রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় এক গুণী ব্যক্তি এসেছিলেন। বহু ভাষায় দক্ষ, হেন বিষয় নেই জানতেন না, তিনি করতে পারতেন না এমন কাজ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁকে দেখেও বোঝা যেত না, এ বাঙালি, পাঞ্জাবি না মাদ্রাজি। রাজামশাইয়ের কৌতূহল হল, এর সম্পর্কে জানতে হবে। অথচ নিজে কিছুতেই তাঁকে জিজ্ঞেস করবেন না। শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব দিলেন গোপাল ভাঁড়কে। বললেন, তুমি যদি জেনে দিতে পারো এর মাতৃভাষা কী, আর কী তার প্রদেশ... অনেক টাকা পুরস্কার দেব। সেই ব্যক্তির রাজসভায় প্রবেশের সময় দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকলেন গোপাল ভাঁড়। তাঁর পায়ের শব্দ পাওয়া মাত্র দ্রুত বেরিয়ে এসে দিলেন সজোর ধাক্কা। ভান করলেন, যেন দেখতেই পাননি! সেই মহাজ্ঞানী তখন কলিশনের ঠেলায় চিৎপটাং। আর সঙ্গে রাগত চিৎকার, ‘সড়া অন্ধা অছি... দিনের বেলারই আখির মথা খাউচি?’ গোপাল সেই শুনে কৃষ্ণচন্দ্রকে মুচকি হেসে বললেন, ‘মহারাজ, এই ভদ্রলোক ওড়িয়া।’ এই রহস্য উদ্ঘাটনে গোপাল ভাঁড়ের কতটা প্রাপ্তিযোগ হয়েছিল, সেটা এই লেখার প্রতিপাদ্য নয়। নজর করার মতো শুধু গল্পটির মরাল। মর্মার্থ। আর সেটা হল, ঠেকায় এবং বেকায়দায় পড়লে আসল রূপ প্রকাশ হয়ে যায়। ঠিক যেমনটা হয়েছে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর। এই পর্বে দেশের দু’জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব দু’টি তথ্য ফাঁস করেছেন। প্রথম, শারদ পাওয়ার। তাঁর বক্তব্য, দু’বছর আগে নরেন্দ্র মোদি নিজে তাঁকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ‘বিজেপির সঙ্গে জোটে আসুন, আপনার মেয়েকে কেন্দ্রের মন্ত্রী করব’। আর দ্বিতীয়ত, সত্যপাল মালিক। তিনি মেঘালয়ের রাজ্যপাল। কৃষক অবস্থান পুরোদমে চলাকালীন প্রধানমন্ত্রীকে তিনি বলেছিলেন, শ’পাঁচেকের বেশি কৃষক মারা গিয়েছেন। দয়া করে এবার কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিন। তাতে মোদিজির উত্তর ছিল, আমি কী করব? এরা কি আমার জন্য মারা গিয়েছে? এদের কি আমি অবস্থানে বসতে বলেছি?
আসলে সাড়ে সাত বছরের শাসনকাল শেষে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অবস্থা অনেকটা মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার সেই ওড়িয়া ভদ্রলোকের মতো। বেকায়দায় পড়ে আচ্ছে দিনের মুখোশটা খসে গিয়েছে। আসল উদ্দেশ্য আজ প্রকাশ্যে—ক্ষমতা। এ একটা নেশার মতো। ক্ষমতার শিখরে বসে থাকা অবস্থায় পতনের ছবিটা আচমকা নজরে এসে গেলে সকলেই মরিয়া হয়ে ওঠে। ফকির পরিচয় কাব্যে-গদ্যে বা ভাষণে ভালো লাগে। বাস্তবে নয়। তাই মোদিজি যেভাবে হোক ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। বেআব্রু হয়ে পড়ছে তাঁর একগুঁয়েমি। দম্ভ। ২০১৯ সালে মহারাষ্ট্র শুধুই তাঁর প্রেস্টিজ ফাইট ছিল না! ছিল একটি নম্বরও। দখল চাই বিধানসভার। যত বেশি সম্ভব। তাহলেই ডবল ইঞ্জিন তত্ত্বের জাল বোনা যাবে ভোটার-মননে। স্বপ্ন দেখাবে বিজেপি... প্রকল্পের, সুশাসনের। বেকারত্ব, নারী নির্যাতন, মৃত্যুমিছিলের দগদগে ছবি ঢাকা পড়ে যাবে প্রতিশ্রুতির ফানুসে।
এই মুহূর্তে ক’টি রাজ্যে ক্ষমতায় আছে বিজেপি? ১৮টি। আর এককভাবে ক’টিতে? মাত্র সাতটি। অর্থাৎ, ১১টি রাজ্যে চলছে বিজেপির জোট সরকার। অধিকাংশ বিধানসভাতেই অন্য কোনও আঞ্চলিক দল সংখ্যাগরিষ্ঠ। বিজেপির তাতেও পরোয়া নেই। দু’টি-তিনটি আসন নিয়েও ক্ষমতার প্রদীপের সলতে ধরে ঝুলছে তারা। সঙ্গে গুরুগম্ভীর সাফাই-বাণী—ক্ষমতায় তো আছি!
হক কথা। ক্ষমতায় আপনারা রয়েছেন। কিন্তু বুঝতে পারছেন না, শাসনের জাদু বালির মতো আপনাদের মুঠো থেকে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে। নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন। দাবি করছেন, আফস্পা হটাও। উত্তর-পূর্বে এমন দাবি ছড়িয়ে পড়ছে হু হু করে। এই সেদিনও এতটা শোচনীয় ছিল না গেরুয়া রাজনীতি। সাড়ে সাত বছর আগে থেকে ঘোষণা করেছিলেন মোদিজি... ‘কংগ্রেস মুক্ত ভারত’। কীভাবে? যে যে রাজ্যে সোনিয়া গান্ধীর দল ম্যাজিক ফিগারের কাছাকাছি আসন পাবে, সেখানেই আঘাত হানো। ম্যানেজ করো বিধায়কদের (নিন্দুকে অবশ্য ঘোড়া কেনাবেচার তত্ত্বেই বেশি জোর দিয়ে থাকে)। আর তাই ২০১৪ সাল থেকে শুধুমাত্র বিজেপির ম্যানেজের ঠেলায় ছ’টি রাজ্য হাতছাড়া হয়েছে কংগ্রেসের। অরুণাচল প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক... ক্ষমতায় আসার পরও নরেন্দ্র মোদির পার্টিকে কুর্সি ছেড়েছে কংগ্রেস। বাধ্য হয়েছে ছাড়তে। মণিপুর ও গোয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সরকার গঠন তারা করতে পারেনি। কেন? উত্তর জানা... বিজেপির ম্যানেজ রাজনীতি। শেষ ছিল পুদুচেরি। নরেন্দ্র মোদির লক্ষ্য ছিল একটাই—ভারতের গেরুয়াকরণ। সেই কর্মসূচিতে তিনি সফল হয়েছেন... বারবার। সেই বলে বলীয়ান হয়েই বোধহয় ভেবেছিলেন, মহারাষ্ট্রেও শিকে ছিঁড়বে। নাঃ, হয়নি। শিবসেনা, এনসিপি, কংগ্রেস মিলেমিশে শিবাজির রাজ্যে সরকার গঠন করে ফেলেছে। আর মোদিজির মরিয়া অভিসন্ধি এসে গিয়েছে প্রকাশ্যে। মাটি সরছে পায়ের নীচ থেকে। শুরুয়াতটা করেছে পশ্চিমবঙ্গ। এত হম্বিতম্বির পর বাংলায় ধস রাজনৈতিকভাবে বিজেপির রথের চাকা মাটিতে নামিয়ে দিয়েছে। যে আতঙ্কের আবহে ভর করে এত প্রতিপত্তি... তা আজ ন্যূনতম দাগ কাটতে পারছে না। এলেবেলে নেতানেত্রীরাও নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের নাম করে ক্ষোভের তোপ দাগছেন। আর দেশ-বিদেশের মঞ্চে ডুবছে ভারতের নাম। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের প্রধান কীভাবে মন্ত্রিত্বের ঘুষ অফার করে সরকারে আসার চেষ্টা করেন? কীভাবে তিনি বলতে পারেন, ‘কৃষকরা কি আমার কথায় অবস্থানে বসেছিল? মরলে আমি কী করতে পারি?’
২০১৪ সালে স্বপ্ন দেখেছিল ভারত। সাধারণ এক নাগরিক আমাদের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন... তিনি নিশ্চয়ই মানুষের দুঃখ বুঝবেন। তাঁর সরকার এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেবে না, যা দেশবাসীকে পথে বসায়। তিনি সাধারণ ঘর থেকে এসেছেন... নিশ্চয়ই সাধারণ জীবনযাপন করবেন! মোহ ভেঙেছে দেশের। নরেন্দ্র মোদি আর সাধারণ নেই। তিনি মার্সিডিজ এস৫৪০ মেবাখ গাড়িতে চড়েন, মেবাখ সানগ্লাস ব্যবহার করেন, আর্মানির স্যুট পরেন... তাহলে কি নরেন্দ্র মোদিকে আর আম আদমির প্রধানমন্ত্রী বলা যায়? আচ্ছে দিন, বা প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকাটাও যে আজ টোপ বলে মনে হচ্ছে! সাড়ে সাত বছর আগে এই টোপ তিনি দিয়েছিলেন সরকারে আসার জন্য। ভোট পাওয়ার লক্ষ্যে। ঠিক যেমন তিনি দিয়েছিলেন শারদ পাওয়ারকে। দু’বছর আগে। তবে সেই গল্পগাথা ফাঁসের জন্য শারদ পাওয়ারের কেন দু’বছর সময় লেগে গেল, সে এক মস্ত প্রশ্ন। কীসের অপেক্ষা তিনি করছিলেন, জানা নেই। হয়তো সময়ের! হয়তো আজ তিনি বুঝেছেন, মোদি আর পারবেন না। এটাই সুযোগ। কফিনে যত পারো পেরেক মেরে যাও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে মোদি-বিরোধী জোটের পক্ষে দেশজুড়ে আওয়াজ তুলেছেন, তাতে সঙ্গত দিচ্ছেন পাওয়ার। হয়তো ভাবছেন, এটাই শেষ সুযোগ... প্রধানমন্ত্রী হওয়ার। মহাজোট যদি কোনওভাবে বিজেপিকে হারিয়ে সংসদের অলিন্দে প্রবেশ করে, সুযোগ একটা আসবেই। না এলেও করে নিতে হবে। নরেন্দ্র মোদি সেটাও বুঝছেন। একে একে পরিস্থিতি বিপক্ষে যাচ্ছে, আর নার্ভ ফেল করছেন তিনি। রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব তাঁর মধ্যে তীব্র হয়ে উঠছে। ছ্যা ছ্যা করছে বিদেশি মিডিয়াও। ওয়াশিংটন পোস্ট, ডেইলি মেইল, নিউ ইয়র্ক টাইমস... সবারই মোহ ভেঙেছে কোভিড কাণ্ডে। তারা বলছে, একদিকে মোদি আন্তর্জাতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে দাবি করছেন, তিনি একাই করোনাকে সামলে দিয়েছেন। আর অন্যদিকে তাঁর দেশেই হু হু করে বেড়েছে সংক্রমণ। তিনি নিজেই হাজার হাজার লোক নিয়ে ভোটের জনসভা করেছেন। এই দ্বিচারিতা কেন? একটি সংবাদমাধ্যম লিখেছিল, ‘সমস্যা হল, ভারতের বিজেপি সরকার শুধুই নিজেদের ভাবমূর্তির ঘোরে থাকে। একটু এদিক ওদিক হলেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে, কীভাবে সামাল দেব। আসল সমস্যায় নজরই নেই!’
এটাই বাস্তব। নরেন্দ্র মোদির। ঢাকা ছিল এতদিন। আর নেই। বেকায়দায় পড়েছেন তিনি... তাই বেরিয়ে আসছে। বারবার। কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার সেই মহাজ্ঞানী ব্যক্তির দশা আপনার। ধাক্কা খেয়েছেন। বেরিয়ে এসেছে আসল ছবিটা। আর গোপাল ভাঁড় কোনও একজন বা দু’জন নয়... গোপাল এখানে যে কেউ... সাধারণ মানুষ। তামাম ভারত। গণতন্ত্র।