বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

পরাজয়ের বর্ষপূর্তিতে বিজেপির ভরসা সেই কুৎসা
তন্ময় মল্লিক

এলেন, ঘুরলেন এবং প্রাণ নিয়ে নিরাপদে দিল্লি ফিরে গেলেন। অমিত শাহের বঙ্গ সফরের ক্যাচলাইন এটাই। ‘বাংলায় গেলে খুন হয়ে যেতে পারেন’, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই কটাক্ষে বিজেপি নেতারা টেবিল চাপড়ে মজা নিলেও বাঙালির হৃদয় হয়েছিল ক্ষতবিক্ষত। এই জাতীয় মন্তব্যে রাজ্যবাসী যে আহত হন, সেটা উপলব্ধির ক্ষমতা দিল্লি বিজেপির নেই। তাই পাঞ্জাবে কৃষক আন্দোলনে আটকে পড়ায় নরেন্দ্র মোদিও বলেছিলেন, ‘প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারায় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।’ সেকথায় দলের নেতারা হাততালি দিলেও অপমানের যোগ্য জবাব দিয়েছিল পাঞ্জাব। বিজেপিকে গোহারা হারিয়েছিল। তৃতীয় দফার সরকার গঠনের বর্ষপূর্তিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বাংলার মা-বোনেদের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা দিচ্ছেন, ঠিক তখনই অমিতজি বাংলায় এসে কুৎসার ফুলঝুরি ছোটালেন। ভোটের পরে বাংলার মাটিতে প্রথম পা দিয়ে এভাবেই মেটালেন এক বছর ধরে পুষে রাখা পরাজয়ের জ্বালা। তবে, এই কুৎসার জবাব ফের পাবে বিজেপি। আর তা হবে আরও তীব্র ও তীক্ষ্ণ।
অমিত শাহের বঙ্গ সফরের আগে বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে মেনে নিয়েছেন, একুশের পরাজয়ে দলের কর্মীদের মনোবলে চিড় ধরেছে। দিল্লির নেতারা বাংলায় এলে কর্মীদের মনোবল বাড়বে। দিলীপবাবু প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিয়েছেন দিল্লির টোটকা না খেলে বঙ্গ বিজেপি চাঙ্গা হয় না। 
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের দিনেই ঝাড়গ্রাম জেলার শ’খানেক কার্যকর্তা পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। লড়াইটা আদি-নব্যের। আদিরা গুরুত্ব পাচ্ছেন না। অমিত শাহের রাজ্যে আসার দিনটিকেই ‘গণইস্তফা’ দেওয়ার জন্য বেছে নেওয়ার উদ্দেশ্য, নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণ। 
শুধু ঝাড়গ্রামে নয়, বিজেপিতে আদি-নব্যের সংঘাত গোটা রাজ্যেই। এখন বিজেপির নব্যরা আর নতুন নেই, বরং তাঁরাই নিয়ন্ত্রক। তাঁরাই ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। এসব দেখে এক আদি বিজেপির সরস মন্তব্য, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সবুজের অভিযান’ কবিতায় নবীনদের কাছে আধ মরাদের ঘা মেরে বাঁচানোর ডাক দিয়েছিলেন। আর আমাদের দলের ‘নবীন’রা আমাদের ঘা দিয়ে বাঁচানোর জায়গায় একেবারে মেরে ফেলতে চাইছে।
গত বছর ২মে ভোটের ফল প্রকাশের দিন অমিত শাহের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য মানুষের কৌতূহলের শেষ ছিল না। কারণ বাংলার নির্বাচনী উত্তাপের পারদ চড়িয়েছিলেন তিনিই। তাঁর ২০০ আসন পাওয়ার দাবিতেই রাজ্য বিজেপির কর্মীরা ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিল। বিজেপি কর্মী সমর্থকদের দাপটে কার্যত ঘরে ঢুকে গিয়েছিল শাসক দলের তাবড় তাবড় নেতাও। অনেকে স্নায়ুযুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। সেই প্রথম বিরোধী দলের ‘প্রি-পোল ভায়োল্যান্স’ দেখেছিল বাংলা। 
একুশের নির্বাচনে নাকে ঝামাঘষা খাওয়ার পর দীর্ঘদিন অমিত শাহকে বাংলার রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে দেখা যায়নি। তা বলে তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন, এমনটা বলা যাবে না। উল্টে সর্বদাই পিছন থেকে কলকাঠি নেড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে বিব্রত করেছেন। পরাজয়ের জ্বালা মেটানোর জন্য তৃণমূল সুপ্রিমোকে হেনস্তার নানা ছক কষেছেন। কিন্তু বাংলায় পা রাখেননি। এবার এলেন। আর এসেই শুরু করে দিলেন কুৎসা।
কুৎসার ফল যে ভালো হয় না, সেটা একুশের বিধানসভা নির্বাচনেই বাংলার মানুষ খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। বিশেষ করে মা, বোনেরা। তৃণমূল নেত্রীকে নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ যত বেশি ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন বাংলার মহিলারা জবাব দেওয়ার জন্য ততই জোটবদ্ধ হয়েছেন। 
তৃতীয় দফার সরকারের বর্ষপূর্তির দিনটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার সেই মা, বোনেদের উৎসর্গ করেছেন। আরও ২০ লক্ষ অ্যাকাউন্টে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা দিয়েছেন। মমতা যখন একের পর এক পরিষেবা দিয়ে তাঁর জনভিত্তি আরও মজবুত করছেন, বিজেপি নেতৃত্ব তখন পরিকল্পিতভাবে বাংলায় অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চাইছে। তার জন্য বেছে নেওয়া হল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মঞ্চ।
একের পর এক উপ নির্বাচন ও ১০৮টি পুরসভার ভোটের ফল দেখে বিজেপি নেতারা বুঝেছেন, মমতার সঙ্গে লড়াই করে জেতার দম তাঁদের নেই। তাই কখনও ৩৫৬ ধারা জারি, কখনও উত্তরবঙ্গকে আলাদা রাজ্য, কখনও সিএএ-র কথা হচ্ছে। সবই হচ্ছে বাংলাকে অস্থির করার লক্ষ্যে। অমিত শাহও জানিয়েছেন, ‘করোনার প্রকোপ কমলেই এই মাটিতে চালু হবে সিএএ।’ মতুয়ারা প্রশ্ন তুলছেন, মিটিং-মিছিল সবই যখন চলছে বিনা বাধায়, তখন নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে করোনাকে ‘ঢাল’ করা হচ্ছে কেন?
ঝিমিয়ে পড়া বঙ্গ বিজেপিকে কোনওরকমে তেকাঠির ঠেকনা দিয়ে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন মোদি সরকারের সেকেন্ড ইন কমান্ড। তিনি জানেন, বঙ্গ বিজেপির নেতাদের সব চেয়ে প্রিয় হল ৩৫৬ ধারা। সেই চাহিদার কথা মাথায় রেখে তিনি শিলিগুড়ির সভায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারির চর্চায় ঘি ঢেলেছেন।  
পেট্রল, ডিজেল, রান্নার গ্যাস, ভোজ্য তেলের অগ্নিমূল্যে গোটা দেশের মানুষ বিজেপির উপর বেজায় ক্ষুব্ধ। ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে দেওয়া প্রায় কোনও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিই বিজেপি রাখতে পারেনি। চাকরির দরজা বন্ধ হয়েছে। বেড়েছে বেকারত্ব। গরিব আরও গরিব হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ২০২৪ সালে ক্ষমতায় ফিরতে হলে বাংলা থেকেও কয়েকটা সিট বের করতে হবে। সেই জন্য নানাভাবে দলের নেতা কর্মীদের চাঙ্গা করার চেষ্টা করছেন অমিতজি।
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের নিরিখে ১২১টি বিধানসভা আসনে এগিয়ে ছিল বিজেপি। একুশের ভোটে তারা ৭৭-এ আটকে যায়। তারজন্য মেয়াদ শেষের আগেই রাজ্য সভাপতির পদ থেকে দিলীপ ঘোষকে সরিয়ে দেয়। এখন সেই ৭৭টি আসন পাওয়াকেই বড় করে দেখাতে চাইছেন অমিত শাহ। ২ লক্ষ ভোটে জেতা আসানসোল লোকসভা আসনের উপনির্বাচনের ফল দেখে বিজেপির চাণক্য টের পেয়েছেন, বাংলায় বিজেপির ভোট ব্যাঙ্কের অবস্থা ভাঁড়ে মা ভবানী। তাই হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাকেই আঁকড়ে ধরছেন।
অমিত শাহ বঙ্গে এলেন। দু’দিন থাকলেন। কিন্তু কোনও দলিতের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজ সারলেন না। বাউল গান শুনলেন না। আদিবাসী শিকারির গলায় মালাও দিলেন না। এনিয়ে কেউ কেউ টিপ্পনি কাটছেন ঠিকই। তবে দলিত বাড়িতে অন্নগ্রহণের নাটকটা আপাতত তুলে রেখেছেন নির্বাচনের জন্য। তবে, এই মুহূর্তে মৃত্যু নিয়ে রাজনীতিটাই রয়েছে অগ্রাধিকারের তালিকায়। তাই কাশীপুরে বিজেপির যুব নেতার রহস্যমৃত্যু ঘটতেই কর্মসূচি বাতিল করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চলে গেলেন ঘটনাস্থলে। শুধু গেলেন না, দলীয় নেতার মতোই তদন্তের আগেই খুনের অভিযোগ তুলে সিবিআইয়ের হাতে মামলা দেওয়ার দাবি জানালেন। অঙ্কের বিচারে ২০২১ আর ২০২২ সালের মধ্যে ফারাকটা এক বছরের। কিন্তু এই এক বছরেই বঙ্গ রাজনীতির ছবিটা আমূল বদলে গিয়েছে। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালন করে মমতা হয়ে উঠেছেন বিশ্বাস ও ভরসার প্রতীক। আর বিজেপি হাঁটছে ঠিক তার উল্টো পথে। তাই বিধানসভা নির্বাচনের আগে দিল্লির বিজেপি নেতাদের ঘিরে যে উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল, তার ছিটেফোঁটাও আজ আর নেই। ভোটের ফলেই মিলছে তার প্রমাণ।
সিএএ বা ৩৫৬ ধারা, কোনওটাই যে বঙ্গে লাগু হবে না, সেটা অমিত শাহের চেয়ে ভালো আর কেউ জানেন না। তবুও তোলা হচ্ছে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি ও নাগরিকত্বের হুজুগ। কারণ তিনি জানেন, মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্বের জ্বালা ভোলাতে পারে একমাত্র হুজুগ। তাই বাংলার মানুষকে হুজুগে মাতাতে ফের পাতা হচ্ছে নাগরিকত্বের ‘ফাঁদ’।

7th     May,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ