বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

সবই নাগরিক সমাজের
জন্য? প্রচার ও বাস্তব

শান্তনু দত্তগুপ্ত

ঘরের এক কোণে জবুথবু হয়ে বসে আছেন ছায়া বারুই। রোগা ডিগডিগে চেহারা। বয়সের ভারে কুঁচকে আসা গায়ের চামড়া হাড়ের সঙ্গে লেগে গিয়েছে। অপেক্ষা করছেন তিনি... বাবুর কখন একটু সময় হবে। পাশের লোকটার সঙ্গে গল্প করছেন বাবু। খুব হাসছেন। বোধহয় মজার কোনও কথাবার্তা হচ্ছে। মাঝে একজন কাস্টমার এল... বাবু অন্য খোপে পাঠিয়ে দিলেন। এক্ষুনি টিফিন হয়ে যাবে। বাবু উঠে যাবেন। আসবেন প্রায় এক ঘণ্টা পর। দীর্ঘশ্বাস পড়ল ছায়া বারুইয়ের... আজকের দিনটাও গেল। কাজ না করলে পয়সা আসে না। আর পয়সা এলে ব্যাঙ্ক থেকে তোলা আরও বড় ঝঞ্ঝাট। ভয় লাগে ছায়াদেবীর। আবার যেতে হবে ওই বাবুর কাছে। বুকটা দুরদুর করবে... আবার খেঁকিয়ে দূর করে দেবেন। দয়া হলে কাগজে খসখস করে কিছু লিখে দেবেন। সেটা নিয়ে অন্য একটা খোপে যেতে হবে। মেয়েমানুষটা বসে থাকবে ওখানে। খুব বকা দেবে। তারপর এগিয়ে দেবে বাক্সটা। কালির বাক্স। আঙুলে কালি লাগিয়ে টিপসই দিলে নিজের টাকা চোখে দেখতে পাবেন ছায়াদেবী। মনটা খুব খারাপ করে তখন... আগে তো হাতে হাতে টাকা পাওয়া যেত। আর এখন...! নীল কালিটাও ছাই বুড়ো আঙুল থেকে উঠতে চায় না।
* * *
ভলান্টিয়ারি রিটায়ারমেন্ট নেওয়ার সময় অনেকগুলো টাকা পেয়েছিলেন সমরেশবাবু। মন দিয়ে হিসেব কষেছিলেন তখন। শহরের বাইরে ছোট্ট একটা জমি ছিল। একটা মাথা গোঁজার মতো দু’টো ঘর বানিয়ে, বাকি টাকা ব্যাঙ্কে রেখে দিব্যি সুদে সংসার চলে যাবে। চলছিলও তো ভালোই। কিন্তু এখন বুঝতে পারছেন, সময় বদলাচ্ছে। এই সবে ষাটে পা দিলেন সমরেশবাবুর। ছেলেমেয়ে নেই। অসুস্থ গিন্নিই সম্বল। আগে যে ওষুধ কিনতে মাসে হাজার দুয়েক টাকা খরচ হতো, এখন পাঁচ হাজারেও মেলে না। বাজারের দাম আকাশছোঁয়া। গ্যাসের কানেকশন ছেড়ে দিয়েছেন। এর ওর রেশন কার্ড ধার করে কেরোসিন নিয়ে আসেন। ওতেই কোনও রকমে চালাতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা, আগে জমা টাকায় সুদ পেতেন ১২ হাজার টাকার মতো। এখন সাড়ে আট হাজার...। গিন্নি সেদিন বলছিল, ‘হ্যাঁ গো, তুমিও তো ব্যাঙ্কে কাজ করতে। রিটায়ার করার সময় বোঝোনি এমনটা হবে!’
* * *
সোফাটা নতুন। কম করে ৭০ হাজারের তো হবেই! প্রায় আধঘণ্টা হল বসে আছে আদিনাথ। প্রথমে বেশ আমেজ লাগছিল। এখন উসখুস করছে। রামনাথবাবু সেই কখন স্নান করতে গিয়েছেন... বউদি বলে গেল। এখনও তো আসছেন না! খিদেটাও খুব পেয়েছে। আজ সকালে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে না খেয়েই বেরিয়ে এসেছে আদিনাথ। বেশ নামটা বড্ড সেকেলে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই পছন্দ নয়। বন্ধুরা খুব পিছনে লাগত। আর এখন অন্য এজেন্টরা। অফিসাররাও খোঁচা দিতে ছাড়ে না। নামের ভাবনা মাথা থেকে সরিয়ে দিল আদিনাথ... বউদি একটু চা-বিস্কুট কি দেবে না? চা এল না... তবে রামনাথবাবু এলেন। নতুন পাটভাঙা গেরুয়া পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা চাপিয়ে। উঠে দাঁড়াল আদিনাথ। ‘কি হে চক্কোত্তি... কী মনে করে?’
—‘দাদা, একটা পলিসি করবেন বলেছিলেন...’।
—‘সোফাটা দেখলে...? ১ লাখ ৮ হাজার টাকায় কিনলাম। ডিসকাউন্টে’।
ঠোঁটটা শুকিয়ে এসেছে আদিনাথের। একটু জল পেলেও হতো... ‘পলিসি...’।
—‘হুমম... বলেছিলাম বুঝি? কী জানো, এসব পলিসি-ফলিসি করার মতো পয়সা এখন নেই বুঝলে। করলে ডেকে নেব।’
—‘দাদা, কত টাকা আর প্রিমিয়াম লাগবে বলুন... কোয়ার্টারলি সাড়ে তিন হাজার! আপনার কাছে কিচ্ছু না।’
—‘বটে? কে বলেছে আমার কাছে সাড়ে তিন হাজার কিচ্ছু না? আর তোমাদের এলআইসি করে কী হবে বল তো? মরলে আমার বউ পয়সা পাবে। ওকে পয়সা পাইয়ে আমি কী করব? যাও যাও, হবে না। এখন আমাকে আবার মণ্ডল সভাপতির সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে।’
মাথা নিচু করে বেরিয়ে এল আদিনাথ। ভাবছে... খিদেটা ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে।
* * *
এরা আম আদমি। বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় নাগরিক সমাজ। ব্যাঙ্ক, সুদ, পেনশন, বিমা... এই সাধারণ মানুষের জন্য। আর এই আম আদমি নিয়েই মহা মুশকিল। ভোটের সময় এগিয়ে এলে এঁরা মহামূল্যবান। ভোট পেয়ে গেলে এঁদের ছিটেফোঁটা গুরুত্ব রাজনীতিক সমাজে নেই। এই সেদিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বললেন, ব্যাঙ্ক-বিমা-পেনশন তিনিই চিনিয়েছেন মানুষকে। ২০১৪ সালে তিনি ক্ষমতায় আসার আগে আম জনতার সঙ্গে এই সব সরকারি পরিষেবার কোনও সম্পর্কই ছিল না! সত্যিই কি তাই? সব ভোগ করতেন উচ্চবিত্তরা। ২০১৪ সাল পর্যন্ত একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান দেখা যাক। মোদিজি ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত ভারতে রাষ্ট্রায়ত্ত যত ব্যাঙ্ক রয়েছে, তাদের সব মিলিয়ে শাখার সংখ্যা ছিল ৩৩ হাজার ৬২৭টি। আর এটিএম ছিল ৬০ হাজার ৮৭১টি। এই তালিকায় কিন্তু স্টেট ব্যাঙ্ক পড়ে না! হিসেব বলছে, ওই বছর পর্যন্ত দেশজুড়ে এসবিআইয়ের ব্রাঞ্চ ছিল ১৩ হাজার ৬৬১টি। এটিএম ৫১ হাজার ৭৫৩টি। একইভাবে বেসরকারি এবং বিদেশি ব্যাঙ্কের শাখা ছিল ৬ হাজার ৪৩৮টি। আর সব মিলিয়ে তাদের এটিএমের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০ হাজার। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে একটাই প্রশ্ন, এই সব ব্যাঙ্ক বা এটিএম শুধুই উচ্চবিত্তরা ব্যবহার করতেন? মাসের শুরুতে ব্যাঙ্কে লাইন পড়ত ষাটোর্ধ্বদের। সবাই আসতেন পেনশনের জন্য। কেউ তুলে নিয়ে যেতেন ৫ হাজার টাকা, কেউ ৮ হাজার। এঁরা সবাই কি উচ্চবিত্ত মোদিজি? সেই আটের দশকের শুরুর কথা... কারখানায় একটা সামান্য চাকরি পাওয়ার পর বিপ্লব সামন্ত একটা এলআইসি পলিসি করেছিলেন। বন্ধুরা বলেছিল, সামান্য ক’টাকা মাইনে... এলআইসি করলি কেন? বিপ্লববাবু বলেছিলেন, ‘কয়েকটা টাকা মাইনে পাই বলেই তো এলআইসি করলাম। এভাবেই ছেলেমেয়ের জন্য কিছু জমবে। না হলে আমাদের আর সঞ্চয় কী?’ 
জানেন মোদিজি... মধ্যবিত্ত, আম জনতা ঠিক এমনটা ভাবে। এভাবেই সংসার চলে তাদের। এভাবেই তারা আধা পেট খেয়েও সন্তানকে দুধে-ভাতে রাখার চেষ্টা করে এসেছে চিরকাল। আপনি ক্ষমতায় আসার অনেক আগে থেকেই। ১৯৬৯ সালের আগে স্টেট ব্যাঙ্ক ছাড়া অন্য কোনও ব্যাঙ্কই আরবিআইয়ের অধীনে ছিল না। ইন্দিরা গান্ধী এনেছিলেন—রাষ্ট্রায়ত্তকরণ। ভরসা পেয়েছিল মানুষ। মধ্যবিত্ত মানুষ। ভেবেছিল, যাক... এবার আর টাকা চোট যাওয়ার ঝুঁকি নেই। জওহরলাল নেহরুর আমলে আত্মপ্রকাশ করেছিল ভারতীয় জীবন বিমা নিগম। মানুষ ভেবেছিল, সরকার যখন মাথার উপর গ্যারান্টির ছাতা ধরছে... কষ্টের উপার্জন খোয়াতে হবে না। ঠিক ফেরত পাব। এটাই মানুষের সেন্টিমেন্ট... আবেগ... আর হিসেব। একরাশ আতঙ্ক বুকে চাপিয়ে টাকাগুলো আমরা জমা রাখার কথা ভাবি। খুঁজি নিরাপদ আশ্রয়...। সেই ব্যাঙ্ক আজ একের পর এক বিক্রির তালিকায়। এলআইসিরও বেসরকারিকরণ হতে চলেছে। তারপরও বলবেন, আপনার জমানায় ব্যাঙ্ক-বিমার সুবিধা মানুষ সবথেকে বেশি পাচ্ছে?
আপনার বোধহয় এক্ষেত্রে হোমওয়ার্ক ঠিকমতো হয়নি। হলে এমন কথা নিশ্চিতভাবে বলতেন না। ভাবতেন, এই মানুষগুলোই আমার ভোটার। কয়েক লক্ষ অন্ধ ভক্তকুল অবশ্যই আছে। যারা ন্যাশনাল মিডিয়ায় দাঁড়িয়ে বলতে পারেন, ’৪৭ সালে যে আজাদি পেয়েছি, সবটাই ভিক্ষার। ওই বছর কোন লড়াই হয়েছিল, বলতে পারলে পদ্মশ্রী ছেড়ে দেব! এই অর্বাচীনদের একটু বোঝাবেন... পেটে বিদ্যে থাকলেই কথা বলতে হয়। না হলে মুখ থেকে গু-গোবর বেরিয়ে আসে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের নাম পুরোটা বলতে পারে না এইসব অর্বাচীন... বলে, নেতা বোস। আপনাদের শুনে হয়তো ভারি আমোদ হয়, কিন্তু সাধারণ মানুষ এসব তেতো গেলার মতোই হজম করেন। সামনে পাঁচ রাজ্যের ভোট আসছে। এই তেতো গেলা মানুষগুলোই আপনাদের ক্ষমতায় ফেরানোর ঈশ্বরী পাটনী। নিজে বেঁচে-না বেঁচে এঁরা সন্তানের ভালোর কথা ভাববেন। আপনাদের ঈশ্বরের আসনে বসাবেন, আর ভোট দেবেন। হয়তো আপনারা তেমনটাই ভাবেন। কিন্তু বিশ্বাস?... রাখতে পারেন? 
নাঃ, পারেন না। তাহলে অজিত দোভাল নাগরিক সমাজের উপর নোংরাভাবে অনাস্থা জ্ঞাপন করতেন না। এই সেদিন তিনি বলেছেন, নাগরিক সমাজই এখন দেশের সবচেয়ে বড় শত্রু। নাগরিক সমাজই এখন দেশের সবচেয়ে বড় যুদ্ধক্ষেত্র। জাতীয় স্বার্থে আঘাত হানার অস্ত্র...। অবিশ্বাস আপনাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। কয়েকটা জমির টুকরো দিয়ে দেশ হয় না... সংসদ, বিধানসভা ভবনেও না। দেশ গঠন করে দেশের মানুষ। আপনারা ভাবেন, এই নাগরিক সমাজ একত্রিত হয়ে আপনাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার চূড়ান্ত ক্ষমতায় বসিয়েছে। এরাই যদি কাল প্রতিপক্ষের হয়ে জোট বাঁধে? তাহলে তো সব শেষ! তাই চালাও বিভাজনের ছায়াছবি... গোরক্ষার নামে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, ঘর ওয়াপসি, লাভ জেহাদ। ওই লোকটা আওয়াজ তুলছে? তুলে আনো মাঝরাতে। বলো... ও শহুরে নকশাল। মদত দিচ্ছে জঙ্গিদের। হাতে স্টিকার রেডি আছে... ইউএপিএ। দেশদ্রোহী এরা। কী কথা বলছে? জানতে হবে। পেগাসাস ঢুকে পড়ছে ফোনে। কখনও দিল্লির দাঙ্গা হচ্ছে, কখনও ভীমা কোরেগাঁও, কখনও জামিয়-মিলিয়া। শিরায় শিরায় রক্তের সঙ্গে ছুটবে আতঙ্ক... শাসকের প্রতি। 
আর প্রধানমন্ত্রী বলবেন... এই দেখুন, যা করছি সব আপনাদের জন্য। মানুষের জন্য, গরিব সমাজের জন্য। আগের সরকার কী করেছিল, ভুলে যান। সবই আমরা করছি। ৭০ বছরে যা হয়েছিল, সব ক্রেডিট আজ আমরা নিলাম। আপনারা বিশ্বাস করুন। ভোট দিন। 

16th     November,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ