বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

‘হোয়াটসঅ্যাপ বিদ্রোহে’ বিপর্যস্ত গেরুয়া শিবির
তন্ময় মল্লিক

প্রতিবাদ, কৌশল, নাকি ব্ল্যাকমেলিং? কোন রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিজেপির মতুয়া বিধায়কদের ‘হোয়াটসঅ্যাপ বিদ্রোহ’ তা স্পষ্ট হতে কিছুটা সময় লাগবে। গুরুত্বপূর্ণ পদ দিলেই যদি ক্ষোভ মিটে যায়, তাহলে এটা ছিল ‘ব্ল্যাকমেল পলিটিক্স’। রাজ্য নেতৃত্ব সমঝোতার রাস্তায় না হাঁটার পরেও ‘বিপ্লব’ থেমে গেলে বুঝতে হবে, এই বিদ্রোহ আসলে মতুয়া ভোটারদের মন পাওয়ার কৌশল। আর রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জারি থাকলে বুঝতে হবে, এটা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দিলীপ ঘোষ অনুগামীদের পরিকল্পিত জেহাদ। তবে, কারণ যাই হোক না কেন, বিজেপির মতুয়া বিধায়করা একধাপ এগিয়ে গেলেন। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব ভোটারদের মধ্যে বিভাজন চায়। আর বিদ্রোহী বিধায়করা সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে দলীয় পদের বিভাজন চেয়ে বসলেন। পাক্কা গুরুমারা বিদ্যে।
করোনায় অগণিত মানুষের মৃত্যুর কারণে ২০২০ যদি ‘বিষের বছর’ হয়ে থাকে তাহলে ২০২১ বঙ্গ বিজেপির জন্য ‘দুঃস্বপ্নের বছর’। পরাজয়ের দুঃস্বপ্ন। প্রথমে বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে মুখ থুবড়ে পড়া। তারপর উপনির্বাচনে জামানত খোয়ানো পরাজয়। সবশেষে কলকাতা পুরসভা নির্বাচনে নাস্তানাবুদ হওয়া। বিজেপির নেতা কর্মীদের মনোবল গিয়ে ঠেকেছে তলানিতে। এই অবস্থায় মুখ বদলে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা বিজেপির। তবে, তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হচ্ছে। বেসুরোদের উত্তরোত্তর সংখ্যাবৃদ্ধির সন্ধিক্ষণে ৩০ জন সভাপতি বদল বিক্ষোভের সলতেয় আগুন লাগিয়েছে। অসন্তোষ, ক্ষোভের সীমা অতিক্রম করে তা নিয়েছে বিদ্রোহের চেহারা।
একের পর এক নির্বাচনে দলের ভরাডুবির জন্য বিজেপি নেতারা যতই শাসক দলের সন্ত্রাসের দিকে আঙুল তুলুন না কেন, আসল সত্যিটা তাঁরাও জানেন। তাঁরাও বুঝেছেন, চোরাবালির উপর অট্টালিকা বানাতে গিয়েছিল বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। তাতে ক্রমশ তলিয়ে যাওয়াই ছিল ভবিতব্য। হচ্ছেও তেমনটাই। এই অবস্থায় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার একটাই রাস্তা, কর্পোরেশন ও পুরনির্বাচনে ভালো ফল করা। তাই এই নির্বাচন বিজেপির কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। 
পুরসভার নির্বাচনেই বোঝা যাবে, বিজেপি এরাজ্যে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা ধরে রাখতে পারবে কি না! কলকাতা পুরভোটের পুনরাবৃত্তি ঘটলে বিজেপির ‘ফুটো নৌকায়’ আর কেউ থাকতে চাইবে না। তখন যে সিপিএম এতদিন তাদের হাওয়া জুগিয়েছিল তারাই কেড়ে নেবে পায়ের তলার মাটি। তাই মুখ বদলে মুখরক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে বিজেপি।
বিজেপির রাজ্য সভাপতির দায়িত্ব নিয়েই সুকান্ত মজুমদার বুঝেছেন, কিছু করে দেখাতে না পারলে তাঁকেও যে কোনও সময় সরে যেতে হবে। তাই নিজস্ব টিম তৈরি করে নেমেছেন গদি ও গর্দান বাঁচানোর লড়াইয়ে। দিলীপবাবুর সময়ের টিম ম্যানেজারদের সরিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, জমানা বদলে গিয়েছে। আর তাতেই বেধেছে গোল। ‘খরচের খাতায়’ চলে যাওয়ারা চটবেন, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁদের চেয়েও বেশি খেপেছেন পদ প্রত্যাশীরা। প্রত্যাশার বাড়া ভাতে ছাই পড়তেই প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, বিদ্রোহ। শুরুটা নদীয়া ও উত্তর ২৪ পরগনার মতুয়া বিধায়করা করলেও বিদ্রোহ দ্রুত ছড়াচ্ছে জেলায় জেলায়।
বাংলা দখল ছিল দিল্লি বিজেপির পাখির চোখ। সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য মতুয়া ও দলিত ভোটকে টার্গেট করেছিল। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব বুঝেছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতুয়া ভোট ব্যাঙ্কে থাবা বসানোর একটাই রাস্তা, ঠাকুরবাড়ির বড়মায়ের ঘনিষ্ঠ হওয়া। সেই লক্ষ্য নিয়েই ঝাঁকে ঝাঁকে বিজেপি নেতা ঠাকুরবাড়িতে ছুটে ছিলেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী, সকলেই নিজেকে ঠাকুরবাড়ির ‘আপনজন’ প্রমাণে মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। আর তার পুরো  ফায়দা তুলেছেন ঠাকুরবাড়ির বিজেপি পন্থী নেতারা। সংগঠনের মাথায় পছন্দের লোক বসানো থেকে শুরু করে নির্বাচনের টিকিট আদায়, সব ক্ষেত্রেই ঠাকুরবাড়ির অতীত ঐতিহ্য ও গরিমাকে ব্যবহার করা হয়েছে।
২০২১ সালের নির্বাচনে সুব্রত ঠাকুরকে গাইঘাটায় প্রার্থী করা নিয়ে বিজেপির মধ্যে প্রবল মতানৈক্য তৈরি হয়েছিল। দলের একটা বড় অংশ সুব্রতবাবুকে প্রার্থী করার বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু শান্তনু ঠাকুর তাঁর দাদাকে প্রার্থী করার জন্য ভয়ঙ্কর জেদ ধরেছিলেন। দাবি পূরণ না হওয়ায় দিলীপ ঘোষের বৈঠক পর্যন্ত ‘বয়কট’ করেছিলেন। নাগরিকত্ব ইস্যুতে তাঁর একের পর এক বিস্ফোরক মন্তব্য গেরুয়া শিবিরের রক্তচাপ বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাঁকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল দলবদলের শঙ্কাও। তাঁর মানভঞ্জনের জন্য কৈলাস বিজয় বর্গীয় ঠাকুরবাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন। দলের আদি এবং যোগ্যদের বঞ্চিত করে সুব্রতবাবুকেই প্রার্থী করতে বাধ্য হয়েছিল বিজেপি নেতৃত্ব। নিন্দুকে বলে, বিজেপির পোড়খাওয়া নেতাদের ল্যাং মেরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় শান্তনু ঠাকুরের জায়গা করে নেওয়ার পিছনেও রয়েছে সেই ‘চাপ থিওরি’।
আসলে সুব্রতবাবুরা বুঝে গিয়েছেন চাপ দিয়েই ‘বাপ’ বলাতে হয়। তাই সুকান্ত মজুমদারের জেলা সভাপতিদের তালিকায় কোনও মতুয়া নেতা জায়গা না পাওয়ায় ক্ষোভ উগরে দিতে একটুও দ্বিধা করেননি সুব্রত ঠাকুর। তিনি সহ পাঁচ মতুয়া বিধায়ক দলীয় হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে বেরিয়ে এসেছেন। অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহা সঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদক সুখেন্দ্রনাথ গায়েনও সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়েছেন তাঁর প্রতিবাদ। বিদ্রোহী বিজেপি বিধায়কদের বক্তব্যে ও সোশ্যাল মিডিয়ার নানা পোস্টে শুধু প্রতিবাদই জানানো হয়নি, রয়েছে দেখে নেওয়ার হুঁশিয়ারি। সুব্রত ঠাকুরের কথায়, ‘ভোটের সময় মতুয়াদের মনে পড়ে। তারাই ভোটে জেতায়। মতুয়াদের ম঩ধ্যে যোগ্য নেতৃত্ব থাকা সত্ত্বেও দলীয় সংগঠনে তাঁদের জায়গা হল না।’ রানাঘাট দক্ষিণের বিজেপি বিধায়ক মুকুটমণিবাবুর প্রতিবাদের ভাষাটা আরও কড়া,‘রাজ্যের পদাধিকারীদের মধ্যে মতুয়াদের কোনও প্রতিনিধি রাখা হয়নি। তাহলে তাঁরা কি শুধুই ভোটের ঘোড়া হিসেবেই ব্যবহৃত হলেন? অনেকেই দলীয় বিধায়কদের গ্রুপ ছেড়েছেন। এটা মতুয়াদের প্রতিবাদের বার্তা।’ সুখেন্দ্রনাথের পোস্টে হুঁশিয়ারি আরও স্পষ্ট, ‘মতুয়াদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। তৈরি থাকুন, আগামী দিনের জন্য। মতুয়ারাও বঞ্চিত করার ক্ষমতা রাখে।’
প্রতিটি বক্তব্যের নির্যাস, অভিমুখ এবং উদ্দেশ্য এক। চাপ দিয়ে দাবি আদায়। মতুয়ার পাঁচ বিধায়ক দলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ত্যাগ করার পরের দিন বাঁকুড়ার চার বিজেপি বিধায়কও একই রাস্তায় হেঁটেছেন। জেলায় জেলায় সেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই ক্ষোভে অভিমানে হয় বসে গিয়েছেন, কেউ কেউ যোগ দিচ্ছেন শাসক দলে। বিজেপি বিধায়করা ক্ষোভ উগরে দিলেও এখনই তৃণমূলে যোগ দেবেন, এমনটা নয়। আমার ধারণা, উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনটা পর্যন্ত তাঁরা অপেক্ষা করবেন। ততদিন পর্যন্ত তাঁরা সুযোগ পেলেই নেতৃত্বের সমালোচনাটা চালিয়ে যাবেন। বজায় রাখবেন ‘বিদ্রোহী’ ইমেজ। তাতে ভবিষ্যতে তৃণমূলে যোগদানের রাস্তা কিছুটা মসৃণ হবে।
নির্বাচনে সাফল্য না পেলে দল দুর্বল হয়। দল দুর্বল হলে বাড়ে ক্ষোভ, বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ। পদে পদে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে নেতৃত্ব। লঙ্ঘিত হয় দলীয় শৃঙ্খলা। কিন্তু কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা থাকে না। একের পর এক নির্বাচনে হেরে বঙ্গ বিজেপির এখন সেই হাল। তা সত্ত্বেও সুকান্ত মজুমদার এক সঙ্গে ৩০টি সাংগঠনিক জেলার সভাপতি বদলে দিয়েছেন। 
নো রিস্ক, নো গেইন। প্রবাদটি মেনে নিয়েও বলতে হচ্ছে, সুকান্তবাবুর ঝুঁকিটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছে। অধিকাংশ সাংগঠনিক জেলার মাথাকে সরিয়ে দেওয়ায় ক্ষোভ বিক্ষোভকে ‘স্বাভাবিক ঘটনা’ বলেই মনে করেন সুকান্তবাবু। অর্থাৎ বিদ্রোহের একটা আবহ তৈরি হবে, সেটা তিনি জানতেন। তা সত্ত্বেও পুরভোটের মুখে কেন এমন পদক্ষেপ করলেন? প্রশ্ন উঠেছে দলের মধ্যেই। কারণ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পুরভোটে বামেরা এগিয়ে গেলে বিজেপির ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ সুযোগটাও হাতছাড়া হয়ে যাবে।  তাই যেটা হতে পারত সুকান্তবাবুর ‘সাহসী পদক্ষেপ’ সেটাই টাইমিংয়ের ভুলে ‘অবিবেচকের কাজ’ বলে আগামী দিনে চিহ্নিত হবে। কঠিন পরিস্থিতিতে স্থিতাবস্থা বজায় রেখে চলাই বিবেচকের কাজ।
স্পষ্ট হচ্ছে দিলীপ-যুগের অবসান। বঙ্গ বিজেপিকে এক অসীম উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েও আজ তিনি ‘কোণঠাসা’। রাজ্য সভাপতির পদ খুইয়েছেন আগেই। এবার ছেঁটে ফেলা হল তাঁর ডালপালা। আর তাতেই দলে শুরু হয়েছে বিদ্রোহ। 
মিশন-২০২১ এর ব্যর্থতা ও দিল্লির নেতৃত্বের উপেক্ষার ক্ষতে প্রলেপ দিতে পারে সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই গান। বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে/... এত বিদ্রোহ কখনো দেখেনি কেউ/ দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ। হোয়াটসঅ্যাপ বিদ্রোহও ছড়িয়ে পড়েছে গেরুয়া শিবিরের দিকে দিকে। তাতেই তৃপ্ত দিলীপবাবুর অশান্ত হৃদয়। নতুন বছরে দিলীপ শিবিরের সেরা উপহার হয়তো এটাই!

1st     January,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ