গোটা পৃথিবীর রাতের ঘুম কেড়েছে ওমিক্রন। সংক্রমণ লাগামছাড়া, ডেল্টার তুলনায় ৩৫ শতাংশ বেশি। মানবশরীরে ডেল্টার তুলনায় পাঁচগুণ দ্রুতগতিতে বংশবিস্তার শুরু করে ওমিক্রন। ওমিক্রনের ‘আরনট’ বর্তমানে ১০-এর (ল্যানসেট রেসপিরেটরি মেডিসিন, ১৭ ডিসেম্বর ২০২১) বেশি। হাম বা মিজলস-এর মতোই ছোঁয়াচে ওমিক্রন। ওমিক্রন কি খেল দেখাতে পারে তার আগাম হদিশ পেতে গবেষণাগারের কৃত্রিম পরিবেশে ‘সিউডোভাইরাস’ এবং ‘হ্যামস্টারের’ (ধেড়ে ইঁদুর গোত্রের প্রাণী) শরীরের ওপরেই চলছে যাবতীয় গবেষণা, অনুসন্ধান। দেখা যাচ্ছে, হ্যামস্টাররা দুর্বল হয়ে পড়লেও, সামান্য জ্বরজ্বালা ছাড়া ফুসফুস বিকল হয়ে দুরারোগ্য অসুস্থতায় আক্রান্ত হচ্ছে না। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ইতর শ্রেণির প্রাণী হ্যামস্টারের কিছু হচ্ছে না বলে মানুষও কি ততটাই নিরাপদ?
গত কয়েক সপ্তাহের গবেষণা বা হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ওমিক্রন রোগীদের হালচালে স্পষ্ট ডেল্টার মতো ফুসফুসের ক্ষতি ওমিক্রন অদ্যপি করে উঠতে পারেনি। এসিই-টু রিসেপ্টরকে পাকড়ে আলফা/ডেল্টা মানবকোষে হানাদারি চালাত টেমপ্রেস-টু নামে একটি প্রোটিনকে ছলাকলায় ভুলিয়ে বিপথগামী করে। বিভীষণের মতো নভেলকরোনাকে মানবকোষে প্রবেশের গোপন খিড়কির দরজা দেখিয়ে মানবশরীরের সঙ্গে চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা করত টেমপ্রেস-টু। স্পাইক-প্রোটিনের ৩২টি মিউটেশনে, টেমপ্রেস-টুকে এড়িয়ে ওমিক্রন সরাসরি হানা দিচ্ছে মানবশরীরে। আলফা/ডেল্টার মতো ‘ক্যাথেপসিন’ উৎসেচকের ঘাড়ে চেপে চুপিসারে সিঁধ কেটে ওমিক্রন মানবকোষের এন্ডোজোমেও ঢুকতে পারছে না। ওমিক্রনের অস্বাভাবিক মিউটেশনে তৈরি ‘ইডি-সিক্সটিফোর’ নামে একটি যৌগ বাধ সাধছে সেখানেও। ফলে ফুসফুসের বদলে ওমিক্রন আক্রমণ শানাতে বাধ্য হচ্ছে মুখ এবং গলায়।
গলায় বাসা বাধা এবং ত্বরিতগতিতে বংশবিস্তার করায় সাধারণ কথাবার্তা, এমনকী মাস্কবিহীন হাইতোলার মাধ্যমেও অতিদ্রুত আশপাশের বহু মানুষকে পেড়ে ফেলছে ওমিক্রন। তিন দিনের মধ্যেই ভাইরাল লোড সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছচ্ছে। মানুষের ফুসফুসে এসিই ও টেমপ্রেস-টুর প্রভূত প্রাচুর্য। টেমপ্রেস-টু চম্পট দেওয়ায়, ফুসফুসের এসিই-টুকে খাবলে ধরতে না পেরে ওমিক্রন ফুসফুসের বারোটা বাজাতে পারছে না। ‘সিঙ্কসিশিয়া’ বা গুচ্ছ কোষের ‘প্লাক’ তৈরি না হওয়ায় ফুসফুসের অক্সিজেন সংবহনও ব্যাঘাত প্রাপ্ত হচ্ছে না। প্রাপ্তবয়স্ক ওমিক্রন রোগীদের তাই অক্সিজেন এবং আইসিইউ-র ঘানি প্রায় টানতে হচ্ছে না। কমবয়সি বা শিশুদের কিছুটা ঝামেলায় ফেলছে ওমিক্রন। আপার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট, মুখ-গলায় ওমিক্রন পাখা মেলায়, শিশুরা ব্রঙ্কাইটিস, ক্রুপ বা শুকনো কাশি ও শ্বাসকষ্টের সমস্যায় বেশি ভুগছে। সঙ্কটজনকও হয়ে পড়ছে। নাকে বা গলায় কাঠি ঢুকিয়ে শিশুদের আরটিপিসিআর বা র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট করাও মুশকিল।
টেমপ্রেস-টুর আধিক্যের কারণে নাকের শ্লেষ্মারসে ওমিক্রনের দেখা মিলছে না। নাকের কোষকলার কোনও ক্ষতি ওমিক্রন করতে না পারায় গন্ধের অনুভূতিও (এনসমিয়া) থাকছে অটুট অবিকৃত। সঙ্গতকারণে গলা বা মুখের লালারস পরীক্ষাতেই কেবল হদিশ মিলছে ওমিক্রনের। নামকরা র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট কিট অ্যাবটের ‘বাইন্যাক্স-নাউ’-এর ‘স্পেসিফিসিটি’ ৯৮.৫% (ফলস পজিটিভ ১.৫) ও ‘সেনসিটিভিটি’ নাকি ৮৪.৬% (ফলস নেগেটিভ ১৫.৪%)। সিডিসি-র তদন্তে ধরা পড়েছে বাইনাক্স-নাউ ৬৪.২% মাত্র ‘সেনসিটিভ’। অর্থাৎ বাইনাক্স-নাউ ৩৫.৮% কোভিড রোগীকে নির্দ্বিধায় বলছে কোভিডমুক্ত। ফলস পজিটিভে ক্ষতি নেই, কিন্তু ৩৫.৮% ফলস নেগেটিভ করোনা অতিমারীতে নিঃসন্দেহে, ঘৃতাহুতি দেবে। সিডিসি-র মতো কোনও নজরদার সংস্থার অভাবে ভারতে র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের ফলাফল তাই সন্তোষজনক নয় মোটেই! আরটিপিসিআরের ‘জিনোম সিকোয়ন্সিং’, সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল হলেও ওমিক্রন শনাক্তকরণে নির্ভরযোগ্য। ভারতে ৭ দিন বিচ্ছিন্ন বাসের পরে কোনও পরীক্ষা ছাড়াই আক্রান্তকে মুক্তকচ্ছ হয়ে ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অ্যান্টিজেন পরীক্ষায় অন্তত দেখে নেওয়া যেতেই পারত ছাড়া পাওয়া ব্যক্তিটি তখনও সংক্রামক কি না!
বিশ্বের যাবতীয় ওমিক্রন সংক্রান্ত গবেষণা এখনও শৈশবে টলমল। সেই সমস্ত গবেষণার ওপর ভিত্তি করে তড়িঘড়ি কোনও অনুসিদ্ধান্তে না আসাই মঙ্গল। ওমিক্রনকে হালকাভাবে না নেওয়ার জন্য বিশ্ববাসীকে সতর্ক করেছেন ‘হু’ প্রধানও। তাঁর আশঙ্কার অন্যতম কারণ, ওমিক্রন পূর্বের কোভিড সংক্রমণজাত অ্যান্টিবডি বা ভ্যাকসিনজাত ‘নিউট্রালিজিং অ্যান্টিবডি’র কড়া নজরদারিকেও অক্লেশে এড়িয়ে মানুষকে হামেশাই বিপদে ফেলছে। রক্ষে একটাই, অসুস্থতা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছচ্ছে না এখনও। বয়স্ক বা রোগভোগের প্রাক-ইতিহাস না থাকলে ওমিক্রনের অব্যর্থ উপসর্গ, ঘুষঘুষে জ্বর, গা গুলোন, বমি ভাব, ডায়রিয়া, জলশূন্যতা, গলা জ্বালা ও শুকনো কাশিতে অহেতুক ভয় পাওয়া নিষ্প্রয়োজন।
যদিও মহামারী বিদ্যার পাঠ্যপুস্তকের বিধিসম্মত সতর্কীকরণ: মাত্রাতিরিক্ত সংক্রমণে অসুস্থতা বাড়লে, হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে মৃত্যুহারও। আত্মতুষ্টি ব্যতিরেকে, সর্বাগ্রে সতর্ক, সচেতন, সাবধান হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কোনও ভাইরাসের ভীমপ্রলয়ী হয়ে ওঠার সম্ভাবনার পূর্বাভাস মেলে ভাইরাসটির সংক্রমণ প্রবণতা এবং তার রোগসৃষ্টির ক্ষমতা দেখে। ওমিক্রন ভয়ঙ্কর সংক্রামক হলেও আপাতদৃষ্টিতে নয় ততটা বিপজ্জনক। কিন্তু খুব সামান্য সংখ্যক মানুষও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে, ভারতের পক্ষে তা অশনিসঙ্কেত। ভারতে খাতায়-কলমে আইসিইউ বেডের সংখ্যা ৭৫৮৬৭টি হলেও, ২০২০সালের ২৯ ডিসেম্বর সেই আইসিইউ বেডের সংখ্যা সরকারি হিসেবেই কমে হয়েছে ৪০,৪৮৬টি। ভেন্টিলেটরের সংখ্যা ভারতে ৪০৬২৭টি মাত্র। ডিসেম্বর ২৯, ২০২০-তে অক্সিজেন-পোষিত শয্যার সংখ্যা ছিল ২৭০৭১০টি। ২০২১-এর ২৮ জানুয়ারি সেই শয্যা সংখ্যা কমে হল ১৫৭৩৪৪টি। শতাংশের হিসেবে এক মাসে একধাক্কায় অক্সিজেন-যুক্ত শয্যা ৪২ শতাংশ কমে গেল। ১১% আইসিইউ বেড ও ৪২% ভেন্টিলেটর হ্রাসপ্রাপ্ত হল। ১৩৮ কোটি ভারতবাসীর ১ শতাংশ বা ১ কোটি ৩৮ লাখ অভাগাকেও ওমিক্রন যদি কোনওভাবে বেকায়দায় ফেলে তাদের অধিকাংশের পক্ষেই আইসিইউ বেড জোটানো দুষ্কর।
সুপরিকল্পিত সর্বজনীন টিকাকরণে অসুস্থতা বা সংক্রমণ বাধ মানত। বিভিন্ন হিসাব থেকে প্রতিভাত, ভারতে প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ আজও টিকাবিহীন। টিকাবিহীন ৫০ শতাংশ মানুষের সৌজন্যে বুস্টার বা গালভরা ‘পরীক্ষণ ডোজের’ নকল বুঁদির গড় ওমিক্রন সুনামিতে খড়কুটোর মতো ভেসে যেতে বাধ্য। হঠাৎই ১২ থেকে ১৮বছরের পরিবর্তে কেন ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সিদের টিকাকরণ শুরু করা হল তারও নেই কোনও সদুত্তর! জাইকোভ-ডির সফল ট্রায়ালের পর কেনই বা কোভ্যাকসিনকে ১৫—১৮র জন্য বাছা হল? ফাইজারের অত্যুৎকৃষ্ট এমআরএনএ ভ্যাকসিনটিকে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের ছাড়পত্র দেওয়ার পরেও কেন ভারতের বাজারে আজও তা অমিল? কেনই বা মোদিজি ‘বেলর কলেজ অফ মেডিসিন’ ও ‘টেক্সাস চিলড্রেন’স সেন্টার ফর ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্টে’র ‘প্রোটিন সাবইউনিট টেকনোলজিতে’ তৈরি ‘করবিভ্যাক্সের’ মতো আনকোরা, কিয়দংশে অপরীক্ষিত (মাত্র ৩০০০ জনের উপর ট্রায়াল চলেছে) পিছড়েবর্গের একটি ভ্যাকসিন ভারতবাসীকে কোভিড কালবেলায় উপহার দিতে গেলেন? সরকারের ঘোলা জলে মাছ ধরার বরাবরের কুঅভ্যাসকে পাশে সরিয়ে সতর্ক সচেতন মানুষকে স্ব-উদ্যোগে টিকা নিয়ে, কোভিড স্বাস্থ্যবিধিকে সুচারুভাবে মেনেই খেদাতে হবে ওমিক্রন। রুখতে হবে লকডাউন।
লেখক অতিমারী বিশেষজ্ঞ, গিলিংস স্কুল অফ গ্লোবাল পাবলিক হেলথ, ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলিনা। মতামত ব্যক্তিগত