বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

এখনও রাজনৈতিক মূল্য চোকাতে হয়নি
পি চিদম্বরম

ভিন্ন সুরের গানের কণ্ঠ শুনতে পেলে ভালো লাগে। একসময়ের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, ডঃ অরবিন্দ সুব্রামনিয়ান বর্তমানে ব্রাউন ইউনিভার্সিটিতে ওয়াটসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের সিনিয়র ফেলো। তাঁর পাণ্ডিত্য আমাদের চমৎকৃত করে, তিনি বহু প্রশংসিত এবং বহুমুখী বিষয়ের লেখক। গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত তাঁর বিদেশ বিষয়ক এক নিবন্ধে ডঃ সুব্রামনিয়ান দেখেয়িছেন, ‘আত্মনির্ভর ভারত’ ট্যাগলাইনে সরকার যে আর্থিক নীতি নিয়ে চলছে তাতে ত্রুটি রয়েছে। 
বহুবিধ উদ্বেগ
ডঃ সুব্রামনিয়ানের কাছে সর্বাধিক তিনটি উদ্বেগ হল: ভর্তুকি (বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের বিক্রয় নিয়ন্ত্রণের জন্য গৃহীত), সরক্ষণনীতি এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তিগুলি এড়িয়ে চলা। তাঁর অন্য উদ্বেগগুলির মধ্যে রয়েছে: সন্দেহজনক তথ্যাদি, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতি বিরুদ্ধভাব, সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যবাদ এবং স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলিকে দুর্বল বা গৌণ করা। প্রায় চারবছর পর, ২০১৮ সালে তিনি কেন সরকারকে ছেড়ে গিয়েছিলেন, তখন তো সরকার তাঁর সঙ্গে কাজ করতে স্বচ্ছন্দই বোধ করছিল? ডঃ সুব্রামনিয়ান, তাঁর অজান্তেই, কারণগুলি খোলসা করে ফেলেছেন। তিনি খুশি ছিলেন না এবং সম্ভবত অনুমান করেছিলেন যে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
পরিস্থিতি সত্যিই খারাপ হয়ে গিয়েছে। ইউপিএ সরকারের আমলে যে গড় শুল্ক প্রায় ১২ শতাংশ ছিল তা এখন বেড়ে ১৮ শতাংশ হয়েছে। সেফগার্ড ডিউটিজ, অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিউটিজ এবং নন-ট্যারিফ ব্যবস্থাগুলির প্রয়োগ চলছে নির্বিচারে। বহুপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি থেকে দূরে সরে গিয়েছে ভারত। অথচ এই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থা থেকে দেশ বিপুল পরিমাণে, বিশেষভাবে লাভবান হতে পারত। এটাই হাস্যকর যে নরেন্দ্র মোদি যখন রাজনৈতিক-প্রতিরক্ষাযুক্ত বহুপাক্ষিক নানাবিধ চুক্তির কৌশলে প্রবেশ করতে চাইছেন, তিনি তখনই বাণিজ্য চুক্তিগুলির বিরোধী অবস্থানে রয়েছেন। ওই পলিটিকো-ডিফেন্স মাল্টিল্যাটারাল প্যাক্টস-এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—জেনারেল সিকিউরিটি 
অব মিলিটারি ইনটেলিজেন্স এগ্রিমেন্ট (জিএসওএমআইএ), কমিউনিকেশনস কমপ্যাটিবিলিটি অ্যান্ড সিকিউরিটি এগ্রিমেন্ট (সিওএমসিএএসএ), কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ (কিউইউএডি বা কোয়াড), সেকেন্ড কোয়াড, রেসিপ্রোকাল এক্সচেঞ্জ অব লজিস্টিকস (আরইএলওএস) এগ্রিমেন্ট উইথ রাশিয়া। 
ভারত সরকারের আর এক একদা অর্থনৈতিক উপদেষ্টারও মোদির আর্থিক নীতির প্রতি মোহভঙ্গ ঘটেছে। ডঃ অরবিন্দ পানাগরিয়া বর্তমানে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির প্রফেসর। তার আগে তিনি ছিলেন নীতি আয়োগের ভাইস-চেয়ারপার্সন। দি ইকনমিক টাইমস-এর সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে সরকারের গুণগান গেয়েও তিনি জায়গামতো হুল ফুটিয়েছেন। তিনি লিখেছেন: ‘... মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে অর্থনীতিকে অবশ্যই আরও ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি উচ্চ শুল্ক ধার্য করার নীতি থেকে সরে আসতে হবে। উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার সংশোধন জরুরি। এজন্য একটি আধুনিক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে মান্ধাতাগন্ধী ১৯৫৬ সালের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আইনটিকে সরাতে হবে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের ক্ষেত্র বিস্তৃত করা দরকার। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির (পিএসইউ)  বেসরকারিকরণে অবশ্য করে গতিসঞ্চার করতে হবে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির (পিএসবি) ক্ষেত্রেও এটা শুরু হওয়া দরকার।’   
যাই হোক, কয়েক বছর আগে পর্যন্তও ডঃ অরবিন্দ সুব্রামনিয়ান এবং ডঃ অরবিন্দ পানাগরিয়া সরকারের অন্দরমহলের মানুষ ছিলেন। তাঁরা দু’জনেই উদারনীতির সমর্থক অর্থনীতিবিদ। তাঁরা নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেন। অর্থনীতির যে মডেল বেসরকারি ক্ষেত্রের নেতৃত্বকে মান্যতা দেয় তাঁরা সেই মডেলের সমর্থক। অর্থনৈতিক নীতিগুলির ত্রুটিসমূহ চিহ্নিত করতে দ্বিধা করেননি কিন্তু তাঁরা সেই ত্রুটিগুলির বিপর্যয়কর পরিণতির তালিকা করতে নারাজ। 
ভয়াবহ পরিণতি
এই কলামের পাঠকরা জানেন কী কী পরিণতি হয়েছে: 
> অনেক দরিদ্র মানুষের একটি দেশে মাথাপিছু আয় হ্রাস পেয়েছে।
> বেড়ে গিয়েছে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি, বৃদ্ধির সমস্যা এবং স্বাস্থ্যহানি। 
> গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স বা বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারত ৯৪ র‌্যাঙ্ক থেকে ১০৪ র‌্যাঙ্কে (১১৬টি দেশের মধ্যে) নেমে গিয়েছে। 
> নোট বাতিল, ছোট ও মাঝারি শিল্প-বাণিজ্য উদ্যোগের (এমএসএমই) প্রতি যথেষ্ট নজরা না-দেওয়া, গরিবদের হাতে নগদ অর্থ দিতে রাজি না-হওয়া এবং মহামারী মোকাবিলায় ব্যর্থতার কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষকে দারিদ্রের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। 
> বেকারত্বের হার (সিএমআইই-র হিসেবে, শহরে ৮.৪ শতাংশ, গ্রামাঞ্চলে ৬.৪ শতাংশ) ঊর্ধ্বমুখী।
> দেখা দিয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি (সিপিআই বা উপভোক্তা মূল্য সূচক ৫.৬ শতাংশ)। 
> দেশে চালু রয়েছে উচ্চ পরোক্ষ কর ও লোভনীয় প্রত্যক্ষ কর এবং ত্রুটিপূর্ণ জিএসটি।
> পেট্রল, ডিজেল এবং রান্নার গ্যাস (এলপিজি) বিক্রয় ব্যবস্থা মুনাফামুখী।  
> লাইসেন্স-পারমিট ব্যবস্থার জমানা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। 
> মনোপলি বা একচেটিয়া কারবারের উত্থান ঘটেছে।
> পুঁজিবাদ-প্রীতি বাড়ছে। 
> শীর্ষ শ্রেণির ব্যবসা, প্রকৌশল, চিকিৎসা এবং বিজ্ঞানের প্রতিভারা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। 
ভুল নীতি এবং তার পরিণতির জন্য জনগণ অর্থনৈতিক মূল্য বহন করলেও, মোদি সরকারকে এখনও তার রাজনৈতিক মূল্য বহনের মতো বিপাকে ফেলা হয়নি। আমরা জানি, লাখো লাখো গরিব শ্রমিক বাড়ি ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন সঙ্গে সামান্য টাকা, খাবার এবং ওষুধপত্র ছাড়াই। রোগীদের জন্য অক্সিজেন, ওষুধ, অ্যাম্বুলেন্স ছিল না। হাসপাতালগুলিতে ছিল না পর্যাপ্ত শয্যা। এমনকী, শ্মশান এবং কবরস্থানেও দেখা গিয়েছে ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই’ ছবি—বড় মর্মান্তিক সে দৃশ্য! কোভিড-১৯-এর কারণে মৃত অগণিত মানুষের জন্য কোনও সার্টিফিকেট দেওয়া হয়নি। হাজার হাজার লাশ গঙ্গায় ভাসতে দেখা গিয়েছে অথবা সেসব পড়েছিল নদীতীরে! লক্ষ লক্ষ শিশুর শিক্ষা যখন জলাঞ্জলি যাচ্ছে ঠিক তখনই নির্দেশ জারি করা হল স্কুলগুলি বন্ধ করার জন্য। ক্রমে বাড়ছে বেকার যুবদের সংখ্যা। কোভিড পরিস্থিতিতে এই যে অসহনীয় দুর্দশার মধ্যে দেশকে ফেলা হল অন্যকোনও উদার গণতন্ত্রে এই কাণ্ড ঘটলে সরকার বাঁচানোই দায় হয়ে পড়ত। এখানে সরকার নির্বিকারভাবে চলতে অভ্যস্ত, সংসদে বিতর্কের সামনে ঝাঁপ বন্ধ করে দেয়, প্রাচীন অনড় নীতির অনুসারী এবং জনগণকে চমকে দেয় রাষ্ট্রের মদতপুষ্ট ধর্মীয় চশমা পরিয়ে দিয়ে।
ক্রমবর্ধমান অবিচার
এদিকে, অন্যায় এবং অসমতার সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে বৈষম্য। এল চ্যান্সেল, টি পিকেটি এবং অন্যদের দ্বারা রচিত বিশ্ব বৈষম্য রিপোর্ট ২০২২ এস্টিমেট দিয়েছে যে,  ভারতের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার শীর্ষ ১০ শতাংশ জাতীয় আয়ের ৫৭ শতাংশ কুক্ষিগত করেছে। আর, নীচের দিকের ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে আছে মাত্র ১৩ শতাংশ অর্থ। জাতীয় আয়ের ২২ শতাংশ রয়েছে একদম উপরের দিকের ১ শতাংশ মানুষের পকেটে। গত রবিবার প্রকাশিত অক্সফাম রিপোর্টে এই বিষাদময় উপসংহারের সমর্থন মিলেছে। অক্সফাম রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, শীর্ষস্থানের ১০ শতাংশ মানুষের কাছে রয়েছে দেশের মোট সম্পদের ৭৭ শতাংশ! ভারতীয় বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা ১০২ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪২। কখন? যখন (২০২১ সালে) ৮৪ শতাংশ পরিবারের আয় কমে গিয়েছে। বিলিয়নেয়ারদের সম্পদের পরিমাণ ২০২০ সালের মার্চে ছিল ২৩.১৪ লক্ষ কোটি টাকা। সেটা ২০২১ সালের নভেম্বরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩.১৬ লক্ষ কোটি টাকা। আর ঠিক এই সময়ে ৪ কোটি ৬০ লক্ষাধিক মানুষ পড়েছেন চরম দারিদ্রের মধ্যে। 
বাজেট (২০২২-২৩) ঘোষণার বাকি আর কয়েকটি দিন। যদি সরকার ধরে নেয় যে তারা ‘টেফলন-কোটেড’ (বিশেষ সুরক্ষাপ্রাপ্ত), অতএব কর্মপদ্ধতি পরিবর্তন করার কোনও দরকার নেই, তবে এটি একটি ট্র্যাজেডিই হবে। একটি নির্বিকার সরকারের সামনে একমাত্র চাবুক হল তার রাজনৈতিক মূল্য চোকানোর রক্তচক্ষু। 
 লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত

24th     January,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ