকারত্ব বাড়ছে। যোগ্যতাকে পিছনের সারিতে ঠেলে দখলদারি চালাচ্ছে সুপারিশ। তাই জন্ম নিচ্ছে সুকুমার বা সোমনাথরা। কেউ পাগল হয়ে যাচ্ছে... আর পেটের ভাত জোগাতে বাঁকা পথ নিতে বাধ্য হচ্ছে তার বোন। আবার কেউ এই অসম প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বের করছে দাঁত-নখ। সেই ছবিটাই জন-অরণ্যের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছিলেন শংকর। দুঃখিত হয়েছিলেন... এই কি সমাজ? কেন চাকরি নেই? কেন দাম নেই যোগ্যতার? পড়াশোনার? দক্ষতার? উত্তর কিন্তু আজও মেলেনি। হতে চলল প্রায় ৫০ বছর... চাকরি নয়, এখন গালভরা টার্মিনোলজি কর্মসংস্থান। কত মানুষের কাজের সুযোগ করে দেওয়া গেল? সংখ্যাটা লক্ষে। কিন্তু বেকারত্ব? সেও যে বাড়ছে পাল্লা দিয়ে! ডোমের চাকরির জন্য আবেদন করছেন ইঞ্জিনিয়ার, স্নাতক, স্নাতকোত্তররা। ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া মহিলারাও মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন... যদি সরকারি চাকরিটা লেগে যায়। বাড়ি ছেড়ে বছরের পর বছর শহরে মেস ভাড়া করে পড়ে থাকছেন যুবক-যুবতীরা... একটা সরকারি চাকরির জন্য। কেন? কী আছে সরকারি চাকরিতে? 
মানুষ ভরসা খোঁজে দিনে আর রাতে... এটাই যে সরকারি চাকরির মূলমন্ত্র! গ্রামেগঞ্জে গেলে দেখা যায়, ছেলেদের কাছে চাকরি বলতে পিএসসি ক্লার্কশিপ, ব্যাঙ্ক বা শিক্ষকতা। তাঁরা ছুটে চলেছেন সেই লক্ষ্যে। একটা সরকারি চাকরি জুটিয়ে নিতে পারলেই মিলবে নিরাপত্তা। জীবনভরের। বিয়ের বাজারে পাত্রীপক্ষ নাক কুঁচকাবে না। বলবে না, ‘প্রাইভেট? চাকরি গেলে মেয়েকে খাওয়াবে কী?’ করোনার মতো মহামারী এলে বেতন কেটে নেওয়া হবে না, বন্ধ হয়ে যাবে না সংস্থা। তাই সরকারেই আস্থা। তা সে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন! বিজেপি হোক বা তৃণমূল... রাজনীতিতে তাঁদের কিছু এসে যায় না। ছেলেমেয়েরা তাই আন্দোলন করেন, অনশনে বসেন... ভাবেন, আজ না হয় কাল তো এই আন্দোলনের সুফল মিলবে! সরকার একটু তো মুখ তুলে তাকাবে... আবার নেওয়া হবে শিক্ষক, ক্লার্ক বা ব্যাঙ্ক-পোস্ট অফিসের কর্মী। কিন্তু না... তা যে কিছুতেই হয়ে উঠছে না। রাজ্য সরকার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করছে শিক্ষক নিয়োগের। আর ঠিক তার পরদিন চাকরিপ্রার্থীদের কোনও শুভানুধ্যায়ী মামলা ঠুকে দিচ্ছেন হাইকোর্টে। স্থগিত হয়ে যাচ্ছে নিয়োগ। বছরের পর বছর কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির পদ শূন্য... লক্ষ লক্ষ। তাও যে হুঁশ নেই সরকার বাহাদুরের! বরং তাঁরা আচমকা ঘোষণা করছেন, পাঁচ বছরের বেশি শূন্যপদ এবার তুলে দেওয়া হবে। তাতে আর লোক নেওয়ার দরকার নেই। কারণ হিসেবে ভারত সরকার বলছে, এত বছর যদি ওই সব পদে বিনা কর্মীতেই কাজ চলে গিয়ে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতেও চলবে। কোভিড মহামারী এক্ষেত্রে নয়া দিশা দেখিয়েছে মোদি প্রশাসনকে। আইএএস, আইপিএস, স্টাফ সিলেকশন থেকে নিযুক্ত কর্মী বা রেল... সর্বত্র এই এক চিত্র। মন্ত্রী বলছেন, এ তো রুটিন প্রসেস। নিয়োগ যদি রুটিন প্রক্রিয়া হয়, তাহলে পদের অবলুপ্তি নয় কেন? আর আতান্তরে পড়ছে যুব সমাজ। 
বেসরকারি ক্ষেত্রে চাকরি রয়েছে—এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু সেই সংখ্যাটা কত? যাঁর যা পড়াশোনা, সেই মতো বেতন বহু ক্ষেত্রেই দেওয়া হয় না। মাস্টার ডিগ্রি নিয়ে ময়দানে নামার পরও বহু প্রার্থী ৫-৭ হাজার টাকা মাইনের চাকরি করেন। মূল্যবৃদ্ধির আগুনে তাতে নুন আনতে পান্তা ফুরনোর দশা। এখন বাড়িতে অসুস্থ কেউ থাকলে শুধু ওষুধের খরচই ১০ হাজার টাকা ছুঁতে চায়। সব্জি বাজার হাঁফ ছাড়লেও আলুর দাম আগুন, মাছ-মাংসে হাত দেওয়া যায় না। তাহলে উপায় কী? আন্দোলন? বিক্ষোভ?
উপায় খুঁজছে যুব সম্প্রদায়। তারা ভাবছে, ভোট দিয়েছি। সরকারে এনেছি। কিছু সুবিধা তো পাব? বাড়তি চাই না। ন্যূনতম অধিকারটুকু পেলেই হবে। একটা সম্মানজনক চাকরি, মাথার উপর ছাদ, আর দু’বেলা দু’মুঠো খাবার। ভারতীয়দের ডিমান্ড খুব বেশি নয়। কিন্তু সরকার অতটুকু দিতেই ব্যর্থ। প্রশাসন চালানোর জন্য লোক দরকার ঠিকই, কিন্তু বাড়তি খরচ করব কেন? প্রযুক্তি এসেছে, কাজে লাগাব তাকেই। দশজনের কাজ হয়ে যাবে নিমেষে। নির্ভুলভাবে। তারা কেউ ধর্মঘট ডাকবে না, কামাই করবে না, বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনে নামবে না, সবচেয়ে বড় কথা—বিরুদ্ধে কথাও বলবে না। খুব দরকার হলে এজেন্সি দিয়ে চুক্তিভিত্তিতে কর্মী নিয়ে নেব। তাই অবলুপ্ত হোক পদ। পরিচালন ক্ষমতায় বসে থাকুক কিছু তাঁবেদার লোকজন। তাঁদের দিয়ে সব কাজ উতরে যাবে। এরপরও কেন বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলি আন্দোলনে নামবে না? কেন থাকবে না কর্মসূচি? শুধু টুইটারে চার লাইনের বাইরেই যে বিরোধী রাজনীতির আসল জগৎ, তা বোধহয় কংগ্রেসের মতো দলগুলি ভুলে মেরে দিয়েছে। বিরোধীরা এখন ব্যস্ত শুধু ক্ষমতার রাজনীতিতে। মহাজোট হলে তার নেতৃত্বে কে থাকবে, কোন কোন দলকে খেলায় নেওয়া হবে, কারা বাদ যাবে... এই হল ধ্যানজ্ঞান। কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছে, মানুষের ইস্যুতে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারলে, তার থেকে বড় প্রতিষ্ঠান বিরোধী আন্দোলন কিছু হতে পারে না। মানুষের যন্ত্রণাই সরকারের ব্যর্থতাকে বেআব্রু করে দেয়। সেই যন্ত্রণার শরিক হওয়াটাই বিরোধী রাজনীতির মন্ত্র। সেই হাহাকার পৌঁছে দেওয়া সরকারের অলিন্দে। তা কিন্তু হচ্ছে না। তেমনটা হলে লক্ষ লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারি পদ অবলুপ্তির বিরুদ্ধে পথে নামত ডান-বাম সব দল। তারা কৈফিয়ৎ চাইত, চাকরি দিতে পারো না... কেড়ে নেওয়ার অধিকার তোমাদের কে দিয়েছে? যুব সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করার লক্ষ্যে কী পদক্ষেপ নিয়েছ আট বছরে? সেই প্রশ্ন তুলছে না কেউ। আর নরেন্দ্র মোদি সরকারও আট বছরের ‘সাফল্য কাহিনি’ প্রচারের জন্য কোমর বাঁধছে। দেশজুড়ে বোঝাতে হবে, এটাই আচ্ছে দিন। আগে কিছুই ছিল না। যা করেছে, মোদি সরকার। সেই ঢক্কানিনাদে চাপা পড়ে যাবে চাকরির দাবিতে আন্দোলনরত ছেলেমেয়েদের কণ্ঠ। কেউ পাগল হয়ে যাবে, কেউ মানবতার আদর্শ হারিয়ে মরিয়া চেষ্টা চালাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। সামনে যে আসবে, পিষে দেবে তাকে। বাড়বে অপরাধ। আর বুদ্ধিজীবীরা মাথা নেড়ে বলবেন, সমাজটা গোল্লায় গেল। 
চাকরি নেই... যতটুকু আছে, সেখানেও বাসা বেঁধেছে দুর্নীতি। প্যানেলে ২০ নম্বরে থাকা মেয়েটি হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করছে, সে ২১ নম্বরে চলে গিয়েছে। আর তার প্রাপ্য চাকরিটি দেওয়া হয়েছে এক মন্ত্রিকন্যাকে। অথচ, সে কি না ইন্টারভিউতেই বসেনি! এক্ষেত্রে মামলা হওয়াটাই উচিত। যোগ্যকে তার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই আইন। কিন্তু আরও হাজার হাজার প্রার্থী যাঁরা যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও বসে আছেন চাকরির একটি চিঠির অপেক্ষায়, তাঁদের পায়ে কুড়ুল মারাটা আইনের অপব্যবহার। যা চলছে প্রতিনিয়ত। সরকারের একাংশের দুর্নীতি যদি সমাজকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তাহলে এই মামলাবাজরাও ঘুণপোকার থেকে কম কিছু নন। সুরাহা করতে পারছেন না তাঁরা, দিচ্ছেন না উপায়... শুধু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মননটাকে খেয়ে ফেলছেন খুঁড়ে খুঁড়ে, অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ছে তারা। 
সংসার সংগ্রামে হেরে গিয়ে কণা বদলে গিয়েছিল শিউলিতে। সোমনাথ তা বুঝতে পারা মাত্র ছুটে নেমেছিলেন রাস্তায়। কিন্তু কণাকে আর খুঁজে পাননি। কারণ সে ততক্ষণে মিশে গিয়েছে জন-অরণ্যে। এভাবেই মারা যায় কণা, সোমনাথ, সুকুমাররা। জন্ম নেয় এক হতাশ, ক্ষুব্ধ জন-অরণ্য। আজও। আর তার দায় সরকারের, রাজনীতির। তারাই যে ঠিক করে, সমাজ কেমন হবে...। 

24th     May,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ