বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

জাতীয় রাজনীতিতে বাঙালির প্রতি অবহেলা কেন?
সমৃদ্ধ দত্ত

পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ডক্টর হরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন অত্যন্ত সরল মনের মানুষ। তাঁকে প্রায় জোর করেই রাজ্যপাল করা হয়েছিল। তাঁর নিজের বাড়ি ডিহি শ্রীরামপুর। কিন্তু একবছর পরই তাঁকে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু মহারাষ্ট্রে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্দেশিকা দেন। হরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ডিহি শ্রীরামপুর 
থেকে আসতে চাননি কলকাতায় রাজভবনে। 
সুতরাং মহারাষ্ট্রে যাওয়ার তো প্রশ্নই নেই। সেকথা জানিয়ে তিনি নেহরুকে চিঠি লিখতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই তাঁকে নিরস্ত করে মুখ্যমন্ত্রী ডক্টর বিধানচন্দ্র রায় ছোট্ট চিঠিতে জওরলাল নেহরুকে জানিয়ে দিলেন, আমরা এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালকে ছাড়তে পারব না। আপনি অন্য কোনও রাজ্যপালকে মহারাষ্ট্রে পাঠান। অর্থাৎ বিধানচন্দ্র রায় দেশের প্রধানমন্ত্রী তথা কংগ্রেসেরও অলিখিত সর্বোচ্চ নেতাকে মুখের উপর জানিয়ে দিলেন আমরা রাজ্যপালকে ছাড়ছি না। 
তিনি নিজে কোনওদিনই দিল্লির জো হুজুর হননি। পক্ষান্তরে তাঁকে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দিল্লিতে জওহরলাল নেহরু মাঝেমধ্যেই ডেকে পরামর্শ নিতেন। 
গুলজারিলাল নন্দ ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। একবার কলকাতায় এলেন। দমদম এয়ারপোর্টে স্বাভাবিক প্রোটোকল হিসেবে তাঁকে রিসিভ করতে গাড়ি নিয়ে যান রাজ্য সরকারের মন্ত্রী বিজয় সিং নাহার। কিন্তু গুলজারিলাল সমস্যায় পড়লেন। কারণ, তাঁকে নিতে নিজের গাড়ি নিয়ে এসেছেন শিল্পপতি বিড়লাসাহেবও। গুলজারিলাল নন্দ স্থির করেন বিড়লার গাড়িতেই যাবেন। এদিকে বিজয় সিং নাহার মুখে কিছু না বললেও থমথমে মুখে ফিরে আসেন রাইটার্স বিল্ডিংসে। অন্যান্য মন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন জানতে চান কী হয়েছে? বিজয় সিং নাহার ঘটনাটি জানান। কংগ্রেস সরকারের মন্ত্রীরা ও প্রফুল্লবাবু প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন। সেদিনই দুপুরে চেম্বার অফ কমার্সে গুলজারিলাল নন্দের একটি মিটিং ছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোনও মন্ত্রী সেই অনুষ্ঠানে গেলেন না। গুলজারিলাল নন্দ প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ ও অপমানিত। তিনি জাতীয় কংগ্রেসের সিনিয়র নেতা শুধু নন, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অথচ তাঁর অনুষ্ঠান বয়কট করেছে বাংলার মন্ত্রীরা? 
যেখানে বাংলায় চলছে কংগ্রেসেরই সরকার! তাঁকে কারণটা জানিয়ে দেওয়া হয় যে, বাংলার সরকারের পাঠানো গাড়ি প্রত্যাখ্যান করে তিনি ভুল করেছেন। অতঃপর বিষয়টি অনুধাবন করে গুলজারিলাল নন্দ বিজয় সিং নাহারের কাছেই দুঃখপ্রকাশ করেন। 
অতুল্য ঘোষকে জনান্তিকে জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, আচ্ছা লালবাহাদুরকে ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার করলে কেমন হয়? অতুল্য ঘোষ সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন, আমি তো খুব খুশি হব। আমার সঙ্গে তাঁর কেমন সম্পর্ক সেটা তো আপনি জানেন। প্রধানমন্ত্রী জহওরলাল  নেহরু বললেন, ঠিক আছে। তবে এখনই কারও সঙ্গে আলোচনা করবে না। কিন্তু মন্ত্রিসভার কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলার পর বিষয়টি হঠাৎ সংবাদপত্রে ফাঁস হয়ে যায়। 
আর তারপর জটিলতায় প্রস্তাবটি ভেস্তে যায়। জওহরলাল কিন্তু সর্বাগ্রে জানতে চেয়েছিলেন অতুল্য ঘোষের কাছেই। 
জম্মুতে ঢোকার প্রাক্কালে তাঁর সর্বক্ষণের রাজনৈতিক সচিবকে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, তুমি এখান থেকে ফিরে যাও। আমি যা যা নির্দেশ দিয়েছি, সেইমতো ফাইল তৈরি করে, 
প্রচার পুস্তিকাগুলি লিখে প্রচারের জন্য পাঠিয়ে দিও সর্বত্র। এরপর জম্মুতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্রবেশ করেন এবং জেলবন্দি হন। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সেই রাজনৈতিক সচিবের নাম ছিল অটলবিহারী বাজপেয়ি। বাজপেয়ির রাজনৈতিক গুরু শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ই। 
এসব প্রসঙ্গ উত্থাপনের কারণ হল, হঠাৎ বেশ কিছু বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, জাতীয় স্তরের রাজনীতিতে আর বাঙালি নেতা নেই। বাঙালি রাজনৈতিক নেতানেত্রী কোনও জাতীয় স্তরের দলে এখন আর গুরুত্ব পাচ্ছেন না। কারও নামই শোনা যায় না।  জাতীয় রাজনৈতিক দল প্রধানত দুটি। কংগ্রেস এবং বিজেপি। এই দুই দলেই সরাসরি নীতি নির্ধারণের সঙ্গে যুক্ত বাঙালি নেতা নেই। কোনও দলই কোনও বাঙালি নেতাকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তুলে আনছে না। সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহেরা তাঁদের দলের উচ্চ পদাধিকারী কোনও বাঙালি রাজনীতিকের কাছে পরামর্শ চাইছেন কিংবা কোনও বাঙালি নেতানেত্রী এই দলগুলিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন এরকম আর ভাবাই যায় না। সেরকম কেউ নেইও। 
অথচ এই নিবন্ধের সূচনায় যে কাহিনিগুলির স্মৃতিচারণ করা হল, সেটা থেকে স্পষ্ট যে বাঙালি রাজনীতিবিদদের আগে দিল্লির কাছে কতটা গুরুত্ব ছিল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ থেকে শুরু হওয়া সেই প্রবণতা এই ১০ বছর আগেও প্রণব মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত বজায় ছিল। আজকের জাতীয় দলগুলিতে সেই গুরুত্ব পায় না কোনও বাঙালি নেতা। 
জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একমাত্র বাঙালি প্রতিনিধি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তিনি তো নিজের দলের সর্বোচ্চ নেত্রী। গোটা দেশের এক ও একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। সেই প্রেক্ষিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুরুত্ব জাতীয় স্তরে এখন অনেক বেশি। কিন্তু তাঁর পর আর বাঙালি রাজনীতিক হিসেবে কোনও নেতানেত্রীই জাতীয় স্তরে সাড়া জাগানো গুরুত্ব পাওয়ার মতো যোগ্য হয়ে উঠতে পারছেন না। কংগ্রেস অথবা বিজেপি তাদের দলে থাকা বাঙালি নেতানেত্রীদের প্রথম সারিতে স্থানই দেয় না। অধীর চৌধুরী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে আছেন। লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, দলের সামগ্রিক নীতি নির্ধারণের সঙ্গে তাঁকে যুক্ত করা হয় না। 
 কংগ্রেসে যেমন বাঙালি নেতানেত্রীকে আর জাতীয় মঞ্চে দেখা যায় না, তেমনই বিজেপির ক্ষেত্রেও একই দৃশ্য। কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণ মঞ্চ হল, ওয়ার্কিং কমিটি। সেখানে কোনও বাঙালি নেই। অধীরবাবু স্থায়ী আমন্ত্রিত সদস্য। কিন্তু ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নয়। বিজেপির সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কমিটির নাম সংসদীয় বোর্ড। সেখানে বহু বছরই কোনও বাঙালি নেতার স্থান হয়নি। আট বছর হয়ে গেল। মোদি সরকারের মন্ত্রিসভায় একজনও বাঙালি পূর্ণমন্ত্রী নেই। কোনও দলের মুখপাত্র তালিকায় বাঙালি নেতা নেই। 
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫ তম জন্মজয়ন্তী এল এবং চলে গেল। যে নেতাজিকে নিয়ে বর্তমান শাসকদল অনেক গালভরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তাদের থেকে নেতাজির এই ১২৫ তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলা কী পেয়েছে? শ্রীঅরবিন্দ ঘোষের দেড়শোতম জন্মজয়ন্তী চলছে এই বছর। 
এই মনীষীদের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমাদের রাজ্যে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়, রিসার্চ সেন্টার, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আধ্যাত্মিক কেন্দ্র ইত্যাদি গড়ে তোলা যেত না কেন্দ্রীয় প্রকল্প হিসেবে? কই, একটাও তো হল না! জাতীয় স্তরের দলগুলির কাছে বাংলার প্রতি অনীহা এবং উদাসীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে কেন?

6th     May,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ