বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

জনতার দাবি মানুন,
প্রায়শ্চিত্ত করুন
শান্তনু দত্তগুপ্ত

একটি রাষ্ট্রের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে আর একটি রাষ্ট্র। টু নেশনস। এই মুহূর্তে এই দু’টি শব্দ নিয়েই ঝড় চলছে। বীর দাস নামে এক ভদ্রলোক আচমকা খলনায়ক হয়ে গিয়েছেন। লোকজন যাচ্ছেতাই গালিগালাজ করছে। বলছে, বীর দাস বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে ভারতকে বদনাম করেছেন। ওঁকে অ্যারেস্ট করা উচিত। আরএসএস-পন্থী এক আইনজীবী তো বীর দাসের বিরুদ্ধে মামলাও ঠুকে দিয়েছেন! বেশ ফাঁপরে পড়েছেন বীর দাস মহাশয়। তাঁর ছ’মিনিটের ঝটিকা বক্তব্যের লম্বা-চওড়া ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বোঝানোর চেষ্টা করছেন, ‘আমি ভাই ভারত-বিরোধী নই। আমার দেশকে অনেকের থেকে বেশি ভালোবাসি।’ কিন্তু ওই একটা প্রবাদ আছে না, ‘চোরায় না শোনে ধর্মের...’ (এর মধ্যে কিন্তু রাজনীতি না দেখলেই ভালো। ধর্ম নিয়ে যারা রাজনীতি করে, তাদের চোর বলার কোনও অভিপ্রায় এখানে প্রকাশ পায়নি। এটা শুধুই একটা প্রবাদ)। বীরবাবু, ভক্তে অটল ভক্তকুল আপনার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছেন। বলতে দ্বিধা নেই, ভক্তদের ভালোই ঝটকা লেগেছে। এখন আপনার সাফাই দিয়ে কতটা কাজ হবে, বলা খুব মুশকিল। আপনি বরং কঙ্গনা রানাওয়াতের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখতে পারেন। আমাদের দেশে আজকাল মত প্রকাশের স্বাধীনতা মোটামুটি তাঁর মতো কয়েকজনের জন্য বেঁচে আছে। ওঁর দলে ভিড়লে এ যাত্রায় বেঁচে যাবেন। ভবিষ্যতে পদ্মশ্রী-টদ্মশ্রীও পেয়ে যেতে পারেন। দেখেন না, কঙ্গনাদেবী আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে ভিক্ষার দান বলেন, মহাত্মা গান্ধীকে ফেকু বলেন... তারপরও তিনি ওয়াই না ওয়াই প্লাস ক্যাটিগরির নিরাপত্তা পান। আপনিও তেমন কিছু চেষ্টা করছেন না কেন! যদি না পারেন, তাহলে পথ বেশ কঠিন। আপনার পাশে দাঁড়ানোর মতো মানুষ চাই... অনেক মানুষ... জনতা চাই।
ক্ষমতার দৃশ্যমান এক অলিন্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ক্ষমতা হারানোর আতঙ্ক।
দিল্লির সীমানায় একে একে জড়ো হয়েছিলেন ভারতীয় নাগরিকরা। পরিচয় ছিল তাঁদের একটাই, কৃষক। বছরভর তাঁরা বসে রইলেন রাস্তায়। গরম, বর্ষা, ঠান্ডা উপেক্ষা করে। সেই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে চলে গেল কত প্রাণ! সরকার বিরোধী কত কণ্ঠে ঝুলিয়ে দেওয়া হল রাষ্ট্রদ্রোহিতার তালা। কৃষকরা হয়ে গেলেন বিজেপি নেতাদের ঘোষণায় খলিস্তানি। তাও তাঁরা নড়েননি। কারণ, তাঁরাই যে জনতা... মানুষ... ভোটার। বসেছিলেন তাঁরা রাজধানীর সীমানায়। কারণ তাঁরা বুঝেছিলেন, আমাদের দেশে বৈচিত্র্য থাকলেও আজকের দিনে ঐক্য বলতে আর কিছু বেঁচে নেই। ব্যতিক্রম দেখিয়েছে কৃষক আন্দোলন। বহু কষ্টে এসেছে এই ঐক্য। একে ভাঙতে দেওয়া যাবে না। তাই কৃষকরা দরমার ছাউনি দিয়ে, ত্রিপল টাঙিয়ে অপেক্ষা করেছেন... সময় আসবে। সরকার বাধ্য হবে তিন কালা কানুন ফিরিয়ে নিতে। তাই হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে সাত সকালে ঘোষণা করেছেন, কৃষি আইন বাতিল হচ্ছে। এই জয় কিন্তু ঐক্যের। বীরবাবু ভাবুন তো... আজ যদি সিংঘু বা তিকরি সিমানায় জনা দশেক কৃষক বসে থাকতেন! তাহলে কি এই ফল হতো? পথে নামত দোর্দণ্ডপ্রতাপ সরকার? ফেরাত কৃষি আইন? উত্তরটা সহজ... না। কৃষক আন্দোলন আজ দেখিয়েছে, সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাই শেষ কথা নয়। নাগরিক সমাজ একবার ভুল করতে পারে, কিন্তু তার দায় সারা জীবন বহন করে বেড়াবে না। তারা প্রতিরোধ করবে। ঠিক যেভাবে কৃষকরা করেছেন। 
একনায়কতন্ত্রের পতনের আড়ালে লুকিয়ে থাকে গণতন্ত্রের শক্তি।
দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর পর কৃষক আন্দোলন ফের দেখাল... প্রবল জনমত নড়িয়ে দিতে পারে সরকারকে। জয়প্রকাশ নারায়ণ পেরেছিলেন। আজ কৃষকরা পারলেন। ফারাক একটাই—এখানে কোনও রাজনৈতিক মঞ্চ ছিল না। এখানে কোনও জেপি ছিলেন না। তাও কৃষকরা পারলেন। তারপরও কৃষকরা জমি ছাড়েননি। বসে আছেন তাঁরা আন্দোলনে। বলছেন, মুখে বললে হবে না। কাজে করে দেখাতে হবে। অর্থাৎ, সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপর ভর করে আইন পাশ করেছিলেন। এবার সংসদেই সেই আইন বাতিল করতে হবে। কীভাবে হবে আইন বাতিল? কিছু আইনের ক্ষেত্রে ‘সূর্যাস্ত’ বা ‘সানসেট’ ধারা থাকে। অর্থাৎ, একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর সেই আইনটি আর কার্যকর থাকবে না। ঠিক যেমন হয়েছিল ‘টাডা’ আইনের ক্ষেত্রে। সানসেট ধারার কারণে টাডা বা টেররিস্ট অ্যান্ড ডিসরাপটিভ অ্যাক্টিভিটিজ (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট কার্যকারিতা হারায় ১৯৯৫ সালে। কিন্তু সানসেট ধারা না থাকলে কেন্দ্রীয় সরকারকে সংশ্লিষ্ট আইন বাতিল করে অর্ডিন্যান্স জারি করতে হয়। সেই অর্ডিন্যান্স পরবর্তী ছ’মাসের মধ্যে সংসদের অধিবেশনে পাশ করানো বাধ্যতামূলক। কিন্তু অর্ডিন্যান্স জারি না করলে সংসদেই সরকার ‘রিপিল’ বা আইন খারিজ করার প্রেক্ষিতে আইন আনবে। তা সংসদের দুই কক্ষে পাশ হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। রাষ্ট্রপতি তাতে সই করলে আইন খারিজ। এখানেও প্রশ্ন, যে যে ধারায় আইন বলবৎ হয়েছিল, ঠিক একইভাবে খারিজ হচ্ছে তো? কোনও লেজুড় রেখে দেয়নি তো সরকার? সেই রিপিল অ্যাক্টের খসড়া হাতে না পাওয়া পর্যন্ত তা বোঝা অসম্ভব। তাই সময় নিচ্ছেন কৃষকরা। বলছেন, আগে দেখি! অর্থাৎ তাঁরা দেখতে চাইছেন, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দেশবাসীকে আবার কোনও ধাপ্পা দিচ্ছে কি না। উপরন্তু, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের গ্যারান্টি আইনসিদ্ধ করাটাও কৃষকদের বহুদিনের দাবি। সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী কী করেন, সেটাও দেখতে চাইছেন আন্দোলনকারীরা। তাই ধর্না চলছে... চলবেও। কৃষকরা বুঝেছেন, মোদি সরকার ভয় পেয়েছে। তাই তাঁরাও এর পুরোদস্তুর সুযোগ নেবেন। তাঁদের লক্ষ্য এখন একের পর এক রাজ্যে বিধানসভা ভোট। যে নির্বাচনের গেরোয় পিছু হটার এত বড় সিদ্ধান্ত মোদিজি নিয়েছেন, এখন সেটাই হবে আন্দোলনের অস্ত্র। স্লোগান তো তাঁরা বাংলার বিধানসভা নির্বাচন থেকে ঠিক করেই রেখেছেন... ‘বিজেপিকে একটিও ভোট নয়’। সেই স্লোগানই এবার গর্জনের আকার ধারণ করবে। আর মোদিজি কী করবেন? গত সাত বছরে ছ’টি আইন তিনি খারিজ (রিপিল) করেছেন, বা সংশোধনী এনেছেন। সাত নম্বরটি তিনি আনবেন নিশ্চিত। কিন্তু বাকি দাবিগুলি? সেও কি মেনে নেবেন? এখানে রয়েছে চরম এক ধর্মসঙ্কট। কারণ, দাবি সব মেনে নিলে রাজনীতির দরবারে তাঁর মেরুদণ্ড আরও বেশি ভেঙে পড়বে। বিরোধীরা উল্লসিত হবে। আর জনতার কাছে একনায়কের যে চরিত্রের ছবি তিনি এঁকে রেখেছেন, তাতে বিস্তর কালিও পড়বে। কিন্তু সব দাবি মেনে নিলে? সেটাই কিন্তু হবে মোদিজির সত্যিকারের প্রায়শ্চিত্ত। আর প্রায়শ্চিত্তের সুযোগ তো সবার প্রাপ্য... তাই না? 
১৯ নভেম্বর দেখাল, দোর্দণ্ড এক রাষ্ট্রনেতার আড়ালে লুকিয়ে আছে সব হারানোর আতঙ্কে ভীত আর এক রাষ্ট্রনেতা।
এতদিন আমরা দেখেছি, তিনি যা ঠিক মনে করেন, সেটাই উন্নয়ন... সেটাই সংস্কার। আমরা জেনেছি, অটলবিহারী বাজপেয়ি, মনমোহন সিং জমানায় যে সব প্রকল্প ছিল, সেগুলির আসল রূপকার মোদিজিই। নাম বদলেছে আবাস যোজনার, সংখ্যালঘু উন্নয়ন প্রকল্পের, নির্মল ভারতের। নতুন নতুন নামে মোদিজি জাহির করেছেন নিজেকে। হেনস্তা করেছেন ভারতের ইতিহাসকে, কটূক্তি করেছেন পরিষেবা নিয়ে। প্রচার করেছেন, রেল, সড়ক, টেলিফোন, কম্পিউটার... কতই না শোচনীয় ছিল আগের সব সরকারের জমানায়। আমরা শুনেছি। অনেকেই হাততালি দিয়েছে... দেশে... বিদেশে। বলেছে, ঠিক... ঠিক... ঠিক। দেশের তখন বদনাম হয়নি। কারণ, প্রধানমন্ত্রী নিজে বলছেন। তিনি দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীদের নামে কুৎসা করেছেন... তাও তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী নন। কারণ, তিনি ভারতের ‘অধিনায়ক’। ভোট প্রচারে রাজ্যে রাজ্যে গিয়ে বিরোধীদের আক্রমণ করেছেন, শালীনতার সীমা ছাড়িয়েছেন। তাও তিনি বীর দাস নন। তিনি প্রধানমন্ত্রী। ভোট আসছে... পাঁচ রাজ্যের। মোদিতন্ত্রের রাজদণ্ড এখন কথা বলছে গণতন্ত্রের। ক্ষমা চাইছে দেশবাসীর কাছে। 
এরপরও মনে রাখতে হবে, ডঃ জ্যাকেলের মধ্যেই কিন্তু লুকিয়ে থাকে মিস্টার হাইড।

23rd     November,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ