বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

মনমোহন পারলেও
মোদি পারলেন না
তন্ময় মল্লিক

কৃষক বিক্ষোভের জেরে পাঞ্জাবের সফর বাতিল করে প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি ফিরে যাওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন, অকল্পনীয় এবং অবশ্যই অনভিপ্রেত। তবে, পাঞ্জাবের ঘটনা মোদি সরকারের জন্য এক অশনিসঙ্কেত। কৃষি আইন প্রত্যাহার করলেও বিজেপির বিরুদ্ধে চাষিদের জেহাদের সুর একটুও নরম হয়নি। ফিরোজপুরের পিয়েনারা প্রমাণ করল, লখিমপুরের ঘটনায় চাষিরা ভীত নন, বরং আরও সাহসী, আরও সঙ্ঘবদ্ধ। তাই মোদিজির যাওয়ার খবরেই নেমে পড়েছিলেন বিক্ষোভ দেখাতে। চাষিদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে মোদি বুঝেছেন, পাঞ্জাব চলে যাচ্ছে নাগালের বাইরে। তাই ঘটনার মোড় ঘোরানোর জন্য পৌঁছে গিয়েছেন রাষ্ট্রপতি ভবনে। এই সুযোগে বিজেপির কেউ কেউ দিয়েছেন পাঞ্জাবে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির প্রস্তাব। একেই বলে, তিলকে তাল করা। প্রধানমন্ত্রী হয়তো ভেবেছিলেন, বিতর্কিত কৃষি আইন প্রত্যাহার করলেই দূর হয়ে যাবে চাষিদের যাবতীয় ক্ষোভ। কিন্তু ফিরোজপুরের ঘটনায় বোঝা গেল, চাষিদের ক্ষোভ বিন্দুমাত্র কমেনি। উল্টে বুঝিয়ে দিলেন, ফসলের সহায়কমূল্য ঘোষণা, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র রাষ্ট্রমন্ত্রী অজয় মিশ্রের পদত্যাগ, মৃত চাষিদের ক্ষতিপূরণের দাবি আদায়ে তাঁরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাই পাঞ্জাবের মতো ঘটনা দেশের অন্যত্র ঘটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ চাষিরা আছেন দেশের সর্বত্র।
ভাতিন্দা বিমান বন্দর থেকে হুসেইনিওয়ালায় জাতীয় শহিদ মেমোরিয়ালে যাওয়ার কথা ছিল মোদিজির। দুযোর্গপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য ওড়েনি প্রধানমন্ত্রীর চপার। তাই সড়কপথেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত। সুতরাং তাঁর গাড়ি আটকানো ও তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখানোর কোনও আগাম কর্মসূচি ছিল না। কালো পতাকা দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানাতে চেয়েছিলেন তাঁদের প্রতিবাদ। তা‌ই যেটা হয়েছে সেটা অবশ্যই স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ।
প্রধানমন্ত্রীর মতো একজন ভিভিআইপির যাত্রাপথ মসৃণ রাখা প্রতিটি রাজ্য সরকারের নৈতিক কর্তব্য। ফ্লাইওভারের উপর প্রধানমন্ত্রীর মতো একজন ব্যক্তিত্বকে ২০ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছে, এটা অবশ্যই নিন্দনীয়। সেই কারণেই অনেকে বলছেন, পাঞ্জাবের কংগ্রেস সরকার তার কর্তব্য পালনে ব্যর্থ। বিজেপি নেতৃত্বের আক্রমণের মুখে পড়ে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী চরণজিৎ সিং চান্নি বলেছেন, ‘গভীর রাত পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর সভার ব্যবস্থাপনা তদারকি করেছি। ৭০ হাজার চেয়ার আনা হয়েছিল। কিন্তু এসেছেন মাত্র ৭০০জন। আমি কী করব? উনি অন্য রাস্তা দিয়েও সভায় যেতে পারতেন।’
প্রধানমন্ত্রীর সভায় লোক না হওয়া প্রসঙ্গে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী যে দাবি করেছেন, তা প্রকারান্তরে মেনে নিয়েছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি। নাড্ডাজির কথায়, ‘পুলিস দিয়ে সভায় আসা লোকজনকে আটকানো হয়েছে।’ কংগ্রেসের দাবি, প্রধানমন্ত্রীর সভায় লোক হয়নি খবর পেয়েই তিনি মাঝরাস্তা থেকে ফিরে গিয়েছেন। 
সুতরাং প্রধানমন্ত্রী বিকল্প রাস্তায় সভাস্থলে না গিয়ে দিল্লি ফিরে যাওয়ার প্রকৃত কারণ নিয়ে দুই শিবিরে কাদা ছোড়াছুড়ি চলতেই থাকবে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে ভাতিন্দা বিমান বন্দর ছাড়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর করা মন্তব্য, ‘আপনাদের মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাবেন...ভাতিন্দা বিমান বন্দর পর্যন্ত আমি বেঁচে ফিরতে পেরেছি।’
প্রত্যেকের কাছেই নিজের জীবন অত্যন্ত মূল্যবান। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজের সুরক্ষার ব্যাপারে সদা সতর্ক। ব্যক্তিগত সুরক্ষার সঙ্গে আপস করা তাঁর রক্তে নেই। দেশবাসী তার প্রমাণও পাচ্ছে। করোনা আবহে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে অভাব, দারিদ্র, বেকারত্ব নেমে এলেও প্রধানমন্ত্রীর সুরক্ষার জন্য কেনা হয়েছে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বিমান। সেই বিমান শুধু বিলাসবহুলই নয়, তার মধ্যে রয়েছে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধক ব্যবস্থা। ভারতবর্ষ আর্থিক বিচারে বিশ্বের ধনী দেশগুলির ধারেকাছে না থাকলেও পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তো বটে! প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্যে এই একটি ব্যাপারে অন্তত আমরা আমেরিকার সমকক্ষ। তাদের প্রেসিডেন্ট যে বিমান চাপেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতিও সেই একই বিমান চাপেন।
নরেন্দ্র মোদির মস্ত বড় গুণ হল তিনি সমালোচনা গায়ে মাখেন না। তাই করোনার ধাক্কায় দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়লেও তিনি দামী গাড়ি চাপার অভ্যেসটা ছাড়েননি। বরং দিন দিন বাড়িয়েই চলেছেন। তাই এবার কিনে ফেলেছেন মার্সিডিজ মেবাখ এস ৬৫০ গার্ড। সেটাও এক জোড়া। একটায় চাপবেন প্রধানমন্ত্রী, আর একটি ডামি। দু’টি মিলিয়ে দাম পড়েছে প্রায় ২৪ কোটি।
কেন এমন বিলাসবহুল গাড়ি? সেটাও নাকি এসপিজির সুপারিশক্রমে! প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার স্বার্থে। প্রধানমন্ত্রী বাইরে বেরলে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর সুরক্ষা বলয় ছাড়াও তাঁকে ঘিরে থাকেন এসপিজি কমান্ডোরা। 
তাঁদের হাতে থাকে অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। তবে, এই নিরাপত্তাও তাঁর জন্য যথেষ্ট নয়। তাই কেনা হয়েছে বিশ্বের সেরা সুরক্ষাযুক্ত গাড়ি। প্রধানমন্ত্রীর এই গাড়ি আটকে দেবে বর্মভেদী গুলিও। এমনকী, বিষাক্ত গ্যাস হামলার মধ্যে এই গাড়ি তার যাত্রীদের জুগিয়ে যাবে বিশুদ্ধ বায়ু।
বুধবার প্রধানমন্ত্রী ভাতিন্দা বিমান বন্দর থেকে যে গাড়িতে রওনা দিয়েছিলেন সেটি বুলেট প্রুফ হলেও মার্সিডিজ মেবাখ এস ৬৫০ গার্ড-এর মতো সুরক্ষিত নয়। সেই জন্যই কি তাঁকে পেয়ে বসেছিল মৃত্যুভয়? তাই ঩কি তিনি বিকল্প রাস্তায় তাঁর জন্য অপেক্ষমান দলীয় কর্মীদের কাছে না গিয়ে দিল্লি ফিরেছিলেন? নাকি চরণ সিং চান্নির দাবিই সত্যি? নির্বাচনের আগে ফাঁকা মাঠে জনসভা সারলে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কাতেই দিল্লি প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত।
ভিড় না হওয়ার জন্য সভা বাতিলের, হেলিকপ্টার ঘুরিয়ে নেওয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে বাংলাও। বঙ্গে নির্বাচনী প্রচারের সময় জনসভার ফাঁকা মাঠের উপর চক্কর কেটে ফিরে গিয়েছিল অমিত শাহের হেলিকপ্টার। অজুহাত ছিল দুর্বল সিগন্যাল। আবার ফাঁকা মাঠে বক্তৃতা করার আশঙ্কায় শেষপর্বে চারটি সভা বাতিল করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। অজুহাত ছিল করোনা। তাই ফ্লাইওভার থেকে প্রধানমন্ত্রীর ফিরে যাওয়ার প্রকৃত কারণ নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। 
বিক্ষোভের জেরে ফ্লাইওভারে প্রধানমন্ত্রীর আটকে থাকা পাঞ্জাব সরকারের ব্যর্থতা। তারপর তিনি দিল্লি ফিরে গেলে ‘অ্যাডভান্টেজ’ ছিল প্রধানমন্ত্রীর। কিন্তু ‘বেঁচে ফেরার’ কথা বলে তিনি নিজেকে হাস্যাস্পদ করে তুলেছেন। সোশ্যাল মিডিয়াও প্রশ্ন তুলেছে, প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে কি গুলি চালানো হয়েছিল? পাথর ছোড়া হয়েছিল? নাকি তাঁর গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল? প্রতিটি প্রশ্নেরই উত্তর ‘না’। ঘটেছিল কী? প্রধানমন্ত্রী বুলেট প্রুফ গাড়িতে ২০মিনিট অপেক্ষা করেছিলেন। সেই সময় তাঁকে গার্ড দিচ্ছিল এসপিজি কমান্ডোরা। এমনই এক পরিস্থিতিকেই কি বলে, ‘প্রাণ হাতে নিয়ে বেঁচে ফেরা’!
পাঞ্জাবের কৃষক বিক্ষোভ ও প্রধানমন্ত্রীর সফর বাতিল নিয়ে জলঘোলা হওয়ায় মানুষের আলোচনায় উঠে আসছে প্রায় দেড় দশক আগের একটি ঘটনা। ২০০৫ সাল। ইউপিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তখন মনমোহন সিং। জওহর লাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে গিয়ে পড়লেন ছাত্র বিক্ষোভের মুখে। বামপন্থী ছাত্ররা তাঁকে তুমুল বিক্ষোভ দেখালেন। তাঁকে দেখতে হয়েছিল কালো পতাকা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভালো চোখে দেখেনি। তাঁদের অতিথি তথা দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বিক্ষোভ দেখানোয় কড়া পদক্ষেপ করেছিল কর্তৃপক্ষ। বিষয়টা এখানেই শেষ হলে এটা নিছক ঘটনাই থেকে যেত। কিন্তু মনমোহন সিং এর জন্য হয়ে গেল দৃষ্টান্ত। 
বিক্ষোভকারী ছাত্রদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানামাত্র মনমোহন সিংয়ের নির্দেশে পিএমও হস্তক্ষেপ করে। মনমোহন সিং জানিয়ে দেন, বিক্ষোভ দেখানো, প্রতিবাদ করা ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। তাই তাদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নয়। তাঁর নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আর এগয়নি।
পাঞ্জাবে চাষিদের বিক্ষোভও ছিল তেমনই এক গণতান্ত্রিক আন্দোলন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফলানো ফসলের ন্যায্যমূল্য দাবি করেছিলেন তাঁরা। লখিমপুরে চার-চারজন চাষিকে গাড়ির চাকায় পিষে মারার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত আশিস মিশ্রের বাবাকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন চাষিরা। সেই বিক্ষোভের জেরে ফিরে গিয়েছিলেন মোদি।
মোদিজির ‘বেঁচে ফেরা’র মন্তব্য প্রাণহানির আশঙ্কা থেকে নাকি রাজনৈতিক গিমিক, তা নিয়ে বিতর্ক চলবে। তবে যখন কমান্ডো পরিবেষ্টিত একজন প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিজের দেশে দাঁড়িয়ে প্রাণ সংশয়ের কথা বলেন, তখন তাঁর রাজনৈতিক দেউলিয়াপনাই প্রকাশ পেয়ে যায়। মোদিজির মতো গটগট করে হাঁটতে পারতেন না মনমোহন সিং। তাঁর বুকের ছাতি কত জানা নেই, তবে ৫৬ ইঞ্চি নয়। তা সত্ত্বেও হৃদয়ের উদারতায় আর আন্তরিকতার আবেগে তিনি বুঝেছিলেন, আন্দোলনকারীরা তাঁরই সন্তান। তিনি দেশের অভিভাবক। তাই করে দিয়েছিলেন ক্ষমা। কিন্তু মনমোহন সিং যেটা পেরেছিলেন, সেটা পারলেন না মোদি।

8th     January,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ