বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

দুয়ারে রেশন: দীর্ঘ
দুর্ভোগের অবসান
তন্ময় মল্লিক

রেশন তোলার দিন হলেই অযোধ্যা পাহাড়ের বাঁধঘুট গ্রামের ববিতা মুর্মু, লক্ষ্মীমণি মুর্মুদের গায়ে জ্বর আসে। সাতসকালে উঠে একমুঠো পান্তা নাকেমুখে গুঁজেই বেরিয়ে পড়া। তাড়াতাড়ি পা চালায়। পাহাড়ি পথ ভেঙে যেতে হবে সেই পাথরডিহি। পাক্কা ১১কিলোমিটার। রেশন দোকান সেখানেই। দেরি হলেই পড়তে হয় লম্বা লাইনের মুখে। তারপর রেশনের চাল, গমের বস্তা কাঁধে নিয়ে বাড়ি ফেরা। পাহাড়ি পথ। তাই একটানা হাঁটা যায় না। একটু একটু করে ওঠা আর জিরিয়ে নেওয়া। এভাবে বাড়ি পৌঁছতে সন্ধে পেরিয়ে হয়ে যায় রাত। তখন শরীর আর বয় না। তবুও নিস্তার নেই। সারাদিন বাপ মাকে ছেড়ে ঘরে থাকা ছেলে দু’টো তখনও জেগে। অপেক্ষা গরম ভাতের। তাই রাত যত গভীরই হোক না কেন, শুকনো মুখে হাসি দেখার জন্য ফোটাতে  হয় রেশন থেকে আনা চাল। 
ববিতা বলেন, গাড়িতে চেপে রেশন নিয়ে আসার পয়সা আমাদের নেই। তাই স্বামী স্ত্রী মাথায় করে রেশন আনি। ছেলে দু’টো সারাদিন কী করে, কোথায় যায়, কিছুই জানি না। চিন্তায় থাকি। সেই রেশনের চাল, গম, আটা বাড়িতে বসে পাব, তা স্বপ্নেও কেউ ভাবিনি।
বাড়িতে বসে রেশন পাবে শুনে লক্ষ্মীমণি মুর্মুর উচ্ছ্বাস আর ধরে না। তাঁর কথায়, সন্ধে নামলেই নির্জন পাহাড়ি রাস্তায় প্রতি পদে পদে লুকিয়ে থাকে বিপদ। বন্য জন্তু, হাতির উৎপাত। মাঝেমধ্যেই ড্রেনে ঢুকে হাতির হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে হয়। দিদি আমাদের কষ্টটা বুঝেছেন।
হ্যাঁ, এই সব ববিতা, লক্ষ্মীমণির মতো প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষদের জন্যই ‘দুয়ারে রেশন’। তাই শহরে বসে যাঁরা ‘পাড়ায় রেশন’ বলে কটাক্ষ করেন তাঁরা এই প্রকল্পের মর্ম কিছুতেই বুঝবেন না। কিন্তু ববিতা, লক্ষ্মীমণির মতো হাজার হাজার মানুষ বুঝতে পারছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুয়ারে রেশন শুধু অভাবনীয়ই নয়, যুগান্তকারী। যুগ-যন্ত্রণার অবসানের লক্ষ্যে এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।
ঝালদার সারজুমাতু গ্রামের ভগীরথ কালিন্দি, ইন্দিরা কালিন্দিদের মনে আছে? হ্যাঁ, এঁরা রেশন কার্ড বন্ধক রেখে কেউ নিয়েছিলেন বাবার শ্রাদ্ধের টাকা, কেউ টাকা নিয়ে দিয়েছিলেন মেয়ের বিয়ে। টাকা ধার নেওয়ার জন্য গচ্ছিত রাখতে হয়েছিল পরিবারের রেশন কার্ড। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলো শোধ দিতে পারেননি ধারের টাকা। তাই তাঁদের রেশন কার্ড ছিল কারবারির ঘরেই। বছরের পর বছর। করোনার সময় কাজ হারানোয় তাঁদের দিন কাটছিল অনাহারে, অর্ধাহারে। ফাঁস হয়েছিল রেশন কার্ড বন্ধকের অভিনব ঘটনা। রেশনের চাল, গমও ‘সুদ’ হতে পারে, জানা গিয়েছিল তখনই।
এখন রেশন নিতে গেলে লাগবে কার্ডের মালিকের আঙুলের ছাপ। এমন এক ব্যবস্থায় বেজায় খুশি ভগীরথ। তাঁর কথায়, ‘অভাবের সুযোগ নিয়ে গরিবের মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়ার দিন এবার শেষ।’
বাম শাসনের ২৭ বছরের মাথায় ২০০৪ সালে ঘটেছিল আমলাশোলে অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা। তার কারণ? রেশন ব্যবস্থায় সীমাহীন দুর্নীতি। রেশনে বরাদ্দ চাল, গম অশিক্ষিত, গরিব মানুষরা পেতেন কালেভাদ্রে। তার বেশিরভাগটাই চলে যেত খোলাবাজারে। বিক্রি হতো চড়া দামে। সেই টাকা ভাগ হতো ডিলার ও নেতাদের মধ্যে। বছরের পর বছর চলা এই অনাচার অর্ধাহারে জীর্ণ মানুষগুলোকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। 
২০০৭ সালের অক্টোবর মাসে ফের রেশন কাণ্ডে উত্তাল হয়েছিল রাজ্য। কারণ? রেশন ব্যবস্থায় সীমাহীন দুর্নীতি। প্রতিবাদ দমিয়ে রেখেছিল নেতাদের লালচোখ। ফলে ওজনে কম দেওয়া ও বেশি দাম নেওয়া অধিকাংশ ডিলারের অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিবাদে প্রথম রুখে দাঁড়িয়েছিল বাঁকুড়ার ইন্দাস। তারপর জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়েছিল প্রতিবাদের আগুন। তাতেই জ্বলেছিল রেশন ডিলার ও সিপিএম নেতাদের বাড়ি। এমনকী, রেশন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল শান্ত নিরীহ ঝাড়গ্রামও। জনরোষে ঘরছাড়া হয়েছিলেন হার্মাদ নেতা অনুজ পাণ্ডে। অশান্ত হয়েছিল জঙ্গলমহল। জাঁকিয়ে বসেছিল মাওবাদীরা।
জঙ্গলমহল এখন শান্ত। কারণ কী? এর উত্তরে প্রায় সকল গবেষক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দু’ টাকা কেজির চাল প্রকল্পকেই এক নম্বরে রেখেছিলেন। মমতা বুঝেছিলেন, মানুষের পেটের খিদে মেটাতে পারলেই শান্ত হবে জঙ্গলমহল। তারপর তৃণমূল সরকারের বয়স যত বেড়েছে, রেশনের সঙ্গে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করার প্রয়াস ততই জোরদার হয়েছে। করোনা থাবা বসানো মাত্র শুরু করেছিলেন ফ্রি রেশন। সরকারে ফিরলে ফের বিনা পয়সায় রেশন। তাও মিলবে বাড়িতে বসে। নির্বাচনে দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে দৃষ্টান্ত তৈরি করছেন মমতা।
উদ্দেশ্য ছিল, ডিলারের চুরি রুখে দিয়ে সেই টাকায় সাধারণ মানুষকে পরিষেবা দেওয়া। প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে গিয়ে খুলেছে কর্মসংস্থানের দরজা। প্রত্যেক ডিলার দু’জন কর্মীকে রাখতে পারবেন। মাসিক ভাতা ১০ হাজার টাকা। অর্ধেকটা দেবে সরকার, বাকিটা ডিলার। বাড়ির খেয়ে গ্রাম বাংলায় মাসে ১০ হাজার টাকা উপায়ের সুযোগ, যে কোনও বেকারের জন্য হাতে চাঁদ পাওয়া। এই সুযোগ পাবেন প্রায় ৪২ হাজার যুবক। এছাড়াও ডিলারদের কমিশন দ্বিগুণ হয়েছে। গাড়ি কিনলে মিলবে এক লক্ষ টাকা অনুদান। আর সাধারণ মানুষের জন্য রয়েছে অন্য জেলায় বসেও রেশন তোলার সুযোগ।
এরপরেও ‘দুয়ারে রেশন’ প্রকল্পকে বানচাল করার চেষ্টা হবে। কারণ ই-পস মেশিন। এই মেশিনের মাধ্যমে রেশন দেওয়া বাধ্যতামূলক হলে বন্ধ হয়ে যাবে চুরির রাস্তা। এতদিন নিজের রেশন দোকানে বসে ওজনে মাল কম দেওয়ার পর চোখ রাঙিয়েও পার পাওয়া যেত। সেই সুযোগ আর থাকবে না। বন্ধ হবে নিরক্ষর মানুষের কাছ থেকে বেশি দাম নেওয়া।
মমতার স্বপ্নের প্রকল্প ঘেঁটে দেওয়ার নানান চেষ্টা যে হবে, তা বুঝেছেন মুখ্যমন্ত্রীও। তাই প্রকল্প উদ্বোধনের দিনেই তাঁর হুঁশিয়ারি, ‘এরপর কোনও কিন্তু কিন্তু করবেন না। কাজটা করতেই হবে। কাজ করতে বাধা দেবেন না।’ কৃষকবন্ধু প্রকল্পের অনুদানের টাকা দ্বিগুণ করা, স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের পর দুয়ারে রেশন। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালনের শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে মমতার হুঙ্কার, ‘কাজটা আমি করবই।’ খাদ্যমন্ত্রী রথীন ঘোষের কথায়, ‘প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা হবে, সেটা আমরা জানি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প জনস্বার্থে বাস্তবায়িত করা হবেই। বাধা দিলে কাউকে রেয়াত করা হবে না।’
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, রাজ্যে রেশন কার্ড রয়েছে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি। এর মধ্যে ৯ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষের নামে রেশন উঠছিল। খাদ্যদপ্তরের উপরতলার কর্তারা একটু কড়া হতেই ২লক্ষ ৮৪ হাজার মৃত ব্যক্তির সন্ধান মিলেছে। এছাড়া ডি-অ্যাক্টিভেটেড গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ১৫ লক্ষ ৫৪ হাজার। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা প্রায় ১৮ লক্ষ। এই বিপুল সংখ্যক নাম বাদ যাবে। চলছে আরও ঝাড়াই বাছাই। তাতে প্রতিটি জেলা থেকেই হাজার হাজার ভুয়ো রেশন কার্ডের সন্ধান মিলছে। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা ৫০ লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে বলে খাদ্যদপ্তরের কর্তাদের অনুমান। এথেকেই বোঝা যাচ্ছে, বছরের পর বছর কী বিপুল সরকারি অর্থের অপচয় হয়েছে। দুয়ারে রেশন চালু করে দুর্নীতির মৌচাক ভাঙতে চেয়েছেন মমতা।
স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে এককাপ চা হবে না। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার করে মানুষকে ভিখারি বানানো হচ্ছে। এমন চোখা চোখা ডায়ালগে বাজার কাঁপাতেন বিজেপি নেতারা। ‘দুয়ারে রেশন’ নিয়ে সেই সব নেতার মুখে টু শব্দ নেই। কারণ আগে তাঁরা মমতার যতগুলি প্রকল্পের বিরোধিতা করেছেন, প্রতিটিই ‘ব্যাক ফায়ার’ করেছে। তাই মুখ খোলার আগে নেতারা জল মাপতে চাইছিলেন। কিন্তু গুরুপূর্ণিমার সকালে তাঁদের গুরু নরেন্দ্র মোদি পথে বসিয়ে দিয়েছেন। এতদিন যে কৃষি আইন চাষিদের জন্য ভালো বলে তাঁরা গলা ফাটিয়েছিলেন, আজ সেটাই মোদি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হলেন। তাও কার্যত নাকখত দিয়ে ভুল স্বীকার করে। কারণ সাধারণ মানুষও বুঝেছে, কৃষি আইন আসলে চাষিদের জন্য নয়, করা হয়েছে কতিপয় শিল্পপতির স্বার্থে। এরপর বঙ্গ বিজেপির নেতারা কোন মুখে গলার শিরা ফুলিয়ে মমতার সমালোচনা করবেন? এখন তাঁদের একটাই কাজ, মুখ লুকানোর জায়গা খোঁজা। 
পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচনে ভরাডুবির ভয়, নাকি প্রধানমন্ত্রীও বুঝেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কালাকানুন পাশ করানো যায়, কিন্তু মানুষের মন পাওয়া যায় না। প্রধানমন্ত্রী যাই বুঝুন না কেন, দেশের মানুষ বুঝেছেন, শুরু হয়েছে মোদির পিছু হটা।

20th     November,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ