বোঝা গেল, বাংলা নিয়ে অমিত শাহদের খোয়াব কেটে গিয়েছে। দু’দিনের ‘ফ্লপ’ বঙ্গ সফরই তার অকাট্য প্রমাণ। দীর্ঘ একবছর পরে এসেও দু’শো আসন জেতার কথা তাই মুখেই আনলেন না নরেন্দ্র মোদির প্রধান সেনাপতি। হাত আশমানে তুলে চব্বিশের লোকসভা ভোটে আমরা গতবারের মতো বাইশটা আসন জিতবই, এমন দুরাশার বাণীও শোনালেন না বঙ্গ নেতৃত্বকে। বরং মমতার ভূয়সী প্রশংসা করে দলের নেতাদের বললেন, আন্দোলন করুন, সংঘর্ষ করুন। নরেন্দ্র মোদি কোলে করে কাউকে ক্ষমতার চেয়ারে বসিয়ে দেবেন না। ওটা চামচে করে খাইয়ে দেওয়া যায় না, তিলে তিলে অর্জন করতে হয়। স্মরণ করালেন, একের পর এক ইস্যু তৈরি করে কমিউনিস্টদের একসময় কীভাবে আন্দোলনের ধাক্কায় নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিলেন কালীঘাটের অগ্নিকন্যা। মার খেয়েছেন, চরম হেনস্তা হয়েছেন, সারা শরীরে আঘাত, তবু সংগ্রাম থেকে সরেননি। একটু একটু করে এগিয়েছেন। একজন মাত্র সাংসদ আর গুটিকয়েক বিধায়ক নিয়েই রাজ্য কাঁপিয়েছেন। বাইরে থেকে টাকাও আসেনি, আর হাওয়াই জাহাজে চেপে নেতা আসা তো দূর অস্ত! অমিত শাহের কথায় স্পষ্ট, ৩৫৬ ও সিবিআইয়ের জুজু দেখিয়ে বাংলায় পদ্ম ফুটবে না। বাবরি ধ্বংসের পর চার চারটি সরকার ভেঙেছিল কংগ্রেস। তারপর কী হয়েছিল? ৩৫৬ জারির পরিণাম দেশ জানে! তাই কোন্দল সামলে দিলীপ, সুকান্ত ও কাঁথির ব্যর্থ যুবরাজকে আগে আন্দোলনের যোগ্য হতে হবে, তারপর তো জয় পরাজয়ের প্রশ্ন।
অমিত শাহদের এই বোধোদয়টা যদি বিধানসভা ভোটের আগে হতো তাহলে পুরনো বিশ্বস্ত গেরুয়া সংগঠনটা অন্তত বেঁচে যেত। জাত গেল, কিন্তু পেটও ভরল না, এমন অবস্থা হতো না। জানাই ছিল, ক্ষমতার মধুভাণ্ডর কাছাকাছি যেতে না পারলে দলবদলুরা একে একে কেটে পড়বে। হচ্ছেও তাই। আর যারা প্রথম থেকে দলটা করত তারা অভিমানে বসে যাচ্ছে। এই দুই বিপরীত সিনড্রোমেই আজ বিপর্যস্ত বঙ্গ বিজেপি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে, চূড়ান্ত অযোগ্য নেতৃত্ব। যে রাজনৈতিক দলের রাজ্য সভাপতি বলেন, আমরা এই বাংলায় এখনও ক্ষমতায় আসার যোগ্যই হইনি, তাঁকে ওই পদে বসানো নিয়েই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। ওই দলের নেতারাই আবার একান্তে স্বীকার করেন, এ রাজ্যে ৪০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট বাদ দিয়ে লড়তে নেমে কোনওদিনই ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব নয়। তাহলে লড়াইয়ে টিকে থাকতে তাদের তো মিথ্যার উপর আশ্রয় করেই রাজনৈতিক ভিত্তি বাড়াতে হবে। বিভাজন আর উস্কানির পথে হাঁটা ছাড়া আর তো কোনও গতি নেই। মনে পড়ে, এই দলেরই প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি বর্তমান সম্পর্কে কটাক্ষ করে কিছুদিন আগে বলেছিলেন— ‘ওঁর আন্দোলনের তেমন অভিজ্ঞতাই নেই। রাজ্যটাকেও তেমন চেনেন না।’ আসলে দলবদলু থেকে শুরু করে পুরনো সঙ্ঘ পরিবারের আগমার্কা নেতা, কেউই এ রাজ্যে পাতে দেওয়ার মতো নয়। গ্রহণযোগ্যতাও সীমিত। সেই কারণেই মোদি-অমিত শাহরা এলে ওই সময়টুকু আলো জ্বলে। দিল্লি ফিরে গেলেই আবার সব অন্ধকার। বঙ্গে এখনও কোনও মুখ নেই তুলে ধরার মতো।
এই একটা কারণেই বিগত বিধানসভা নির্বাচনে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ১০০ আসনও জিততে পারেনি গেরুয়া শিবির। উল্টে ক্ষমতা আর টাকার লোভে কিছু স্বার্থপর নেতা ভিড় জমাতেই অমিত শাহ কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে হুঙ্কার ছেড়েছিলেন ২০০ আসন জেতার। দলটা থেমে গিয়েছে আশিরও কমে। গত নির্বাচনে বিজেপি’র মিথ্যে স্বপ্ন দেখানো ছাড়াও ভোটে জেতার প্রধান চাবিকাঠি ছিল তৃণমূলে ভাঙন ধরানো। দিল্লির নেতারা আজ বুঝে গিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে আর সেটা সম্ভব হবে না। কারণ দিল্লি থেকে ডোমজুড় হয়ে কাঁথি, প্রায় সব নেতাই স্বীকার করেন, হিসেবে মস্ত ভুল ছিল। সেই কারণেই গত বিধানসভা নির্বাচনের ফল বেরনোর পর থেকেই আবার তাঁরা কাকুতি মিনতি করে স্বস্থানে ফিরতে শুরু করে দিয়েছেন। দলের এক সর্বভারতীয় সহ সভাপতি পর্যন্ত। যাঁরা এখনও যাননি, তাঁরাও অপেক্ষায় রয়েছেন, যদি ডাক আসে।
সেই অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের ধাক্কায় নরেন্দ্র মোদির প্রধান সেনাপতিও এক বছর আসেননি। মুখ লুকিয়ে ছিলেন। পাতও পড়েনি কোনও গরিবের ঘরে। এবার এলেন, পাত উপচে পড়ল বাঙালি আইকনের সাত মহলা প্রাসাদে। গত বছর ২ মে বাংলা জয়ের স্বপ্ন বাস্তবের মাটিতে আছড়ে পড়ার পর দলের জাতীয় পর্যবেক্ষক বিজয়বর্গীয়ও পালিয়েছেন। বাংলার পথ বড় একটা আর মাড়াননি। এখন আবার লোকসভা ভোটের হিসেব কষা শুরু হয়েছে। আর সেই কারণেই ফের বঙ্গে মিথ্যা স্বপ্ন ফেরি করা শুরু হল অমিত শাহ অ্যান্ড কোং-এর। এই পর্যায়ে উত্তরবঙ্গে রাজ্যভাগের প্ররোচনা যেমন রয়েছে। তেমনি মতুয়াদের ফের নাগরিকত্বের স্বপ্ন দেখানোও পুরোদমে শুরু হয়েছে। আর কত মিথ্যা ফেরি করে চলবেন তাঁরা। গত বেশ কয়েক বছর ধরেই নাগরিকত্বের টোপ দিয়ে মতুয়াদের জনসমর্থন পাওয়ার মরিয়া চেষ্টা করে আসছে গেরুয়া শিবির। কিন্তু ভোট মিটে গেলেই সে কথা আর মনে রাখেননি দিল্লির তাবড় নেতারা। যাঁরা এ রাজ্যে ভোট দিচ্ছেন যাবতীয় সরকারি সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন, চাকরি করছেন, সংসার পাতছেন— তাদের সিএএ-র স্বপ্ন দেখানোর এ কেমন আহ্লাদ! ভোটারই যদি নাগরিক নয়, তাহলে দেশটা চালাচ্ছেন কারা? সংবিধানই তো বিপন্ন। ক্রমাগত এই বিভ্রান্তি তৈরি করছেন স্বয়ং দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এর চেয়ে বড় প্রহসন ‘অমৃত মহোৎসবের’ বছরে আর কী হতে পারে!
আসলে এও নীচ বিভাজনের রাজনীতিরই একটা অঙ্গ মাত্র। বিজেপি জানে, স্বচ্ছ মানবিক রাজনীতি করে উন্নয়নের লড়াইয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পেরে উঠতে পারবে না। ২০২১ সালের নির্ণায়ক বিধানসভা নির্বাচনেই সে কথা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। তাই লোকসভা ভোট এগিয়ে আসতেই আবার হরেক কিসিমের ললিপপ ঝোলানো শুরু হচ্ছে। সঙ্গে নেতাদের একটু আন্দোলনমুখী করে তোলার প্রয়াস। এই রাজনীতির এক হাতে রয়েছে উত্তরবঙ্গকে ভেঙে পৃথক রাজ্য গড়ার উস্কানি, রাজবংশীদের টোপ আর অন্য হাতে বনগাঁ-অশোকনগর থেকে নদীয়া সহ দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকার মতুয়া সমাজকে মিথ্যে নাগরিকত্বের প্রলোভন। এই বেছে বেছে জাতপাত আর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আড়ালে সাংগঠনিক দুর্বলতাকে কতদিন ঢেকে রাখা যাবে? অমিত শাহরাই তা ভালো জানেন, তাই বারবার সেই হতাশা বেরিয়ে আসে একান্ত আলাপচারিতায়।
এর সঙ্গেই চলছে সিবিআইয়ের জুজু দেখানোর ক্লিশে মেগা ধারাবাহিকের রিপিট টেলিকাস্ট। হিসেব বলছে, সাড়ে সাত মাসে সাতটি সিবিআই তদন্তের নির্দেশ হয়েছে এই বাংলায়। এর মধ্যে রয়েছে বগটুইকাণ্ড থেকে হাঁসখালি এবং এসএসসি’র নিয়োগ সংক্রান্ত অনুসন্ধান। কিন্তু বিগত চার দশকে ক’টা মামলায় সিবিআই নিষ্পত্তি করতে পেরেছে। সবখানেই তো সিবিআই ব্যর্থ। কবিগুরুর নোবেল প্রাইজ উদ্ধার হয়নি। বোফর্স মামলার ভূত চিরনিদ্রায়। ক’টা পরিণতি পেয়েছে! তাহলে বাংলায় কথায় কথায় সিবিআই লাগিয়ে রাখার অর্থ কী? এখন থেকে দেশের বৃহত্তম তদন্ত সংস্থা কি শুধু পশ্চিমবঙ্গেই কাজ করবে? নাকি এখানে বিজেপির আন্দোলন করার কেউ নেই বলে সিবিআইকে দিয়েই শাসক দলকে ভয় দেখানোর খেলা চলবে। নামটা বদলে সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (বেঙ্গল) করে দিলেই তো হয়। মোদি আর শাহদের কল্যাণে এও নয়া নজির হবে!
আসলে তৃণমূলের নিচুতলার কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি দুর্নীতির বিক্ষিপ্ত অভিযোগ থাকলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর উন্নয়ন ও জনহিতকর কর্মসূচির জোরে ভোট ময়দানের দৌড়ে এখনও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ঠিক যেমন বাম আমলে তাঁর গড়ে তোলা আন্দোলনের আজও কোনও বিকল্প নেই, তেমনি ক্ষমতায় এসে তাঁর জনহিতকর উন্নয়নেরও কোনও নজির নেই এই বাংলায়। তাই কুৎসা ও নেতিবাচক প্রচার সত্ত্বেও নির্বাচনী লড়াইয়ে এখনও তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ভোটের ময়দানে তা বারবার প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। এ রাজ্যে জনসংখ্যা বর্তমানে ১১ কোটির মতো। আর ভোটার তালিকায় নাম নথিভুক্ত আছে প্রায় ৮ কোটি মানুষের। তার মধ্যে পৌনে দু’কোটি মহিলা পাচ্ছেন লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা। সম্ভবত স্বাধীন ভারতে নারীর ক্ষমতায়নের এত বড় সামাজিক প্রকল্প আর কোনও মুখ্যমন্ত্রী হাতে নেননি। তাঁর কন্যাশ্রী গোটা বিশ্বে প্রশংসিত। স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের মাধ্যমেও গ্রাম থেকে শহরে গোটা পরিবারের চিকিৎসার ভার মহিলাদের হাতে। বিগত ১১ বছরে নারী ও গরিবের উত্তরণের জন্য এতরকম সামাজিক প্রকল্প ভূভারতে আর কোথাও হয়নি। তাই কোনও সুকান্ত কিংবা সেলিম সহসা ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তিতে আঁচড় দিতে পারবেন না। ক্ষমতায় আসার ১১ বছর পরেও এ রাজ্যে বাম কিংবা বিজেপি’র হাতে মমতার সমকক্ষ কোনও নেতা কিংবা নেত্রী নেই। হতাশাটা সেই কারণেই।