বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

তাজমহলের নিয়তি!
মৃণালকান্তি দাস

রামমন্দির আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের থেকেও বড়! বলেছিলেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুরেন্দ্র জৈন। তাঁর দাবি, এই পথেই রামরাজ্যের দিকে দেশ যাত্রা শুরু করেছে।
১৯৮৪ সালের লোকসভা ভোটে গোটা দেশে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ২টি আসন। দেশের সংখ্যাগুরু মন টলিয়ে দেওয়ার ইস্যুর খোঁজ চলছিল গেরুয়া শিবিরে। বেছে নেওয়া হয়েছিল মহাকাব্যের নায়ককেই। বাবরি নিয়ে মহন্ত রঘুবীর দাস প্রথম মামলা করেছিলেন ফৈজাবাদ জেলা আদালতে। মসজিদের বাইরে রামচবুতরার উপরে একটি চন্দ্রাতপ বা ছাউনি তৈরির জন্য আদালতের সম্মতি চান তিনি। ফৈজাবাদ আদালত কিন্তু সম্মতি দেয়নি। আবেদন বাতিল করে। সেটা ১৯৮৫ সাল। বিজেপি বুঝতে পারে, এই ইস্যুতেই টলিয়ে দেওয়া যায় গোবলয়— গোটা দেশকেও। অতএব, রামকে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে টেনে আনা হয় ১৯৮৯ সালে। হিমাচলপ্রদেশের পালমপুর কনভেনশনে বিজেপি সরাসরি প্রস্তাব আনে অযোধ্যায় রামমন্দির স্থাপনের। ৫০০ বছরের বিতর্কিত জায়গায় রামমন্দির নির্মাণের কথা বলে প্রস্তাব দেওয়া হয় নির্বাচনী ইস্তাহারে। সেই শুরু।
১৯৯২ সালে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয় করসেবকদের হাতে। তারপর থেকে চলেছে শুধু মন্দির নিয়ে রাজনীতি আর অন্ধ ভক্তিবাদ। ১৯৯৬-এর ভোটে বিজেপি লোকসভায় জিতেছিল ১৬১টি আসন। মন্দির ইস্যুকে আঁকড়ে ধরেই ২৩ বছর পরে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে সেই বিজেপি ৩০৩টি আসনে জিতে আসে। বিজেপি একাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, শরিকদের ছাড়াই। সেই বছরই সর্বোচ্চ আদালত মন্দিরের পক্ষে রায় দেয়। বিতর্কিত জমিতে রামমন্দির তৈরির অনুমতি মেলে।
অযোধ্যায় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাম-রাজ্যের স্বপ্ন দেখিয়ে বলেছিলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের মতোই রামমন্দির আন্দোলনে দেশের বহু মানুষ দীর্ঘসময় আত্মত্যাগ করেছেন। রামমন্দিরের শিলান্যাস সেই আত্মত্যাগেরই পরিণতি। দেশের উন্নয়নযজ্ঞে অনেককেই আত্মত্যাগ করতে হবে। সেই আত্মত্যাগেই ‘এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত’ হবে। ভয় বিনু হোই ন প্রীতি’, অর্থাৎ ভীতি জাগাতে না পারলে প্রীতিও পাওয়া যায় না, বলেছিলেন মোদি। প্রধানমন্ত্রীর সেই ভয়ের আয়ুধে প্রীতি আদায়ের কৌশল এখন প্রতিদিন টের পাচ্ছে দেশবাসী। অযোধ্যা সূচনামাত্র, কাশী-মথুরা এখনও বাকি— এই স্লোগান ধীর লয়ে এখন গোটা দেশে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এর সঙ্গে কখনও শোনা যাচ্ছে কুতুব মিনারকে ‘বিষ্ণু স্তম্ভ’ ঘোষণা করার দাবি, কখনও তাজমহলের নাম পরিবর্তনের স্লোগান। মোদির জমানার অন্যতম অভিজ্ঞান হিন্দুত্ববাদী কার্যকলাপগুলিকে রাষ্ট্রীয় প্রকল্পে পরিণত করা।
সমালোচকরা বলছেন, রামরাজ্য নয়। অযোধ্যা থেকে নরেন্দ্র মোদি আসলে হিন্দুরাষ্ট্রের পথে যাত্রা শুরু করেছেন। উত্তরপ্রদেশের বিজেপি নেতা রজনীশ সিং-রা সেই যাত্রাপথের কুশীলব। তাঁদের লক্ষ্য এবার তাজমহল! ওই সৌধের ‘প্রকৃত’ ইতিহাস খুঁজে বের করার ছকে তথ্যানুসন্ধানী কমিটি গঠনের আর্জি জানিয়েছিলেন বিজেপির ‘মিডিয়া ইনচার্জ’ রজনীশ সিং। একই সঙ্গে ওই স্মৃতিসৌধের ২২টি বন্ধ ঘর খুলে দেওয়ার আর্জিও জানিয়েছিলেন তিনি। রজনীশ সিংরা মনে করেন, তাজমহলের বাইশটি বন্ধ ঘরেই লুকানো আছে তার ‘আসল ইতিহাস’। তাঁর মতে, ওই বন্ধ ঘরগুলি খুললেই নাকি বেরিয়ে আসবে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি, আর তাতেই বোঝা যাবে ‘তেজো মহালয়’ (‘তাজমহল’ নয়) আদতে ছিল শিবমন্দির। যা ১২১২ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা পরমর্দি দেব।
প্রিয় বেগম মমতাজের স্মৃতি রক্ষার্থে সম্রাট শাহজাহান ১৬৩১ সালে যে কাজে হাত দিয়েছিলেন, ২২ বছর ধরে ২২ হাজার শ্রমিকের উদয়াস্ত পরিশ্রম শেষে তা শেষ হয় ১৬৫৩ সালে। সেই বিস্ময়-স্থাপত্য তাজমহলকে ঘিরে বিতর্ক অবশ্য এই প্রথম নয়। মাঝেমধ্যেই তা মাথাচাড়া দেয়। ২০১৫ সালে উত্তরপ্রদেশের একদল আইনজীবীও এ নিয়ে মামলা করেছিলেন। ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশের কট্টরবাদী বিজেপি নেতা বিনয় কাটিয়ার মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন, তাজমহলের অভ্যন্তরে কোনও হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে কি না খতিয়ে দেখতে। ২০১৯ সালে কর্ণাটকের বিজেপি নেতা অনন্ত কুমার হেগড়ে দাবি করেন, শাহজাহান নাকি আদৌ তাজমহল তৈরি করেননি। ওটা তিনি কিনেছিলেন রাজা জয় সিংয়ের কাছ থেকে। ১৯৮৯ সাল থেকেই ধারাবাহিকভাবে মত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে নানা হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। রামমন্দিরের সাফল্য সেই মতকে আরও গতি দিয়েছে।
বাজার গরম করতে তাজমহল নিয়ে মন্তব্য করেন রাজস্থানের জয়পুর রাজপরিবারের রানি দীয়া কুমারীও। বিজেপির লোকসভা সদস্য জয়পুরের শেষ মহারাজা মান সিংয়ের এই নাতনির দাবি, যে জমিতে তাজমহল তৈরি, একসময় তা ছিল জয়পুর রাজপরিবারের। এই সংক্রান্ত কাগজপত্রও তাঁদের রাজ পরিবারে রয়েছে। প্রয়োজনে তা দাখিলও করতে পারবেন। দীয়া কুমারী বলেন, ‘আমি বলছি না তাজমহল ভেঙে ফেলা হোক। কিন্তু সত্য উদ্‌ঘাটনে বন্ধ দরজা খোলা দরকার। সব রহস্য ওখানেই।’ কিন্তু গত ১২ মে এলাহাবাদ হাইকোর্টের দুই বিচারপতি ডি কে উপাধ্যায় ও সুভাষ বিদ্যার্থী মামলাকারীকে ভর্ৎসনা করে বলেন, ‘জনস্বার্থ মামলাকে এভাবে উপহাসে পরিণত করবেন না। এরপর তো আমাদের চেম্বার খুলে দেখতে চাওয়া হবে, কী রয়েছে!’ ১৬ মে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া বা এএসআই)-এর তরফে সেই ‘গোপন’ কুঠুরিগুলির ছবি প্রকাশ করা হয়। তাজমহল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত এএসআই-এর ‘আগরা সেল’ জানিয়ে দেয়, ওই কুঠুরিগুলিতে কোনও গোপনীয়তা নেই। এগুলি মূল কাঠামোর অংশমাত্র। ২০২১-এর ডিসেম্বর থেকে ২০২২-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যমুনা নদীখাত লাগোয়া ওই ভূগর্ভস্থ ঘরগুলিতে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ হয়েছিল। সেই সময়ই ছবিগুলি তোলা হয়। প্রকাশিত চারটি ছবি গত ডিসেম্বরে তোলা। তাহলে কি তাজমহল নিয়ে যাবতীয় শোরগোলের ইতি এখানেই? গেরুয়া শিবিরের ইতিহাস সেকথা বলে না। এলাহাবাদ হাইকোর্ট রজনীশ সিংয়ের আর্জিকে অযৌক্তিক অ্যাখ্যা দিয়ে খারিজ করে দিলেও ভয়ঙ্কর বিপদের ইঙ্গিত টের পাওয়া যায়।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শা-জাহান কবিতায় তাজমহল সম্পর্কে লিখেছেন, ‘একবিন্দু নয়নের জল, কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল, এ তাজমহল।’ দুনিয়ার সপ্তম আশ্চর্য। তিন দশক আগে তাজমহলের টানে এসেছিলেন যুবরানি ডায়ানা। ছবি তুলেছিলেন মার্বেলের বেঞ্চে বসে। সেই থেকে বেঞ্চটির নামই হয়ে যায় ‘ডায়ানা বেঞ্চ’। চার্লসের সঙ্গে তখনও বিবাহবিচ্ছেদ না হলেও তাজ-সফরে ডায়ানার সঙ্গী হননি তিনি। তারিখটা ছিল ১৯৯২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। দু’যুগ পরে সেই তাজেই এসেছিলেন ডায়ানার পুত্র-পুত্রবধূ। ‘ডায়ানা বেঞ্চে’ বসেই ছবি তুলেছিলেন উইলিয়াম-কেট। তবে রাজদম্পতি বসার আগে ভিজে তোয়ালে জড়িয়ে ঠান্ডা করতে হয় ৪০ ডিগ্রি গরমে তেতে ওঠা বেঞ্চটিকে। এমন কোনও রাষ্ট্রনেতা নেই, যিনি ভারত সফরে এসে তাজমহলের মাটিতে পা দেননি। অথচ, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর যোগী আদিত্যনাথ বলেছিলেন, তাজমহল ভারতীয় সংস্কৃতির অংশ নয় এবং বিদেশি পর্যটকদের তাজমহলের প্রতিকৃতি উপহার দেওয়ার প্রথা বন্ধ হওয়া উচিত। পরিবর্তে বিশেষ অতিথিদের গীতা কিংবা রামায়ণ উপহার দেওয়া যেতে পারে। যোগীর কথা অনুযায়ী, এই দু’টি বই ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতীক।
ক্ষমতায় আসার ছ’মাস পূর্তি উপলক্ষে যোগী সরকারের তরফে রাজ্যের পর্যটন সংক্রান্ত একটি বই প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই বইয়ের শিরোনাম ‘উত্তর প্রদেশ পর্যটন-অসীম সম্ভাবনা’। এই বইয়ে রাজ্যের যে সমস্ত পর্যটনস্থলের উল্লেখ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম গোরখনাথ পীঠ। যার প্রধান খোদ মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ। এই বইতে দর্শনীয় স্থান হিসেবে ঠাঁই পায়নি তাজমহল। আসলে ছলে-বলে তাজমহলকে ভারতীয় ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার মরিয়া চেষ্টা।
লোকসভা নির্বাচন ক্রমশ এগিয়ে আসছে। হিন্দুত্ব যে অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হবে বিজেপির কাছে, তা বলাই বাহুল্য। তবে তার জন্য হিন্দুত্বর হাওয়া নতুন করে তুলতে হবে দেশে। আচমকা তাজমহল বিরোধী জিগির দেখে আশঙ্কা হচ্ছে, হাওয়া তোলার পরিকল্পনা নয় তো এ সব? রক্ষণশীলতার বিভিন্ন বিন্দুতে বিভিন্ন অবস্থান গড়ে ভোট আকর্ষণ, এটাই বিজেপির স্ট্র্যাটেজি। এটাই হয়তো তাজমহলের নিয়তি! তাহাই ইতিহাস যা রচিবে সঙ্ঘ...।

19th     May,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ