বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

মোদির শক্তিবৃদ্ধির পর্ব শেষ, এবার শক্তিক্ষয়
সমৃদ্ধ দত্ত

এই ২০২২ হল ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ৮০ তম  বছর। যখন ৭৫তম বর্ষ হয়েছিল, সেই ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের স্মরণে আগস্ট মাসে তাঁর রেডিও বার্তা ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘১৯৪২ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে ভারত বদলে গিয়েছিল। ভারত ছাড়ো আন্দোলন থেকে যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল, সেই পরিবর্তন  চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯৪৭ সালে। আমি আগামী পাঁচ বছর ঠিক সেরকম পরিবর্তনের আভাস দেখতে পাচ্ছি। ২০২২ সালে সব সমস্যার সমাধান হয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হবে এক নতুন ভারত।’ 
আজ আমরা সেই ২০২২ সালে এসে উপস্থিত হয়েছি। কোন নতুন ভারত পেয়েছি? কোন সমস্যার সমাধান হয়েছে যা পাঁচ বছর আগে ছিল, কিন্তু এখন নেই? এমনিতে এখন অন্ধ ভক্তবৃন্দ ছাড়া কমবেশি সকলেই জানেন যে, নরেন্দ্র মোদির সব কথা সিরিয়াসলি নিতে নেই। তিনি সর্বদাই ভবিষ্যতের কথা বলতে ভালোবাসেন। অর্থাৎ পাঁচ বছর, দশ বছর পর কী হবে, সেই স্বপ্ন দেখিয়ে হাততালি নেওয়া, হেডলাইন ম্যানেজমেন্ট, প্রোপাগান্ডা ক্যাম্পেন ইত্যাদিই প্রধানত তাঁর রাজনীতির একটি চেনা অভিমুখ। সুতরাং কোনও সন্দেহ নেই ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের ‘মন কি বাতে’ তিনি যে বলেছিলেন ২০২২ সালে আসতে চলেছে নতুন ভারত, এটাও এখন আর খুব বেশি মানুষের মনে নেই। আসলে নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর ২০২২ সালকে অনেক দূরের একটি গন্তব্য স্টেশন হিসেবে মনে করেছিলেন। তিনি তাই যখনই কোনও ঘোষণা করেছেন, ২০২২ সালের কথা বলে দিয়েছেন। দীর্ঘ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতায় তিনি বুঝেছিলেন মানুষের স্মৃতি দুর্বল। অন্তহীন ইস্যুর স্রোতে আজকাল আর কেউ কোনও প্রতিশ্রুতি অথবা ঘোষণা মনে রাখে না। 
তিনি বলেছিলেন, ২০২২ সালের মধ্যে সকলের মাথার পর ছাদ হবে। অর্থাৎ ভারতবাসীর সকলেই  ঘর পাবে। আজ ২০২২ সাল উপস্থিত। সেরকম কি হয়েছে? তিনি বলেছিলেন, ২০২২ সালে সকলের ঘরে বিদ্যুৎ থাকবে। আজ সকলের ঘরে বিদ্যুৎ আছে? তিনি বলেছিলেন, ২০২২ সালে সকলের ঘরে যাবে পানীয় জল। এই স্বপ্নপূরণ হয়নি। তাঁর ঘোষণা ছিল ২০২২ সালে কৃষকদের আয় হবে দ্বিগুণ। সেরকম কোনও সম্ভাবনাই তৈরি হয়নি। সুতরাং, নরেন্দ্র মোদির ঘোষণা এখন আর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ৮০ তম বর্ষে এসে তাহলে ২০২২ সাল কি কিছুই পেল না? পেয়েছে। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ঠিক আশিতম বর্ষপূর্তিতে পা রেখে ওই আন্দোলনের প্রতি সবথেকে বৃহৎ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে কৃষকরা। তারা প্রমাণ করে দিয়েছে ৮০ বছর পরেও মহাত্মা গান্ধীর অহিংস সত্যাগ্রহ আজও কতটা কার্যকর।  তারা রাষ্ট্রকে বাধ্য করেছে পিছু হটতে। তিন কৃষি আইনকে কৃষক ও জনস্বার্থ বিরোধী আখ্যা দিয়ে কৃষকরা আন্দোলন শুরু করেছিলেন। এবং সেই আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণ সত্যাগ্রহ। এক বছরের একটানা রোদ ঝড় বৃষ্টি শীত উপেক্ষা করে কৃষকরা জয় পেয়েছে। 
ঠিক এই প্রেক্ষিতে ২০২২ সালে বিজেপির জন্য একটি বড়সড় শঙ্কা উপস্থিত হয়েছে। সেটি হল, নরেন্দ্র মোদি দুর্বল হচ্ছেন। এই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ভোটব্যাঙ্ক, জনপ্রিয়তা কিংবা শক্তিতে নয়। এসবে তিনি হয়তো অন্যদের থেকে এখনও অনেক এগিয়ে দেশজুড়ে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তিতে ফাটল ধরেছে। তাঁর ব্যক্তিত্ব দুর্বল হচ্ছে। ২০২১ সাল এই ইঙ্গিতটি স্পষ্ট করে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। নরেন্দ্র মোদি নামটি একা কোনও হেরে যাওয়া লড়াই যে জেতাতে পারে না, সেটা প্রমাণ করেছে বাংলার বিধানসভা নির্বাচন। বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জয়ী হতেনই। বিজেপির জয়ের সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি এককভাবে নিজের উপস্থিতিতে এমনভাবে সেই লড়াইয়ের আবহ তৈরি করে দিয়েছিলেন যে, মনে করা হয়েছিল মোদির ক্যারিশমায় জিতে যাবে বিজেপি। কিন্তু সেটা হয়নি। বরং বিজেপি ধরাশায়ী হয়েছিল সর্বশক্তি দেওয়া সত্ত্বেও। ওই পরাজয় যতটা বিজেপির, তার থেকে বেশি মোদির। কারণ কমবেশি সকলেই এই পরাজয়ের জন্য বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের অতি আগ্রাসী মনোভাবকেই দোষারোপ করেছে। বাংলার বিজেপি ইউনিটের কোনও ভূমিকাই ছিল না ভোটে। আর সেই লড়াইটা হেরে গিয়েছেন মোদি। 
বছরের মাঝামাঝি ওই ধাক্কার পর, দ্বিতীয় ধাক্কা দিয়েছে কৃষক সংগঠন। কৃষি আইন যে সত্যিই বাতিল করে দিতে হবে, এটা মোদি ভাবতেই পারেননি। তিনি সবথেকে বেশি হতাশ করেছেন তাঁর ভক্তবৃন্দকে। কারণ, তারা প্রাণপণে কৃষি আইনের সপক্ষে সওয়াল করে, প্রচার করে তর্ক বিতর্ক করে গিয়েছে। কিন্তু শেষে মোদি তাদের ডুবিয়ে দিলেন নিজেই কৃষকদের দাবির কাছে অবনত হয়ে। সুতরাং এভাবে যে শঙ্কাটি আরও তীব্র হচ্ছে সেটি হল, এতকাল মোদি বিরোধীরা তাঁর কথা বিশ্বাস করেনি, তাঁকে সিরিয়াসলি নেয়নি। এবার ধীরে ধীরে তাঁর ভক্তরাও তাঁকে বিশ্বাস করবে না পুরোপুরি। তারা আতঙ্কে থাকবে কোনও একটি ইস্যুতে আজ গলা ফাটাবো মোদির হয়ে, আগামী কাল যদি ঢোঁক গিলতে হয়? এই প্রবল সমর্থকদের 
মধ্যেও যখন অবিশ্বাস তৈরি হয়, তখনই যে কোনও জননায়কের ভাবমূর্তি পতনের সূত্রপাত ঘটে। 
লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে, মোদির সেই প্রবল সমর্থকরা এখন আর অতটা আগ্রাসীভাবে মোদির পক্ষে সওয়াল করে না। কারণ তারা কমবেশি বুঝতে পারছে, মোদির থেকে আর বিশেষ কিছু পাওয়ার নেই। তিনি হয়তো আবার ২০২৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হতেই পারেন। কিন্তু ভারতকে পাল্টে দেওয়ার মতো কিছু করতে পারবেন না। সেই সময়টাই আর নেই। আট বছরেই দেখা হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ খুব বেশি হলে আর একটা টার্ম সম্পন্ন করে তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাবেন। 
তৃতীয় সমস্যা নিয়ে এসেছে চীন। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে লাগাতার হাজারো ইস্যুতে সমালোচনা করা বিজেপি ও সংঘ পরিবারের প্রবণতা। চীনের কাছে ১৯৬২ সালে ভারতের বিপর্যস্ত হওয়ার জন্যও নেহরুকে দায়ী করে বিজেপি। মোদিকে ঘিরে এমন একটা ইমেজ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে যেন, প্রতিবেশী পাকিস্তান, চীন মোদির ভারতকে প্রচণ্ড ভয় পাবে। অথচ ভারত-চীন যুদ্ধের ৬০ তম বর্ষে এই ২০২২ সালে এসে দেখা যাচ্ছে চীন ভারতকে রীতিমতো তাচ্ছিল্য করছে, হেয় প্রতিপন্ন করছে। অরুণাচল প্রদেশের ১৫টি এলাকার নাম নিজেদের ভাষায় করে দিয়েছে চীন। লাদাখ থেকে সেনা সরাতে তারা নারাজ সেকথা স্পষ্ট করে দিয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীনকে পাল্টা হুমকি দেওয়া তো দূর অস্ত, চীনের নামও উচ্চারণ করেন না। এই প্রবণতায় মোদির দুর্বলতা আরও বেশি করে প্রচারের সুযোগ করে দিচ্ছে বিরোধীদের। প্রশ্ন উঠছে, কেন মোদি এই দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন? সত্যিই কেন চীন  নিয়ে তাঁকে আগ্রাসী কোনও রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না? পাকিস্তান তো একটা ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। আমাদের সঙ্গে কোনও দিক থেকেই তুলনায় আসে না। পাকিস্তানকে হুমকি দেওয়ায় কোনও কৃতিত্বই নেই। আমাদের আশা ছিল চীনকে আমরা এবার দেখে নেব সবদিক থেকে। নতুন বছরে আমরা আশা করছি প্রধানমন্ত্রী চীনের এই আগ্রাসনের পাল্টা কোনও আগ্রাসন দেখাবেন। 
মোদির দুর্বলতার ষোলোকলা পূর্ণ হতে পারে ২০২৪ সালে। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপির পক্ষে একক গরিষ্ঠতা পাওয়া সম্ভব হবে না। ২৭২ আসনের অনেক আগেই থেমে যাবে বিজেপির রথ। সেক্ষেত্রে অবশ্যই জোট সরকার গড়ার দিকেই অগ্রসর হতে হবে মোদিকে। কাদের পাবেন পাশে? অনেক আঞ্চলিক দলই আছে যারা কেন্দ্রীয় সরকারকে সমর্থন দেবে ক্ষমতার বন্ধু হয়ে থাকার সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্য। কিন্তু গত ১০ বছরের একক গরিষ্ঠতার সরকারে মোদি যে শক্তি ভোগ করেছেন, সেটা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়বে ওই জোট সরকারে। মোদিকে নির্ভর করতে হবে সরকার রক্ষা করার জন্য কয়েকটি দলের উপর। তারা  চোখ রাঙাবে যখন তখন। সেটা সহ্য করতে হবে মোদিকে। কী করবেন তখন তিনি? একক গরিষ্ঠতা না পেলেও প্রধানমন্ত্রী হতে রাজি হবেন? আর যদি কোনও কোনও আঞ্চলিক দল শর্ত দেয় যে, আমরা একক বৃহত্তম দল বিজেপিকে সমর্থন করতে রাজি, শুধু প্রধানমন্ত্রী অন্য কাউকে করতে হবে। কিন্তু মোদি নয়। তখন কী করবে বিজেপি? মোদিকে সরিয়ে অন্য কাউকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসাতে রাজি হবে? নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপির শক্তি অর্জনের শীর্ষে ওঠা সমাপ্ত হয়ে গিয়েছে। এখন ক্রমেই শক্তিক্ষয় হয়ে দুর্বল হওয়ার পালা। এটাই রাজনীতির নিয়ম! সেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। নতুন ভারত আর গড়া হল না। এখন বরং বিজেপিকে তৈরি হতে হবে নতুন বিজেপির জন্য। 

7th     January,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ