বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার
ট্র্যাডিশন সমানে চলছে ...
হিমাংশু সিংহ

জওহরলাল নেহরু থেকে হালের নরেন্দ্র মোদি। ভারতের ইতিহাসকে নিজের মতো করে তুলে ধরার চেষ্টায় খামতি নেই কোথাও। নেহরু-গান্ধী পরিবারের আখ্যানে দেশের শ্রেষ্ঠ বীর সন্তান নেতাজি সুভাষের ভূমিকাকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করার প্রয়াস আজও অব্যাহত। বারে বারে যা নিয়ে গর্জে উঠেছেন ইতিহাসবিদরা। স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। কিন্তু সেসবের তোয়াক্কা না করেই যত আলো আর গৌরব বর্ষিত হয়েছে মহাত্মা গান্ধীর আশীর্বাদধন্য একটি বিশেষ পরিবার ও তার বশংবদদের উপর। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের সিংহভাগই ছিল ওই পরিবারেরই নিয়ন্ত্রণে। আর আজ স্বাধীনতার ৭৫ বছরের অমৃত মহোৎসব পালনের ঠিক প্রাক্কালেও সেই একই ঘটনার আশ্চর্য পুনরাবৃত্তি। সমাপতনও বলা যায়। এবার পরিবার নয়, একটি সাম্প্রদায়িক দলের হাতে বন্দি দেশের ইতিহাস। অতীত বিচ্যুতি সংশোধনের নামে শুরু হয়েছে বিভাজনের তাস খেলার আরও সঙ্কীর্ণ প্রয়াস। রাষ্ট্রক্ষমতা একটি দল, একটি পরিবার কিংবা একক ব্যক্তিত্বের হাতে বন্দি হলে ক্ষমতার অহঙ্কারে ইতিহাসকে নিজের মতো করে চালিত করার নেশা শাসককে পেয়ে বসে বারেবারে। ইতিহাসই তার সাক্ষী! আজ একবিংশ শতাব্দীতেও তার নগ্ন চেহারা দেখা যাচ্ছে আরএসএস ও বিজেপির হাত ধরে। ধ্বংস করার চেষ্টা চলছে, ভারতের সনাতন সহাবস্থান ও ‘মিলাবে মিলিবে’-র মহান আদর্শ। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ভাবনাই তাই আজ বড় বিপন্ন। 
কাশী বিশ্বনাথ ও জ্ঞানবাপীর পাশাপাশি থাকার ইতিবৃত্ত তো আজকের নয়। কয়েকশো বছরের পুরনো। মোঘল আমলের। তা নিয়ে বিতর্কও নতুন নয়। হঠাৎ আজ মূল্যবৃদ্ধি, আর্থিক সঙ্কট আর কাজ হারিয়ে বেকার হওয়া মানুষের দুঃসময়ে আওরঙ্গজেবের তাণ্ডবকে খুঁচিয়ে তুলে কোন স্বার্থসিদ্ধি হবে? কার লাভ এতে? জ্ঞানবাপীর ইতিহাস নতুন করে লিখে প্রধানমন্ত্রীর লোকসভা কেন্দ্রে বাহবা কুড়বে হিন্দুত্ববাদীরা। ভোটের বাক্স ভরে উঠবে হিন্দি বলয়ে। তাই সব ভুলিয়ে মন্দিরের পরিধি বিস্তারের লক্ষ্যেই কি এই ‘মামলা মামলা’ খেলার সুচিন্তিত স্ক্রিপ্টের অবতারণা। 
মথুরার কৃষ্ণ জন্মস্থানের পাশেই ঈদগার উপস্থিতি নিয়েও বিতর্ক বড় কম হয়নি। শেষে ১৯৬৮ সালে একটা সমঝোতা হয়। তারপর দীর্ঘদিন সব শান্তই ছিল। কিন্তু ওই যে সেদিন মোদিজি বলেছেন, এখনও অনেক কাজ তাঁর বাকি। কাজ বলতে তো দারিদ্র্য দূর করার কথা বলেননি তিনি। কর্মসংস্থানের অভীষ্ট লক্ষ্যপূরণও নয়। পরিযায়ী শ্রমিকের দুঃখমোচনও টার্গেট নয়। এজেন্ডা একটাই হিন্দুরাষ্ট্র গড়া। তাই মথুরাতেও সমঝোতা ভেঙে নতুন করে নিজেদের খেলায় মেতেছে হিন্দুত্ববাদীরা। মহামান্য আদালত চোর পুলিস ঠগ বাটপাড় ছেড়ে মন্দির মসজিদ বিরোধ মেটাতেই আজ হিমশিম। নির্বাচনী বৈতরণী পেরতে ওটাই আজ শাসকের প্রধান মূলধন যে!
মোদি জমানায় সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ বলেই অযোধ্যা মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে নবরূপে গড়ে ওঠা রামমন্দিরের উদ্বোধন কবে, তা এখনও ঘোষণা হয়নি। সেই প্রহর গুনছে অযোধ্যা। আসন্ন লোকসভা ভোটের আগেই চোখ ধাঁধানো মন্দিরের যে আত্মপ্রকাশ ঘটবে তা একপ্রকার নিশ্চিত। বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছিল প্রায় ৩০ বছর আগে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। তিন দশক পর সেখানে রামমন্দির গড়ে নয়া ইতিহাস তৈরির পথে ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু তার চেয়েও বড় লক্ষ্য, চব্বিশের আগেই কাশী বিশ্বনাথ ও মথুরার কৃষ্ণ জন্মস্থানের শুদ্ধিকরণ। কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের ব্যাপক সংস্কারের সঙ্গেই যুগ যুগ ধরে পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা জ্ঞানবাপী মসজিদেরও অস্তিত্ব প্রায় বিলোপ করে মন্দির সম্প্রসারণের কাজ শুরু করে দিয়েছে হিন্দুত্ববাদীরা। সবমিলিয়ে হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ। ঘটা করে আইনি সক্রিয়তা বাড়ানো তারই অঙ্গ। প্রাচীন পুষ্করিণী থেকে কখনও মিলছে শিবলিঙ্গ, কখনও ত্রিশূল। ঘিরে রাখা হয়েছে বিতর্কিত গোটা এলাকা। মোতায়েন হয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। আবার কোর্টে সিল করা খামে গোপনে পেশ করা সমীক্ষক সংস্থার সেইসব রিপোর্টও নিমেষে চলে আসছে মিডিয়ার হাতে। সবই হিন্দুত্ববাদীদের কৃপায়। যখন এমনটা হয়, তখন কেন্দ্রের শাসক দলের মনের ইচ্ছেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ঠিক সেই দেখানো পথেই অগ্রসর হয় প্রশাসন। ফলে বিজেপি ও আরএসএসের এজেন্ডা অনুসরণ করেই কাজ চলছে। বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন। সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি শুনছেন মহামান্য বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। তাঁর ঐতিহাসিক রায়ই অযোধ্যায় মন্দির তৈরির পথ প্রশস্ত করেছে। এবার জ্ঞানবাপী নিয়েও তাঁর সাড়া জাগানো রায় শোনার অপেক্ষায় দেশ। তারপর কৃষ্ণজন্মস্থান মথুরা। আরও কত আছে! ওই জন্যই তো একান্তে মোদিজি বলেছেন, বহু কাজ বাকি! সমঝদারদের জন্য ওই ইশারাটুকই যথেষ্ট। তার থেকেই নিন্দুকেরা বলছেন, জিতে এলে চব্বিশ থেকে ঊনত্রিশ তিনিই প্রধানমন্ত্রী। টানা ১৫ বছর। নেহরুকে ছুঁয়ে ফেলার মাহেন্দ্রক্ষণ। একইসঙ্গে মুছে ফেলারও। ২০২৬ সালে তাঁর বয়স ৭৫ অতিক্রম করলেও আপাতত অমিত শাহ কিংবা যোগী আদিত্যনাথের ভাগ্যে শিকে ছিড়বে না। আদবানি-যোশির মতো তাঁকে বানপ্রস্থেও যেতে হবে না। হিন্দুত্বের যাবতীয় এজেন্ডা পূরণ করে তবেই তিনি থামবেন। তার আগে নয়। 
কিন্তু হঠাৎ এই তাড়াহুড়োটা কেন? সব ফেলে একটা মসজিদ নিয়ে দেশ উত্তাল কেন? এতে কি রান্নার গ্যাসের দাম কমবে, না বাড়ির বেকার ছেলেটা চাকরি পাবে! না, কিছুই হবে না। উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, মূল্যবৃদ্ধিতে রাশ টানার কোনও চেষ্টাই সফল হবে না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসতে ধর্মের এই আফিম বিতরণের পথে এগচ্ছেন মোদি সরকারের বাজনদাররা। যুক্তিবাদী বিজ্ঞান শিক্ষায় পারদর্শী এই দেশে এখনও যে শেষ কথা বলে ধর্ম, কুসংস্কার আর অদৃষ্টের দোহাই! ধুরন্ধর রাজনীতিকদের তা জানতে বাকি নেই!
শুধু হিন্দুত্ববাদের প্রসারই নয় সামরিক সাফল্যের নিরিখেও অতীত ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে মরিয়া চেষ্টা চলছে বর্তমান গেরুয়া জমানায়। ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ২০০১ ভারতের সামরিক ইতিহাসে অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। লালবাহাদুর শাস্ত্রী, ইন্দিরা গান্ধী ও বিজেপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অটলবিহারী বাজপেয়ির যুদ্ধজয়ের সেই গৌরব গাথাও মুছে দিতেও তৎপরতা তুঙ্গে। সদর্পে বলা হচ্ছে, আগে কোনও সুস্পষ্ট সামরিক নীতিই ছিল না দেশটার। ২০১৪ সালে সরকারে এসে নরেন্দ্র মোদিই প্রথম সুস্পষ্ট প্রতিরক্ষা নীতি ও কৌশল তৈরি করেন। অথচ চীন ও রাশিয়ার যে চোখ রাঙাচ্ছে। আমেরিকা যেমন ইচ্ছা নাচাচ্ছে, সেকথা বলা মানা। কিন্তু এই একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মতো কোনও সার্বিক বিরোধী জোট যেমন নেই, তেমনি সম্মিলিত প্রতিবাদও শোনা যাচ্ছে না। এটাই এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য!
উল্টে জোট যাতে না হয় সেজন্য একদল সক্রিয়। কংগ্রেসের ‘পাপ্পু’ রাহুল গান্ধী তো বলেই দিয়েছেন, আঞ্চলিক দলের জোটের কোনও ভবিষ্যৎ নেই, কংগ্রেসকেই নেতৃত্বে মেনে নিতে হবে। এই অবস্থায় বিরোধী জোটও সোনার পাথরবাটি ছাড়া এখনও কিছুই নয়। রাহুল গান্ধী নিজের নাক কেটে অন্য বিরোধী শক্তির যাত্রাভঙ্গের পথ দেখিয়ে দিয়েছেন উদয়পুরের পাঁচতারা রিসর্টে। সেই ঐতিহাসিক ভাষণের পর তাঁর দল শক্তিশালী হওয়ার বদলে আরও ভাঙছে। আর ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর রাগে হোক কিংবা অভিমানে সাফ বলে দিয়েছেন, হিমাচল ও গুজরাতেও ভরাডুবির জন্য তৈরি থাকুক কংগ্রেস। বলা বাহুল্য, উত্তর ভারতে হঠাৎ বিরোধী ভোট ভাঙতে নতুন শক্তির উদয় হচ্ছে। রাজ্যে রাজ্যে ভোট কেটে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আপ আখেরে বিজেপিরই সুবিধা করে দিচ্ছে। আরও দেবে। এতে শুধু ভোট ভাগই হবে না, বিরোধী জোটের পথে কাঁটা ছড়িয়ে বিজেপির সুবিধাও করে দেবে বিভিন্ন দল।
আর পশ্চিমবঙ্গে যথারীতি চলছে কেন্দ্রীয় এজেন্সির তুঘলকি আচরণ। দুর্নীতি কেউ সহ্য করে না। তার বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থাই সময়ের দাবি। কিন্তু সিবিআইকে দেখে মনে হচ্ছে, আর সব রাজ্য সরকার আর তার মন্ত্রীরা বুঝি ধোয়া তুলসিপাতা। তাই সব কেন্দ্রীয় এজেন্সির একমাত্র গন্তব্য বাংলা। রাজ্যের এই বদনামও মেনে নেওয়া যায় না। আমরা দুর্নীতির সমর্থক নই। দুর্নীতিপরায়ণদের পক্ষেও নেই। অপরাধ করলে তার কঠোরতম শাস্তি হওয়াই উচিত। এক্ষেত্রে কোনও দল-রং দেখা চলবে না। কিন্তু একইসঙ্গে রাজনৈতিক প্রয়োজনে শুধু একটা রাজ্যে সব কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে নামিয়ে দেওয়ার এই কুনাট্যও বন্ধ হওয়া উচিত।

22nd     May,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ