বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

নেমে আসুক সেই
উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের আলো
সন্দীপন বিশ্বাস

চারিদিকে যেন এক ঘনায়মান আঁধার। সেই আঁধারের ভিতরে, মহামারীর ধ্বংসের মধ্যে, আমাদের ভাঙাচোরা মননের মধ্যে, আমাদের ঘিরে ধরা অবসাদের মধ্যে নেমে আসুক সেই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের আলো। সেই আদিত্যবর্ণের পুরুষের জীবন ও বাণীর মধ্যে যে উজ্জ্বল পথের সন্ধান আছে, যে ধ্রুবতারার আলোকরেখা আছে, তা আমাদের জীবনে নেমে এসে নতুন পথের সন্ধান দেখাক। আমাদের জীবনে প্রশান্তির বাণী এনে দিক। তাঁর জীবন ও বাণী যেন আমাদের ভারত আত্মার অন্তরে প্রজ্জ্বলিত অনন্ত দীপশিখার মতো। তিনি হলেন বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ। আজ এই আঁধারে গুরুর মতো পথ দেখাতে পারেন তিনি। 
কিন্তু আজকের এই পারিপার্শ্বিক অবস্থা আর মনের বিকাশ দেখে বোঝা যায়, তাঁকে আমরা পথ প্রদর্শক করে তুলতে পারিনি। ভক্তির আড়ম্বর আর পুজোর ছলে তাঁকে ভুলেই থেকেছি। সেই মিথ্যা পুজোর ফাঁক দিয়ে নেমে এসেছে গাঢ় অন্ধকার। যেমন মানুষ ও সমাজ গড়ার কথা তিনি বলেছিলেন, আমরা তার থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। এখান থেকে ছুড়ে দেওয়া ফুল পৌঁছয় না তাঁর চরণে। স্বামী বিবেকানন্দ আসলে ছিলেন একজন সমাজবিজ্ঞানী। তাঁর সমাজবিজ্ঞানের ভিত্তি ছিল ইতিহাস। ইতিহাসের ধারা ও তার বিবর্তনের গতিপথ বিশ্লেষণ করেই তিনি তাঁর ভাষ্যকে তুলে ধরেছেন। সেই সমাজতত্ত্বের বিশ্লেষণের মধ্যে একজন যুক্তিবাদী মন সব সময় প্রকাশ পেয়েছে। সেই যুক্তিবাদের সঙ্গে মিশেছিল মানবপ্রেম ও মানুষের কল্যাণ ভাবনা। আবার সমাজ কল্যাণের লক্ষ্যে তিনি ধর্মতত্ত্বের কথাও বলেছেন। কেননা বিজ্ঞানের ভিতরে, সমাজের ভিতরে, আত্মিক বোধের ভিতরে সেই ধর্মের বোধটুকু না থাকলে কখনওই সমাজের মঙ্গল হতে পারে না। কিন্তু আজ আমরা প্রতিদিন যে ধর্মের মুখোমুখি হই, সেই ধর্মের সঙ্গে স্বামীজি কথিত ধর্মের আকাশ-পাতাল তফাৎ। স্বামীজি আজকের ধর্মের এই কূপমণ্ডূকতার ভাবনাকে কখনও মনে স্থান দেননি। আজ সমাজে ধর্মের যে প্রকাশ দেখি, মন্দির-মসজিদের যে আস্ফালন দেখি, হিংসার গুপ্ত যে প্রবৃত্তি দেখি, যে ভেদাভেদ দেখি, তার সঙ্গে স্বামীজির ধর্মবোধের এতটুকু মিল নেই। আসলে এ এক বিপথগামী ও নৈরাশ্যবাদী ধর্মবোধ। তা আমাদের সবদিক থেকে নিরন্তর ডুবিয়ে দিচ্ছে। রাজনীতি হল এই ধর্মের কাণ্ডারী ও নিয়ন্ত্রক। নেতারা হলেন তার পান্ডা।  তাঁদের আপন স্বার্থ-মিশ্রিত বুদ্ধি প্রয়োগ করে তাঁরা দেশকে ধর্ম সম্পর্কিত ভ্রান্ত পথের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। ধর্ম এবং ধর্মাচরণের ভেদাভেদটা মুছে ফেলতে চাইছেন। দু’টো কিন্তু এক নয়। ধর্মের মধ্যে সম্প্রদায়গত ভাবনা থাকে না। ধর্মমত বা ধর্মাচরণের মধ্যে সেই বিভেদ থাকে। ধর্ম অনেক বৃহৎ এবং তা মানুষের মঙ্গল বা কল্যাণ ছাড়া আর কিছুই ভাবে না। কিন্তু ধর্মাচরণের মধ্যে বিদ্বেষ আছে, হিংসা আছে, অন্য ধর্মকে তা ঘৃণা করতে শেখায়। অন্য ধর্মের মানুষকে হত্যা করতেও তার বাধে না। যে কোনও ধর্মের পথ একই। তা মানুষকে একই লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। কিন্তু ধর্মমত হল, ঠাকুর কথিত ‘যত মত তত পথ’। সেই পথেই বিদ্বেষের প্রকাশ। আজকের রাজনীতি আমাদের সেই অশুভ ধর্মের পথে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। এই বিদ্বেষকে পুঁজি করেই রাজনীতি তার ভোটের অঙ্ক কষে, ক্ষমতা দখলের ছক বানায়। এর সঙ্গে মানুষের হিতসাধনের কোনও যোগ নেই। তাই ক্ষমতা দখলের পরও নেতার স্বার্থান্ধ মন মানব কল্যাণের বদলে কখনও কখনও ছড়িয়ে দেয় বিদ্বেষের বিষ। আজ আমাদের দেশে যেভাবে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে মৌলবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে, তা অত্যন্ত ঘৃণ্য।  তাই আজ মন্দির-মসজিদের রাজনীতি করতে হয়, তাই আজ সাম্প্রদায়িক বিভেদের বাতাবরণ তৈরি করে ক্ষমতাকে স্থায়ী করার স্বপ্ন দেখতে হয়।
যে ভারত গড়ার স্বপ্ন স্বামীজি দেখেছিলেন, সেই ভারতকে আজ খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। স্বামীজি চেয়েছিলেন, শূদ্রের হাত দিয়েই গড়ে উঠুক নতুন ভারত। সেই ভারত সাম্যের পথকে আঁকড়ে ধরবে। সেই পথ নতুন ধর্মবোধে মানুষকে বুকে টেনে নেবে। ভারতাত্মার মধ্যে ধর্মের প্রতিষ্ঠা হবে। সেটাই হবে সমাজের মেরুদণ্ড। তিনি বুঝেছিলেন, ‘এরা একমুঠো ছাতু খেয়ে দুনিয়া উলটে দিতে পারবে।’ কিন্তু এরা কারা? স্বামীজির আহ্বানেই তা স্পষ্ট। ‘নতুন ভারত বেরুক। বেরুক লাঙ্গল ধ’রে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে মালা মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হ’তে। বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে। বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে, বেরুক ঝোড় জঙ্গল পাহাড় পর্বত থেকে। এরা সহস্র সহস্র বৎসর অত্যাচার সয়েছে, নীরবে সয়েছে— তাতে পেয়েছে অপূর্ব সহিষ্ণুতা। সনাতন দুঃখ ভোগ করেছে, তাতে পেয়েছে অটল জীবনীশক্তি।’ 
আমরা দেখলাম, গুজরাতের কোনও এক স্টেশনের চায়ের দোকান থেকে একজন উঠে এলেন বটে, তাঁকে দেখে ২০১৪ সালে নতুন আশায় বুক বেঁধেছিলেন মানুষ। তাঁর নামও নরেন্দ্র। নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু এই নরেন্দ্র সেই মহামানব নরেন্দ্রর বাণীকে জীবনে ও কর্মে আত্মস্থ করতে পারেননি। বারবার তাঁর কথায় স্বামীজির প্রতি ভক্তির প্রকাশ দেখা যায় বটে, কিন্তু কর্মে তাঁর অবস্থান একেবারে বিপরীত মেরুতে। বিগত কয়েক বছরে তাঁর শাসন দক্ষতার নিদর্শন বুঝিয়ে দিয়েছে, যে ভরসা মানুষ তাঁর উপর করেছিলেন, সেখানে তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ। পাশ মার্কটুকুও তুলতে পারেননি। কেননা তাঁর আমলে পরিয়ায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার অন্ত থাকে না। তাঁরই হঠকারী সিদ্ধান্তে শত শত মাইল পথ হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে শ্রমিকদের অনেকেই রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে মারা যান। এঁদের সংখ্যা কত, কী হল তাঁদের, সরকার বাহাদুর তার খোঁজই নেয়নি। অথচ এঁদের ভোটেই তিনি কুর্সি দখল করেছিলেন। পরে তাঁদের কথা তাঁর মনেও পড়েনি। তাঁরই নানা সিদ্ধান্তে দেশের সাধারণ মানুষ বিভিন্ন সময়ে কুফল ভোগ করেছেন। দেশের দরিদ্র মানুষের বদলে তাঁর বেশি আগ্রহ শিল্পপতিদের সম্পদ বৃদ্ধির দিকে। তাই কৃষকদের স্বার্থবিরোধী আইন এনে তিনি কৃষকদের ভাতে মারতে চেয়েছিলেন। পারেননি তিনি। আজ চারিদিকে দেখা যাচ্ছে, তাঁর বিরুদ্ধে জেগে উঠেছেন দেশের সাধারণ মানুষ। স্বামীজির ভাষায়, যাঁরা সমাজের নিচুতলার মানুষ, তাঁরা আজ জাগছেন দেশজুড়ে। শাহবাগ আন্দোলন, কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাগছে সেই শক্তি। তাকে এখন আর প্রতিহত করা যাবে না। তাই ভোটজয়ের কৌশলে তাঁকে নানা ড্রামাবাজি করতে হয়। কখনও হাতাতালি দিয়ে, কখনও ছাতি বাজিয়ে, কখনও সাগর তীরে প্লাস্টিক কুড়িয়ে, কখনও গঙ্গায় ভক্তির ডুব দিয়ে বা তাঁকে হত্যা করার গুজব ছড়িয়ে। শাসক যখন সত্য থেকে অনেক দূরে সরে যায়, তখনই সমাজে পাপের জন্ম নেয়, অরাজকতার জন্ম নেয়। 
পাশাপাশি স্বামীজির জীবনের একটি ঘটনার কথা বলতে হয়। কলকাতাজুড়ে তখন প্লেগের প্রাদুর্ভাব। স্বামীজির তখন ভগ্নস্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য ফেরাতে তিনি গিয়েছিলেন দার্জিলিঙে। খবর পেয়ে মানুষের সেবা করার জন্য তৎক্ষণাৎ ছুটে এলেন কলকাতায়। ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেবায় এবং রোগ প্রতিরোধে। একদিন কেউ একজন তাঁকে বলেছিলেন, ‘স্বামীজি, আপনি যে কাজ শুরু করেছেন, তার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। কোথায় পাওয়া যাবে, এত টাকা?’ স্বামীজি এক মুহূর্ত দেরি না করে তাঁর জবাবে বলেছিলেন, ‘যদি দরকার হয়, মঠের জন্য কেনা নতুন জমি বিক্রি করব। সহস্র সহস্র ব্যক্তি আমাদের চোখের সামনে যন্ত্রণা ভোগ করবে, আর আমরা মঠ করব। আমরা সন্ন্যাসী, নাহয় পূর্বের মতো আবার তরুতলে বাস করব, ভিক্ষান্নে উদর পূরণ করব, কিন্তু জনসেবা করে যাব।’ এই জনসেবাই ছিল স্বামীজির ধর্ম। মঠ বা মন্দির নয়। এই শিক্ষাটুকুকে আমরা দূরে সরিয়েই রাখলাম। মন্দির, ব্রত, বলি, তাবিজ, এইসব নিয়ে মেতে থাকলাম।   
স্বামীজি ধর্মের শক্তিকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ধর্ম মানুষের পশুত্বকে বিনাশ করে। তিনি বললেন, এই ধর্ম কোনও মন্দির, মসজিদ বা গির্জায় থাকে না। এই ধর্ম থাকে মানুষের অন্তরে। সেই চেতনা তাকে ক্রমেই পরিশোধনের মধ্য দিয়ে তাকে পবিত্র করে তোলে। এই ধর্ম হল আসলে এক অভীযাত্রা। তা মানুষকে নিষ্কলুষ এক আত্মার পথে নিয়ে যায়। তিনি বললেন, মানব এবং মহামানবের মধ্যে একটিই পার্থক্য। সেটি হল জ্ঞান। জ্ঞানই মানবকে মহামানবের পর্যায়ে নিয়ে যায়। এটিই হল জীবন সাধনা। জ্ঞানই হল ভক্তির মার্গ। একেই বলে পূজা। 
স্বামীজির ধর্ম ও সমাজ ভাবনার মধ্যে ছিল সাম্য ও কল্যাণবোধ। মাঝেমাঝেই তিনি ব্যঙ্গ করে বলতেন, ‘আমাদের ধর্মে মহা সাম্যবাদ, আর সমাজে মহা ভেদবুদ্ধি’। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে মানুষই হয়ে উঠবে পৃথিবীর সব থেকে হিংস্র প্রাণী। আজ তাঁর জন্মদিনে সেই আলোর প্রার্থনা করি আমরা। সেই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের আলোয় প্রকাশিত হোক কলুষহীন মানবাত্মা। গড়ে উঠুক সুস্থ মনের সমাজ। 

12th     January,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ