বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

বাংলারই রিপ্লে দেখছি পাঞ্জাবে...
হিমাংশু সিংহ

একেবারে পশ্চিমবঙ্গের ‘রিপ্লে’ দেখছি যেন! ‘খেলা হবে’ স্লোগানের বর্ষপূর্তির আবহেই কখন যেন একসুতোয় বাঁধা পড়ে গেল বাংলা ও  পঞ্চনদের পবিত্র প্রদেশ। আট মাস আগে মমতার বাংলা অত্যন্ত সফলভাবে বিজেপির আগ্রাসন রুখে দিয়ে দেশের মানুষের বাহবা কুড়িয়েছিল। প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল, গণতান্ত্রিক এই দেশে শাসকের রক্তচক্ষু কখনও প্রতিবাদকে দমন করতে পারে না। ইন্দিরা পারেননি, মোদিও পারবেন না। বিশেষত সেই প্রতিরোধের মুখ যদি হন কোনও স্ট্রিট ফাইটার-অগ্নিকন্যা। সাধারণ ঘরের লড়াকু নেত্রী।  ভোটের ফলাফলেই বাংলায় শাসক দল ভাঙার চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়েছে মানুষ। এক বছর পর সেই অদ্ভুত সমাপতনের সামনে দাঁড়িয়ে দেশভাগের বিষ বুকে ঘুরে দাঁড়ানো আর এক রাজ্য পাঞ্জাব। সেখানেও ভোটের আগে শাসক কংগ্রেস ভাঙার ফায়দা লুটতে চেয়েছিল অমিত শাহের ফৌজ। এরাজ্যের দলবদলুদের ডেকে নিভৃতে মদত দেওয়ার মতোই বিদ্রোহী ক্যাপ্টেন অমরিন্দরের সঙ্গেও দিল্লিতে বৈঠক হয়েছে বিভিন্ন স্তরে। সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মোদি-অমিত শাহ পর্যন্ত। কয়লা থেকে মাদক পাচার আটকানোর অজুহাতে দু’টি রাজ্যেই বিএসএফের এলাকা বৃদ্ধির আড়ালে প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টাও কম হয়নি গত কয়েকমাসে। কিন্তু তবু ফুঁসে ওঠা আন্দোলনকে খতম করা যায়নি কোনওভাবে। কৃষি বিল প্রত্যাহার করে ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা হলেও ঘরে না ফেরা অন্নদাতাদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর পথ রুদ্ধ করেছে কৃষকরা। চাওয়া হয়েছে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সংক্রান্ত আইনের প্রতিশ্রুতি। নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহের নজিরবিহীন এই একটি ঘটনাই স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে, হঠাৎ ধেয়ে আসা পশ্চিমী ঝঞ্ঝার মতোই মোদিজির ব্যক্তিত্বের জাদুও একটু একটু করে যেন সময়ের সঙ্গে শক্তি হারাচ্ছে। ধার কমছে। সেই সুযোগে রাজ্যে রাজ্যে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বিক্ষোভ মাথা তুলছে। আপাতভাবে বিরোধীরা হীনবল হলেও আন্দোলন আর প্রতিবাদের নতুন চালিকা শক্তি আজ কৃষকরা। যাঁদের সামনে পাটিগণিত ভুলে মাথা ঝোঁকাতে হয়েছে সর্বশক্তিমানকেও। পার্লামেন্টে গরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও। সেই পথ ধরেই শ্রমিক, সরকারি কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ তাঁদের হক বুঝে নিতে চাইছে। লোকসভা ভোটের দু’বছর আগে এই বার্তা মোটেও শুভ সঙ্কেত নয় নোট বাতিলের ব্যর্থ নায়কের পক্ষে!
পাঞ্জাবের চান্নি সরকার বলছে, ভাতিন্দা ফ্লাইওভারে সেদিন নিরাপত্তার কোনও গাফিলতি ছিল না। একাধিক ভিডিও থেকে আবার এও দেখা যাচ্ছে, এসপিজি ও বিজেপি’র সমর্থকবেষ্টিত হয়েই অবরুদ্ধ রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কনভয়। উপস্থিত কর্তাদের সঙ্গে কথা চলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আমলাদের। চারদিকে গেরুয়া ঝান্ডার ভিড়। ক্রমাগত উঠছে স্লোগান। পাল্টা কৃষকরাও দাবি করেছেন, ঘটনাস্থল থেকে অন্তত এক কিলোমিটার দূরে ছিল তাঁদের অবস্থান। কৃষকরা কেউ কনভয়ের উপর চড়াও হয়নি। পাথরও ছোড়া হয়নি। ঠিক কী হয়েছে, তা রহস্যাবৃত থাকলেও দেশজুড়ে মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করায় কোনও খামতি রাখা হচ্ছে না। আর হবে নাই বা কেন? দিল্লি ফেরার পথে প্রধানমন্ত্রী নিজেই তো বলেছেন, ‘প্রাণ নিয়ে ফিরেছি, আপনাদের মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে দেবেন’। বলি, তাহলে দেশটা চালাচ্ছেন কে? নরেন্দ্র মোদির এই একটা মন্তব্য নিজের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের উপরই অনাস্থা জানানো নয় কি? তবে কি প্রধানমন্ত্রী একটু হতাশ হয়ে পড়ছেন পাঁচ রাজ্যের ভোটের আগে? অমিত শাহের উপরও কি তিনি ইদানীং একটু ক্ষুব্ধ?
এমন অভিযোগও উঠছে, প্রধানমন্ত্রীর ভিভিআইপি নিরাপত্তার দেখভাল করা কর্তারাই পাঞ্জাব প্রশাসনকে ভুল পথে চালিত করেছে। নাহলে শেষ মুহূর্তে কপ্টার ছেড়ে সড়কপথে ফিরোজপুর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন এসপিজি কর্তারা! কৃষকরা যে ফুঁসছে তা তো কারও অজানা নয়। বিক্ষোভ যে হবে তাও আগে থেকেই ঘোষণা করা ছিল। তার উপর জায়গাটা পাকিস্তান সীমান্তের কাছে। তাই এসপিজি কি গাফিলতির সব দায় এড়াতে পারে? এখন বাঙালি পুলিস অফিসার, পাঞ্জাব পুলিসের ডিজি সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ‘বলি কা বকরা’ করে লাভ কী? কিন্তু ওই যে বললাম, বাংলা ও পাঞ্জাব নিয়ে জমজমাট চিত্রনাট্যটা একজনেরই লেখা বলে মাঝে মাঝে মনে হয়। ব্যবধান শুধু সময়ের। গতবছর ঠিক বাংলার ভোটের আগে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় সভা করতে যাওয়ার পথে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎ প্রকাশ নাড্ডার উপর হামলার ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন হল ভাতিন্দার উড়ালপুলে। নিয়ম মেনে এবারও উচ্চপর্যায়ের তদন্ত হবে। তারপর কয়েকজন পুলিস অফিসারের উপর শাস্তি নেমে আসবে, এ আর এমন কী! এও তো সেই একই কুনাট্যেরই অংশবিশেষ। তাই সিদ্ধার্থবাবুর অপসারণ খুব স্বাভাবিক। 
কিন্তু যতই হাল্কাভাবে নেওয়ার চেষ্টা করুন আর প্রশাসনের উপর দায় চাপান, নরেন্দ্র মোদির বিপদ কিন্তু দিনে দিনে বাড়ছে। বিশেষত উত্তরপ্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভোটের আগে দৃশ্যতই কমছে জনপ্রিয়তার গ্রাফ। ইদানীং তিনি বলতে উঠলে আর তেমন রোমাঞ্চ আর বিদ্যুৎ খেলে যায় না জনগণের শরীরে। সে ‘মন কি বাত’-ই হোক কিংবা নিয়ম করে কিছুদিন পরপর নতুন অবতারে জাতির উদ্দেশে ভাষণ। কেমন যেন ক্লিশে হয়ে গিয়েছে সব! টানা আট বছর ধরে একই অস্ত্রের অতি ব্যবহারে কেমন যেন ভোঁতা। বিগত বছরটা ছিল কৃষক আন্দোলনের অভূতপূর্ব সাফল্যের বছর। ভোটের ময়দানে নয়, সংসদেও নয়, একেবারে প্রকাশ্য রাস্তায় নেমে গণতান্ত্রিক পথে নিজের দাবি আদায় করে নিয়েছে কৃষকরা। একই সঙ্গে উচ্চকিত বার্তা পৌঁছে দিয়েছে ক্ষমতার উচ্চতম অলিন্দে। যার অনুপ্রেরণায় শ্রমিক, ব্যাঙ্ক কর্মচারী, কাশ্মীরের সাধারণ মানুষও বুক বাঁধছে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে। নোট বাতিলের ফলে ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে যেসব বৃদ্ধবৃদ্ধারা পাঁচ বছর আগে প্রাণ হারিয়েছিলেন তাঁদের অতৃপ্ত আত্মাও কি কৃষকদের এই রুখে দাঁড়ানোকে আশীর্বাদ করবে না। বলা বাহুল্য, নোটবন্দিতে শুধু মারা গিয়েছে মানুষ, কিন্তু কলো টাকা একটুও বন্দি হয়নি। এখনও চলছে বুক ফুলিয়ে। জমজমাট নেতা-বিধায়ক কেনাকাটারও অভাব নেই। আবার কাশ্মীর ভাগের নাটক হয়েছে, কিন্তু সন্ত্রাসবাদ খতম হয়নি। শুধু বিরোধী নেতানেত্রীরা গৃহবন্দি থেকেছেন মাসের পর মাস। বন্ধ থেকেছে আদালত পর্যন্ত। একের পর এক এমনই লোকদেখানো মোদি নাটকে জনগণ তাই আজ বীতশ্রদ্ধ। সেই অসন্তোষকে শুধু সংসদীয় রাজনীতির পাটিগণিতের এক ধাক্কায় ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া যাবে না। শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা নয়, মাঠেঘাটে রোদ ঝড় জলে খাটা গরিব থেকে সম্পন্ন কৃষকরাই প্রমাণ করেছে আন্দোলন সফল করতে কোনও রাজনৈতিক দলের ছায়ার দরকার হয় না তাদের। কেউ সেই আন্দোলনকে হাইজ্যাকও করতে পারেনি। বাধ সাধেনি ভয়ঙ্কর মহামারীর অভিঘাতও। শাসক যতই সংগঠিত ও ধুরন্ধর হোন না কেন, এখনও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের শক্তি যে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিকে নিমেষে নাড়িয়ে দিতে সমর্থ। পৃথিবী যতই আধুনিক হোক এ যুগেও তা সমানভাবে সত্য।
দেশের প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত সম্মানের পদ। তিনিই দেশ ও সরকারের মুখ, তাই তাঁর পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার অর্থ মোটেই রাষ্ট্রের পক্ষে সুখকর কোনও বার্তা বহন করে না। বিশেষত যদি সেই ঘটনা ঘটে পাকিস্তান সীমান্তের অদূরে। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, এক বছরেরও বেশি সময় শীত গ্রীষ্ম বর্ষা উপেক্ষা করে শতশত কৃষক ভাই দিল্লির সীমানায় ঠায় বসেছিলেন। অন্তত সাতশো কৃষক সেই আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁদের আর ঘরে ফেরা হয়নি। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দেওয়ার সময়টুকুও পাননি তাঁরা। এই ঘরে না ফেরার দলে সব বয়সের, সব আয়ের কৃষক ভাইরা আছেন। তাঁদের পরিবারের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা আধঘণ্টা ফ্লাইওভারে মোদিজির আটকে থাকার তুলনায় কম কীসে? 
যতই লোকসভা ভোট কাছে এগিয়ে আসবে দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম এই প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের ঢেউ আরও তীব্র হবে। বিরোধীরা চাইল কী চাইল না, জোট হল না ভেঙে গেল, তার সঙ্গে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধের কোনও সম্পর্ক নেই। গর্জে উঠছে কৃষক, শ্রমিক, অসংগঠিত শ্রেণি থেকে আমজনতা। তা দেখে দেশের সম্মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভ আকাশ ছুঁতে বাধ্য। খেলাটা ক্রমেই কঠিন হবে মোদিজির পক্ষে। আর গাফিলতির দায় চাপিয়ে বলির পাঁঠা করা হবে কিছু নিরীহ অফিসারকে। কিন্তু আন্দোলনের মুখ যেখানে দেশের অন্নদাতারা, সেখানে ‘মোদি কা গুসসা কিঁউ আতা হ্যায়’ নিয়ে ময়নাতদন্তের সময় কোথায়? গরিব চাষির ঘরের ‘সামান্য ক্ষতি’র সামনে মাথা নত করতেই হবে ক্ষমতাবানকে! এটাই গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ বিচার।

9th     January,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ