বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

দুঃসময়ের রাজনীতি
হারাধন চৌধুরী

একতারা হাতে এক বাউল এলেন। কোনও অনুরোধ ছাড়াই একটি প্রচলিত গান গেয়ে হাত পাতলেন। কিছু দেব কি দেব না ইতস্তত করছি। লোকটি আমার মন পড়ে নিলেন নিশ্চয়। কিছু দাবি করার পরিবর্তে প্রশ্ন রাখলেন, ‘বাবু, দুঃসময় কাকে বলে?’ জুতসই উত্তর আমার কাছে নেই বুঝে শূন্যস্থান পূরণের কায়দায় বললেন, ‘মানুষ যে-সময় মানুষকে বিশ্বাস করতে ভয় পায়!’ আমার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য অপেক্ষা করলেন না। একতারায় ধুন তুলে বাউল তাঁর পথেই এগিয়ে গেলেন। আমার দিকে পিছন ফিরলেন না। অনেক বাউলের সঙ্গে দেখা হয়েছে এর আগে পরে। কিন্তু নাম না-জানা এই বাউলের সঙ্গে দেখা হয়নি আর কখনও। 
দু-দশক বাদে তাঁর মুখটাই বেশি মনে পড়ছে। সৌজন্যে নরেন্দ্র মোদি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ১৯ নভেম্বর, শুক্রবার জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘোষণাটি করলেন, ‘আমরা কৃষি আইন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছি!’ নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল হয়তো কৃষকদের। গুরুনানক জয়ন্তীতে ‘স্ট্রংম্যান’ মোদি শুধু ভাঙলেন 
না, সারা পৃথিবী দেখল তিনি মচকালেনও, নজিরবিহীনভাবে, ‘দেশের কাছে ক্ষমা চাইছি। আন্তরিকভাবে এবং পবিত্র মন নিয়ে বলছি, আমাদের তপস্যায় অবশ্যই কিছু ভুল ছিল। তাই প্রদীপের আলোর মতো সত্য সব কৃষকভাইদের বোঝাতে পারিনি।’
শাসক, বিরোধী সব রাজনৈতিক দল প্রধানমন্ত্রীর এই অপ্রত্যাশিত ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। মোদির এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছে আন্তর্জাতিক মহলও। প্রধানমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছেন, সংসদের শীতকালীন অধিবেশনেই আপত্তিকর কৃষি আইন তিনটি সরকার প্রত্যাহার করে নেবে। অতএব তাঁর আর্জি, ‘প্রতিবাদী কৃষকভাইরা এবার তাঁদের গ্রামে এবং পরিবারের কাছে ফিরে যান।’ প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান, ‘আসুন, এক নতুনের সূচনা হোক।’
কিন্তু, কৃষকরা এখনই ঘরে ফিরে যেতে রাজি নন। তাঁরা বলছেন, রাস্তাটা থাকার জায়গা নয়, থাকার জায়গা বাড়িই। তবু তাঁরা বাড়ি ফিরবেন না, আইনগুলি খাতাকলেম বাতিল হওয়ার আগে। ওইসঙ্গে আছে আনুষঙ্গিক কিছু দাবিও। পূরণ হওয়া চাই সব, রাস্তা ছেড়ে যাওয়ার আগেই। কেন? দেশের কৃষকরা দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বিশ্বাস করতে ভয় পাচ্ছেন। কেন? আচ্ছে দিন-এর উদ্গাতা গোড়া থেকেই কৃষকদের সঙ্গে ছলচাতুরি করেছেন। কোভিড পরিস্থিতির মধ্যগগনে কৃষি সংস্কারের এই ধুয়ো তোলা হয়। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনকে দিয়ে ঘোষণা করা হয়, কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আর্থিক বুনিয়াদ আরও মজবুত করা জরুরি। আত্মনির্ভর ভারত অভিযানের অংশ হিসেবেই কৃষি আইন তিনটি আনা হচ্ছে। ২০২০ সালের ৩ জুন মোদি মন্ত্রিসভা আইন তিনটিকে অর্ডিন্যান্স বা অধ্যাদেশ আকারে অনুমোদন করে। আইন তিনটিতে রাষ্ট্রপতি ভবনের সিলমোহর পড়ে দু’দিন বাদে। অধ্যাদেশ থেকে পূর্ণাঙ্গ আইনে পরিণত করার উদ্দেশ্যে সে-বছর বর্ষা অধিবেশনেই (সেপ্টেম্বর, ২০২০) তিনটি বিল আনা হয়। সেসব তড়িঘড়ি পাশও করিয়ে নেন মোদি। 
অধ্যাদেশ জারি এবং কৃষি বিল পেশের দিন থেকেই প্রতিবাদের শুরু। আন্দোলনকারীদের এক ও একমাত্র দাবি ছিল, এসব পত্রপাঠ প্রত্যাহার করতে হবে। কোভিড পরিস্থিতির কারণে গোড়ার দিকের প্রতিবাদটা প্রতীকীই ছিল। বিরোধীরা বলেছিল, পার্লামেন্টারি প্যানেল দিয়ে বিল তিনটির সবদিক স্ক্রুটিনি করতে হবে। অন্যদিকে, শাসক দল ও সরকার পরিস্থিতির এবং মহামারীকালে দেশবাসীর অসহায়তার সুযোগ নিতে মরিয়া ছিল। ভেবেছিল, আন্দোলনের জল বেশিদূর গড়াবে না। অতএব কৃষক এবং বিরোধীদের দাবিগুলি জোরের সঙ্গে খারিজ করা হল। আইন তৈরি হল জবরদস্তি। প্রথম দূরদৃষ্টির পরিচয় দিল মোদি মন্ত্রিসভার শরিক অকালি দল—সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাল। হরসিমরত বাদল মন্ত্রিসভা ছাড়লেন। দলটিও এনডিএ ত্যাগ করল! কক্ষে জোরালো প্রতিবাদের পরিণামে রাজ্যসভার হাফ ডজনের বেশি এমপি-কে একসপ্তাহের জন্য সাসপেন্ড করা হল। অতঃপর সারা পৃথিবী দেখল: ভারতের কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নিষ্ঠা। আন্দোলন কীভাবে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হয়। ‘দিল্লি চলো’। দিল্লির উপকণ্ঠে (সিংঘু, গাজিপুর) রাজপথে পড়ে থেকে প্রতিবাদ। কনকনে শীত, গ্রীষ্মের দহনজ্বালা, প্রবল বর্ষা একে একে কাবু হল। যে-সরকার চীনা ফৌজের ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে চরমভাবে ব্যর্থ, সেই সরকার প্রতিবাদী কৃষকদের দিল্লিতে প্রবেশ ঠেকিয়ে রাখে সমস্ত প্রকার বল প্রয়োগের দ্বারা। কৃষকদের বুকের উপর দিয়ে লখিমপুর খেরির মতো বীভৎস কাণ্ড ঘটানো হয়েছে। নানাভাবে সাতশোর বেশি কৃষক আত্মবলিদান দিয়েছেন। তবু তাঁরা গান্ধীর পথই আঁকড়ে থেকেছেন। হাজার প্ররোচনাতেও হিংসাশ্রয়ী হননি। তাঁরা জানতেন, অহিংসা দিয়েই হিংসা ও ছলনাকে জয় করবেন।
১৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার ভিতর দিয়ে তারই সূচনা হয়েছে। তবু আন্দোলন এখনই তুলে নেবেন না তাঁরা। কারণ, ভারতের প্রধানন্ত্রীর মুখের কথাও বিশ্বাস করতে ভয় পাচ্ছেন! গত সাতবছরে এই প্রধানমন্ত্রী বার বার প্রমাণ দিয়েছেন, তাঁর মন আর মুখ এক নয়। তাহলে তিলে তিলে গড়া আন্দোলনটিকে তাঁরা ঠান্ডাঘরে পাঠিয়ে দেবেন কোন বিচক্ষণতায়! রাজনীতির নিম্ন শ্রেণির কারবারিদের একাংশের আয়ারাম গয়ারাম প্রবৃত্তিটা ইতিমধ্যেই আমাদের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। এবার ক্ষমতার উচ্চাসনের সেই চরিত্র প্রকট হওয়ার আশঙ্কা করছে ভারত। কিছু জনপ্রতিনিধি তাঁদের মতলব মতো আজ এ-দল, কাল সে-দল... করে বেড়ান। রদ হওয়া আইনও যদি কোনও একদিন পুনর্বহাল হয়! 
ভয় পাওয়ার আরও কারণ আছে যে। ভারতের স্বাধীনতার সূর্য মহাত্মা গান্ধী। তাঁকেই উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা হত্যা করেছিল স্বাধীনতার ঊষালগ্নে। দেশবাসীর তীব্র ঘৃণা বর্ষিত হয়েছিল হিন্দু মহাসভা এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) প্রতি। এই দেশবাসী ক্ষমাসুন্দরও হয়ে ওঠে একসময়—‘পাপীকে নয়, পাপকে ঘৃণা করো’ দর্শন থেকে। অটলবিহারী বাজপেয়ির মতো এক প্রিয়মুখ সামনে এনে রাষ্ট্রক্ষমতার সর্বোচ্চ আসন অব্দিও পৌঁছে গিয়েছে তারা। অগ্নিমূল্যের আঁচে ভস্ম হয়ে গিয়েছিল এহেন বাজপেয়ির সরকারও। কিন্তু তার ভিতরে উপ্ত ছিল এক ফিনিক্স পাখির ডিম। মনমোহন সিংহের দশবছরে, জারিজুরির উষ্ণতায় সেই ডিমে তা দিয়ে গিয়েছে বিজেপি। তা থেকেই ২০১৪-য় উঠে এসেছিল মোদি সরকার। মোদির প্রতিশ্রুতি ছিল: ইউপিএ সরকারের দুর্নীতির মূল উপড়ে ফেলবেন। সুসমৃদ্ধ আত্মনির্ভর ভারতীয় অর্থনীতির কল্যাণে সবার জীবনে আসবে আচ্ছে দিন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, উগ্র হিন্দুত্বের যে জুতোয় স্বাধীনতা-পূর্ব যুগে পা গলিয়েছিল, সেখান থেকে বেরতে রাজি নয় তারা।
আজও মোদিবাবুদের পুঁজি রামমন্দিরকে সামনে রেখে ‘রামরাজ্য’প্রতিষ্ঠার ধাপ্পাবাজি। স্বাধীন ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার প্রথম বলি কোনও মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ নয়। একজন হিন্দু, চূড়ান্তরকমে রামভক্ত তিনি। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। গান্ধীর ঘাতকদের পুজো করতেও শাসকের লাই-পাওয়া লোকদের রুচিতে বাধে না। সেনাদের লক্ষ্য করে পাথর ছোড়া কিংবা দেশের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা শত্রুর কাছে ফাঁস করা নিশ্চয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে এখন দেশদ্রোহিতা বলে গণ্য হয় মোদি-শাহ-যোগীর সমালোচনা কিংবা কৃষক আন্দোলন। শুধু ছাড় পেয়ে যাচ্ছে গান্ধীর ঘাতকদের পূজারিরা। না-হলে জামনগরে, গোয়ালিয়রে তাদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে কী করে? কেন তাদের ফাটকে ভরা হচ্ছে না? রক্তমাংসের কোনও মানুষই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। গান্ধীকে নিয়ে যেকোনও মানুষের পক্ষে বিপক্ষে মত থাকতে পারে। তাই বলে গান্ধীহত্যাকে সমর্থন! তাঁর ঘাতকদের ভিতরে বীররসের সন্ধান! একটি মতবাদ কতটা দেউলিয়া হলে এটা সম্ভব? এই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। কীসের বলিদান দিবস? ‘বলিদান’ কথাটির সঙ্গে মিশে রয়েছে ‘শ্রদ্ধা’। দেশের শত্রুকে নিধনের কারণে কারও জীবন বলিপ্রদত্ত হলে তা বলা যায়। গান্ধী কি তাহলে দেশের শত্রু ছিলেন! গান্ধীর ঘাতকদের নিয়ে নতুন এই মাতামাতি কি বৃহত্তর কোনও পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেয়? এর পিছনে রাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন মদত কি নেই? ‘দেশদ্রোহ’-এর সংজ্ঞা কি নতুন করে লেখার চেষ্টায় আছে মোদির ভারত? গডসে, আপ্তে, সাভারকারদের ইতিহাস পুনর্লিখনে প্রয়াসীদের কী করে বিশ্বাস করবেন কৃষকরা, দেশবাসী?
ক্ষমা একবার দু’বার যুক্তিগ্রাহ্য। কিন্তু বার বার নয়। মোদি কোম্পানির হাতযশে এই যে অবিশ্বাসের বাতারণ সমগ্র রাজনীতিকে স্পর্শ করল, একে আপনি দুঃসময় ছাড়া কী বলবেন? মোদির চাতুরির ফাঁদে পড়ে বিরোধী-ঐক্য হাঁসফাঁস করেছে এতকাল। ব্যতিক্রম কৃষক আন্দোলন। বিজেপি-বিরোধী প্রায় সব দল মতের মানুষ স্মরণকালের মধ্যে এতটা এককাট্টা হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের ছবিটাই বিম্বিত হয়েছে। সেদিন কংগ্রেস বাধ্য হয়েছিল বাংলায় মমতার হাত ধরতে। এবারের কৃষক আন্দোলন থেকে কংগ্রেস, তৃণমূল, ডিএমকে, আরজেডি, সপা, অকালি, বাম প্রভৃতি বিরোধীরা কি মোদির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা নেবে?

24th     November,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ