বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

নাগরিক বনাম রাষ্ট্র বনাম স্বাধীনতা
পি চিদম্বরম

বিশ্বাস করি যে আমি স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করেছি। আমি জন্মেছি ওয়েস্টমিনস্টারের মতো একটি গণতন্ত্রে অথবা সোভিয়েত-ব্যবস্থার মতো একটি রাষ্ট্রে অথবা একটি চরম স্বৈরাচারী দেশে অথবা এমন একটি দেশে যেখানে কোলাহল, বিবাদ-বিসংবাদ লেগেই রয়েছে—আর এগুলি এমন বিষয় যার উপর আমার কোনও হাত ছিল না।
কিছু অবিচ্ছেদ্য বা হস্তান্তরের অযোগ্য অধিকার নিয়ে জন্মেছি বলেও আমি বিশ্বাস করি। এর মধ্যে রয়েছে—আমার শরীরের অধিকার, স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার, আমার কথা বলার ও লেখার অধিকার, আমার পছন্দের মানুষজনের সঙ্গে মেলামেশা করার অধিকার এবং নিজের ও আমার পরিবারের জন্য কাজ করার অধিকার।
‘রাষ্ট্র’ সেই নাগরিকদের সম্মিলিত নামের অতিরিক্ত কিছু নয়, যারা নিজেদেরকে সংগঠিত এবং একটি ‘রাষ্ট্র’ গঠন করে। নাগরিকদের দ্বারা গৃহীত একটি সনদই রাষ্ট্রের সংবিধানে পরিণত হয়। সংবিধানে যা লেখা আছে তার বাইরে রাষ্ট্র কোনও অধিকার বা ক্ষমতা বা কর্তব্য জাহির করতে পারে না। যে নাগরিক সংবিধান মেনে নেয় না সে দেশ ছেড়ে অন্য দেশের নাগরিক হতে পারে, যদি সেই দেশ তাকে গ্রহণ করে। 

নিখুঁত বিচক্ষণ ব্যবস্থা
সাধারণভাবে রাষ্ট্র এবং নাগরিকদের এই নিখুঁত বিচক্ষণ ব্যবস্থায় সহাবস্থান করতে পারা উচিত। বিপত্তি রয়েছে নিম্নোক্ত ক্ষেত্রগুলিতে: সংবিধানে যা লেখা আছে তার অর্থ কখনও কখনও বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে ওঠে, অতএব প্রয়োজন হয় ব্যাখ্যার। সংবিধান ব্যাখ্যা করার অধিকার দৃঢ়ভাবে বিচার বিভাগের (‘বিচার বিভাগীয় ক্ষমতার একমাত্র আধার’) উপর ন্যস্ত হয় কিন্তু বিষয়টিতে প্রতিদ্বন্দ্বী আবার আইনসভা (‘আইন প্রণয়নের ক্ষমতার একমাত্র আধার’)। বিচারকদের সবসময়ই নিয়োগ করা হয় কিন্তু তাঁদের নিয়োগের ক্ষমতা, সাধারণত, সরকারের হাতে থাকে।
এই ব্যবস্থায়, এমন কিছু পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যখন লিখিত শব্দ এবং তার অর্থের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে পারে। আইনসভা এবং বিচার বিভাগ ভিন্নমত পোষণও করতে পারে কিছু পরিস্থিতিতে। এই ধরনের মতবিরোধের সমাধানের ভিতর দিয়েই একটি দেশ অন্যদের থেকে পরিণত ও সভ্য হিসেবে আলাদাভাবে চিহ্নিত হয়।
১৯৭৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন একটি পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। গর্ভপাতের প্রশ্নে (রো বনাম ওয়েড), বিচারকরা জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে নারীদের গোপনীয়তা, এবং সংস্থার অধিকারকে সমর্থন করেছিলেন। ভারতে এমন একটি মুহূর্ত এসেছিল ১৯৭৬ সালে। বিচারকরা তৎকালীন সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এবং তাতে জনগণের জীবনের অধিকার-সহ মৌলিক অধিকারগুলি ক্ষুণ্ণ হয়েছিল (এডিএম জবলপুর বনাম এস এস শুক্লা)।

সংবিধানকে বাঁচান অথবা কবরে পাঠান
গর্ভপাতে মায়ের অধিকার নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে আইন তৈরির ক্ষমতা রাষ্ট্রের আছে কি? রো বনাম ওয়েড মামলায় সেই প্রশ্ন উঠেছিল। মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে বলেছে, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার সংবিধানে স্বীকৃত এবং একজন মহিলা গর্ভপাত করাবেন কি করাবেন না—সেই সিদ্ধান্ত অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মতোই যথেষ্ট বিস্তৃত এই অধিকারটি। যাই হোক, রাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে নারীর অধিকারের ভারসাম্য বজায় রেখে আদালত রায় দেয় যে—গর্ভধারণের প্রথম তিনমাসের শেষ পর্যন্ত, প্রথম তিনমাসের শেষ থেকে গর্ভের বাইরে ভ্রূণের সুস্থতা পর্যন্ত, এবং সেখান থেকে প্রসবকাল পর্যন্ত অধিকারগুলি আলাদা। 
ডোনাল্ড ট্রাম্প এসে অন্যান্য বিষয়ে আমেরিকানদের বিভক্ত করার আগে পর্যন্ত—রো বনাম ওয়েড মামলার রায়েই আমেরিকানদের মধ্যে সর্বাধিক বিভাজন ঘটে গিয়েছিল। মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট রো বনাম ওয়েড পর্যালোচনা করলে বিভাজন এবং তিক্ততা আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একটি বিচারাধীন মামলায় আদালতের সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ের ফাঁস হওয়া প্রথম খসড়ায় প্রস্তাব রয়েছে যে, রো বনাম ওয়েড বাতিল হবে। ফাঁস হওয়া নথি অনুসারে, রো বনাম ওয়েডের সিদ্ধান্ত ছিল ‘সাংঘাতিক রকমের ভুল’ এবং ‘এর যুক্তি ছিল অত্যন্ত দুর্বল, এবং সিদ্ধান্তের যে পরিণতি হয়েছে তা ক্ষতিকর।’ রো বনাম ওয়েড বাস্তবে বাতিল হলে জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং সমলিঙ্গে বিবাহের উপর তার বিরাট প্রভাব পড়বে। এটাই আদালতের ক্ষমতা—স্বাধীনতা প্রসারিত বা নিয়ন্ত্রিত করার জন্য তারা প্রয়োগ করে। 

একটি অপেক্ষমান জাতি 
স্বাধীনতা কেন্দ্রিক অনেকগুলি মামলা ভারতের সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। উল্লেখযোগ্যগুলি হল:
> বিমুদ্রাকরণের মামলা: রাষ্ট্র কি নোটিস ছাড়াই ৮৬ শতাংশ মুদ্রা বাতিল করতে পারে—যার পরিণামে লক্ষ লক্ষ মানুষ কয়েকদিন যাবৎ খাদ্য ও ওষুধ থেকে বঞ্চিত হল?
> নির্বাচনী বন্ড মামলা: রাষ্ট্র কি এমন একটি আইন তৈরি করতে পারে যার জোরে কর্পোরেটরা (লোকসানে-চলা কোম্পানিগুলি-সহ) রাজনৈতিক দলগুলিকে বেনামে এবং যথেচ্ছ অনুদান দিতে পারে? আরও লক্ষণীয় এই যে, সুকৌশলে ক্রনি ক্যাপিটালিজম, দুর্নীতি এবং শাসকদলকে টাকা দেওয়ার ব্যাপারটি একাকার হয়ে যাচ্ছে! 
> লকডাউন: রাষ্ট্র কি জনগণকে আগাম না জানিয়ে সম্পূর্ণ লকডাউন জারি করতে পারে—যার দরুন লক্ষ লক্ষ মানুষের স্থায়ী ঠিকানায় বা বাড়িতে ফেরার পথ রুদ্ধ হয় যায় এবং তারা খাদ্য, জল, ওষুধ, টাকা প্রভৃতি থেকে বঞ্চিত হয়? 
> সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল: যে রাজ্যটি একীভূতকরণের দলিল (ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন) মোতাবেক একদা দুটি উপ-রাজ্যের ইউনিট হিসেবে ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিল, সংশ্লিষ্ট জনগণ বা রাজ্যের আইনসভার সম্মতি ছাড়াই রাষ্ট্র কি তাকে ভেঙে দিতে পারে?  
> রাষ্ট্রদ্রোহিতা: কোনও ব্যক্তি রাষ্ট্রের ভূমিকার বিরোধিতা কিংবা উপহাস করে বলে রাষ্ট্র কি তার নামে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনতে পারে?
> এনকাউন্টার ও বুলডোজার: জনগণের ভিন্নমত বা বিক্ষোভ দমন করার জন্য রাষ্ট্র কি ‘এনকাউন্টার’ এবং ‘ডেমোলিশনের’ মতো পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারে?
ভারতীয় রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে আঘাত হানার একটি ইচ্ছাকৃত এবং দৃঢ় প্রয়াস জারি রয়েছে। চুপিসারে জনগণকে প্রান্তে এনে ছিন্নভিন্ন করে তাদের স্বাধীনতা ও অবিচ্ছেদ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অপচেষ্টা চলছে। ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স ২০২২-এ, ভারত ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫০-এ নেমে এসেছে। সজাগ নাগরিকেরা সুপ্রিম কোর্টের দরজায় কড়া নাড়ছেন, যে প্রতিষ্ঠান নিজেকে সতর্ক প্রহরী হিসেবেই বর্ণনা করেছে। 
স্বাধীনতা একজন ত্রাণকর্তার প্রতীক্ষায়। 

লেখক ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত

9th     May,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ