শিয়ালদহ স্টেশন। রাত ৯টা ৩৭ মিনিট। তীব্র হর্নে কেঁপে উঠল শিয়ালদহ সাউথ। লাস্ট ক্যানিং লোকাল ছেড়ে যাচ্ছে। আর ব্যাগ কাঁধে পিছন পিছন ছুটছেন এক বৃদ্ধ। বছর ৬৫ বয়স। এই ট্রেনটা বেরিয়ে গেলে রাতটা কাটাতে হবে প্ল্যাটফর্মেই। তাই ছুটছেন তিনি। কোনওমতে শেষ কামরার রডটা ধরলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা দু’টো হাত টেনে নিল তাঁকে। উঠেই হাঁপাচ্ছেন বৃদ্ধ। অবসরের পরও সঞ্চয় যা ছিল, অসুবিধে হচ্ছিল না। কিন্তু এক মহামারী সেই সঞ্চয়কেই তলানিতে এনে ফেলেছে। গিন্নিকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল আগের বছরই। অনেকগুলো টাকা একসঙ্গে বেরিয়েছে। তাই আবার কাজ শুরু করেছেন তিনি। কাজে নামতে হয়েছে তাঁকে একটা দোকানে। ক্যানিং থেকে আসেন... রোজ। আর্মহার্স্ট স্ট্রিটে হেঁটে যান। আর এখন দৌড়ে ফেরেন। লাস্ট ট্রেন ৯টা ৩৭। কামরায় উঠে হাঁপাচ্ছিলেন। বেশ কয়েকটা সহানুভূতির চোখ তাঁর দিকে তাকিয়ে। খুব কষ্টে হাসার চেষ্টা করলেন। বললেন, ‘একটু হলে মরেও যেতে পারতাম। তাই না? বেঁচে থেকেই বা কী লাভ? এই মহামারীর ব্যবসায় কার লাভ হল বলতে পারেন? আশপাশের সবকটা মানুষ দেখি গরিব হয়ে গিয়েছে। ব্যালেন্স শিট মেলাই। তাই জানি, একজন গরিব হলে আর একজন বড়লোক হবেই। সেটা কে?’
ভদ্রলোক মোক্ষম ধরেছেন। বড়লোক এই বাজারেও আছে। তৈরি হয়েছে। গজিয়ে উঠেছে। আর তারা হল ওষুধ কোম্পানি, করোনা ভ্যাকসিন বানানেওয়ালারা। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর দু’বছর পর এটাই সবচেয়ে বড় সত্যি। বাজারে এখন আতঙ্ক বিক্রি হচ্ছে। আর এর থেকে বেরনোর উপায় কী? ভ্যাকসিন এবং ওষুধ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের এত বছরের ইতিহাসে হামের টিকা বাজারে আসার জন্য সবচেয়ে কম সময় লেগেছিল—চার বছর। আর করোনা? সাত মাস। বহু গবেষকই প্রশ্ন তুলেছিলেন, এই ক’দিনে টিকা বলে যাকে চালানো হচ্ছে, তা সত্যিই কার্যকর হবে তো? মানুষ কিন্তু বিশ্বাস করেছে। আমি, আপনি... সকলেই টিকা নিয়েছি। ভেবেছি, এই তো বিশল্যকরণী। দু’টো ডোজ নিলেই কেল্লাফতে। আর করোনা ছুঁতে পারবে না। হয়তো তাই। হয়তো সত্যিই টিকা নেওয়ার পর অনেকের শরীরেই করোনা আর তার মারণ রূপ দেখাতে পারেনি। আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই... কিন্তু অল্পের উপর দিয়ে গিয়েছে। ব্যতিক্রম কি নেই? সেও আছে। ডবল ডোজের পরও অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। কো-মরবিড শরীর সেই আঘাত নিতে পারেনি। অনেকে প্রাণও দিয়েছেন। তাও আমরা আঁকড়ে ধরেছি এই ‘বিশল্যকরণী’কে। ছুটে চলেছি একটা ছুচের পিছনে। আর এই সুযোগটাই নিচ্ছে মৌরসিপাট্টা চালিয়ে যাওয়া কয়েকটি কোম্পানি। বারবার চরিত্র বদলাচ্ছে কোভিড-১৯ ভাইরাস। আমরা বলছি ভ্যারিয়েন্ট। কাপা, ডেল্টা, ডেল্টা প্লাস, ওমিক্রন... একের পর এক স্ট্রেইন বাজারে আসছে, আর আমরা আতঙ্কিত হচ্ছি। কোম্পানির ভাড়া করা বিশেষজ্ঞরা মাথা নাড়ছে আর বলছে, এই ভ্যারিয়েন্টে বোধহয় আগের নেওয়া ভ্যাকসিন কার্যকর হবে না। তাহলে উপায় কী? উপায় একটাই—আবার টিকা নিতে হবে। অমুক ভ্যাকসিন নেওয়া থাকলে ডেল্টা প্লাস স্ট্রেইনকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যাবে। তমুক টিকায় কুপোকাত হবে ওমিক্রন। সাধারণ মানুষ ভাবছে, বিশ্বাস করছে, আর আতঙ্কিত হচ্ছে। মুনাফা লুটছে হাতেগোনা ওই কয়েকটি কোম্পানি।
২০১৯-২০ অর্থবর্ষে সিরাম ইনস্টিটিউটের লাভের পরিমাণ কত ছিল? ২ হাজার ২৫১ কোটি টাকা। ভ্যাকসিন বাজারে আসার পর হিসেব বলছে, অঙ্কটা পৌঁছে যাবে ১৫ হাজার কোটি টাকায়। অথচ, আদর পুনাওয়ালা অক্সফোর্ডকে পেটেন্টের জন্য টাকা দিয়েছেন, কেন্দ্রের বেঁধে দেওয়া দামে অধিকাংশটা সরকারকেই বিক্রি করেছেন। প্রাইভেট হাসপাতালগুলি কিনেছে ঠিকই, কিন্তু সেটা তুলনায় অনেক কম। কিছু বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। তাতেও হাজার হাজার কোটির উপর নেট মুনাফা! তাক লাগানোর মতোই বটে! এই অর্থনৈতিক বিক্রিয়ায় অনুঘটকের কাজ করেছে স্রেফ আতঙ্ক। করোনা মহামারীর ভয়ে সরকারি লাগাম পরেছি আমরা... বন্ধ হয়েছে ব্যবসা, কাটা গিয়েছে বেতন, না খেতে পেয়ে অনেকে আত্মঘাতী হয়েছে। তাও আতঙ্কের বেসাতি বন্ধ হয়নি। অক্সফ্যামের রিপোর্ট বলছে, ফাইজার, মডার্না এবং বায়োএনটেকের করোনার অর্থবর্ষে মুনাফা ৩৪০০ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলা হিসেবে ২ লক্ষ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, এই কোম্পানিগুলি প্রতি সেকেন্ডে কামাচ্ছে হাজার ডলার, প্রতি মিনিটে ৬৫ হাজার ডলার এবং প্রতিদিন ৯ কোটি ৩৫ লক্ষ ডলার। তারপরও যখন কোম্পানিগুলিকে সাধারণের জন্য এই ভ্যাকসিনের ফর্মুলা দেওয়ার অনুরোধ করা হচ্ছে, তারা সাফ জানাচ্ছে... না, পারব না। ফাইজারের সিইও অ্যালবার্ট বারলার এ ব্যাপারে উত্তর ছিল, ‘ডেঞ্জারাস ননসেন্স’। তাদের গবেষণা এলেবেলেদের বিলিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। অথচ এই তিনটি কোম্পানিকে গবেষণার জন্য সরকার অর্থ জুগিয়েছিল—সব মিলিয়ে ৮০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে মডার্নাই পেয়েছিল ২৫০ কোটি ডলার। সবই কিন্তু আয়করদাতাদের টাকা। পাবলিক ফান্ড। তারপরও এই ধৃষ্টতা দেখাতে পারছে তারা। তাবড় তাবড় দেশ, এমনকী আমেরিকাও কিচ্ছু করতে পারছে না। এরা একবারও ভাবছে না যে, মহামারীতে ধুঁকছে বিশ্ব... একসঙ্গে অনেক সংস্থা টিকা বানাতে পারলে দু’টি উপকার। প্রথমত, সাধারণ থেকে অতি-সাধারণ মানুষ... প্রত্যেকের নাগালে টিকা চলে আসবে। আর দ্বিতীয়ত, দাম নেমে আসবে অনেকটাই। কিন্তু তারা তা করবে না। একচ্ছত্র আধিপত্য চালিয়ে যাবে ভ্যাকসিন নির্মাতারা। মুনাফা চাই, আরও... আরও। তার জন্য ভয়টাকে মানুষের মনে জিইয়ে রাখতে হবে... যতদিন সম্ভব।
বাসের পাদানি থেকে চায়ের দোকান। এখন এটাই যে আলোচনার বিষয়বস্তু! এক ভদ্রলোককে সেদিন বলতে শুনলাম, ‘গাঁটের পয়সা খরচ করে আতঙ্ক কিনছি। টিভি চ্যানেল খুললেই আতঙ্ক। এই সংক্রমণ বেড়ে গেল, ওই দেখো মৃত্যু বাড়ছে, আবার নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসছে, আর মানবজাতিকে বাঁচানো যাবে না... ধুর ধুর, বিরক্ত লেগে যায়।’ কী বলা যায় এদের? দায়িত্ববোধসম্পন্ন? তারা বলে, সত্যিটা প্রচার করছি। কিন্তু সত্যি প্রচার করা, আর আতঙ্কের দালালি করা তো এক বিষয় নয়? একবারও কি আমরা ভেবে দেখছি, এতে আসলে কার লাভ? কতই না ওষুধের নাম এই করোনাকালে আমরা শুনলাম... রেমডেসিভির, ডেক্সামেথাসোন, বামলানিভিমাব, মলনুপিরাভির... উফ্, এই না হলে ওষুধ! কত্ত কঠিন কঠিন নাম হবে, উচ্চারণ করতে দাঁত ভেঙে যাবে, তবে তো স্টেটাস! ‘আনন্দ’ ছবিতে যেমন রাজেশ খান্না নিজের ক্যানসার রোগের ডাক্তারি নামটা শুনে বলেছিলেন, ‘বাঃ বাবুমশাই, রোগ হবে তো এমন!’ আমাদেরও এখন সেই দশা। কঠিন কঠিন ওষুধ বেশি বেশি দামি কিনে আনছি, টিভিতে আতঙ্ক দেখছি, আর টপাটপ খেয়ে ফেলছি। এক ঢোক জলের সঙ্গে নিশ্চিন্তি ফ্রি। এবার করোনা হাওয়া। তার দু’দিন পরই গা’টা গরম গরম ঠেকছে। তখন ভাবছি, এই রে নতুন ভ্যারিয়েন্ট এল বোধহয়। আমরা জানি না... এটাই মুনাফাখোর কিছু সেক্টরের ইউএসপি হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্কুলের ভিতর, ক্লাসরুম, খেলার মাঠ কেমন হয়... ভুলে গিয়েছে শিশুরা। তাদের স্কুল এখন ফোন, ল্যাপটপে। ভার্চুয়াল ক্লাস। মনের বিকাশ নেই... আছে শুধু গেজেট আঁকড়ে কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাকার লড়াই। স্কুলে গেলেই করোনা হবে। তাই তালা ঝুলছে গেটে। এক একটা প্রজন্ম শেষ হয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হয়ে উঠছে ক্ষিপ্ত, অন্তর্মুখী। আর কৈশোরের গণ্ডি যারা পেরতে চলেছে... তাদের সামনে কেরিয়ারের চ্যালেঞ্জ। বহু ক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বলে দেওয়া হচ্ছে, ২০২০ ও ২০২১-এর ব্যাচ এড়িয়ে চলাই ভালো। মাঝখান থেকে ব্যবসায় লাল হয়ে যাচ্ছে ইলেকট্রনিক্স কোম্পানিগুলি। চার্জ বাড়ছে ইন্টারনেটের। এ যে আর নেশা নয়... প্রয়োজন। যা দাম ফেলব, তাতেই কিনতে হবে মানুষকে। পড়াশোনা করতে হবে, অফিস চালাতে হবে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম... স্কুল ফ্রম হোম... এটাই যে কোভিডের মূলমন্ত্র। সময় আসছে... গরিব হবে গরিবতর। ব্যবসা বাড়বে আতঙ্কের। সাধারণ মানুষ তার ন্যূনতম সেভিংস শেষ করে আতঙ্ক থেকে বাঁচার উপায় খুঁজবে। কিন্তু করোনা কি শেষ হবে? মুনাফাখোর, স্বার্থান্বেষী একটা অংশ কিন্তু চাইছে... এই মহামারী দীর্ঘজীবী হোক। এখন এর থেকে মুক্তির দায়িত্ব রাষ্ট্রের।