বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

বঙ্গ বিজেপির প্যারাস্যুটে
পাতাল প্রবেশ...!

হিমাংশু সিংহ

একটা একটা করে সিঁড়িতে পা না দিয়ে বঙ্গ রাজনীতিতে লাফিয়ে একেবারে ক্ষমতার ওপর তলায় উঠতে চাওয়ার চড়া মূল্য আজ দিতে হচ্ছে গেরুয়া শিবিরকে। সেই সঙ্গে ভোটের মুখে আদ্যন্ত সুবিধাবাদী আর বিশ্বাসঘাতকদের দিয়ে ঘর বোঝাই করার বিষময় পরিণামও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন তাঁরা। স্বভাবতই দু’শো আসন জেতার অলীক স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়ায় চূড়ান্ত হতাশা গ্রাস করছে। কারণ লোকসভা ভোটের পর থেকে একটাই প্রচারে বিজেপি নেতারা জীবন বাজি রেখেছিলেন। ‘বাংলা দখল হয়ে গিয়েছে, ক্ষমতায় আসছি আমরাই।’ সেই প্রোপাগান্ডার বেলুন চুপসে যেতেই এমনটা হওয়া খুব স্বাভাবিক। হচ্ছেও তাই। নীতিনিষ্ঠ বলে দাবি করা সঙ্ঘ অনুপ্রাণিত সংগঠনের এই উলটপুরাণ দেখার জন্য খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। মাত্র ছ’মাসই অনেক কিছু দেখিয়ে দিয়েছে। বিধানসভা ভোটের ফল বেরনোর বিকেল থেকেই একদা দমবন্ধ হওয়াদের সেকেন্ড রাউন্ড দল ছাড়ার নরকগুলজার পুরোমাত্রায় গেরুয়া শিবিরকে হাসির খোরাকে পরিণত করেছে। জেলায় জেলায় আজ দলের ছন্নছাড়া অবস্থা। একদিকে আদি সদস্যরা ফুঁসছেন। অন্যদিকে, তৃণমূলে একদা দমবন্ধ হওয়া দলবদলুরা ভোল পাল্টে বলছেন, পুরনো জায়গাটাই ভালো ছিল, গেরুয়া শিবির তো দেখছি আরও খারাপ, একেবারে গ্যাস চেম্বার! ওঁদের নতুন নাম হয়েছে ‘রিভার্স দলবদলু’। শুনছি, হেস্টিংসের হীরেমুক্তোখচিত চোখ ধাঁধানো অফিসে দলবদলুদের পুরনো নেমপ্লেট নাকি আজকাল কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর কৈলাস বিজয়বর্গীয় সহ যে একঝাঁক অবাঙালি নেতা দোকান খুলে বসেছিলেন, আজ এই দুর্দিনে তাঁদের টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। পুরভোটের কী হবে, দেখার নেই কেউ। কলকাতায় সাতটা ওয়ার্ড জিততেও হিমশিম খেতে হবে এই বীরপুঙ্গবদের।
দিল্লি আর মেদিনীপুর থেকে একসঙ্গে হাওয়া দিয়ে ফোলানো বঙ্গের এক ‘ব্যর্থ’ ভূমিপুত্রের নেতৃত্বের কঙ্কাল চেহারা সামনে এসে পড়েছে। আসারই কথা। এখনও তিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন কি না জানি না। তা দেখতেই পারেন, তবে জেলায় জেলায় তাঁকে নিয়ে গেরুয়া শিবিরের অশান্তি চরমে। জেলায় তিনি পা দিলেই যে-ক’জন এখনও পড়ে আছেন তাঁরাও আড়াআড়ি দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছেন। উত্তর থেকে দক্ষিণ সর্বত্র দিলীপ ঘোষ আর সুকান্ত মজুমদারদের একটাই প্রশ্ন তাড়া করছে, ভোটের আগে আসা ভুঁইফোঁড় তৃণমূল নেতার কথা শুনব কেন? দলকে তিনি কিংবা তাঁর সতীর্থরা কী দিয়েছেন, নিজের আখের গোছানো ছাড়া? সেইসঙ্গে একটা সত্য আবারও সূর্যের আলোয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, শিবির বদলালেও বেইমানদের চরিত্র সব দলেই কিন্তু এক। এ-পাত্র থেকে ও-পাত্রে ঢাললে ইতরবিশেষ হয় না। এঁদের আলাদা কোনও দল হয় না। এঁরা পাক্কা সুযোগসন্ধানী। তাই তৃণমূল ভেঙে যাঁরা ভোটের আগে বিজেপিতে ঢুকেছেন তাঁরা কেউ দলটা করার জন্য ভালোবেসে যাননি, ক্ষমতা আর ধান্দার জন্য গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন এই গেলুম আর পরের দিন সকালেই মুখ্যমন্ত্রী, খেলমন্ত্রী কিছু একটা হলাম। ব্যস, দু’পকেট ভর্তি কামাই। প্রত্যেকের অবশ্যই আলাদা আলাদা এজেন্ডা ছিল। কেউ গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তাঁর গোটা পরিবার, মায় বৃদ্ধ বাবা ও ভাইদের কয়েক দশকের পরম আশ্রয়দাতার বিরুদ্ধেই বদলা নেবেন বলে। এটাই নিশ্চয় তাঁর কাছে মহাভারতের পরম শিক্ষা! কেউ শিবির বদলেছিলেন ক্ষমতা পেয়েই জেলায় দাপিয়ে বেড়ানো অন্য গোষ্ঠীকে রাতারাতি শায়েস্তা করবেন বলে। সেই স্বপ্নকে তা দিতেই দরজায় হাজির ছিল দিল্লির সরকারের দামি চার্টার্ড প্লেনও। গন্তব্য ছিল সোজা দিল্লিতে অমিত শাহের ঘর। ওই মন্দিরে মাথা ঠুকলে পিছনে যদি ইডি, সিবিআই লেগেও থাকে মামলা ঘুমিয়ে পড়বে, প্রচার ছিল এমনই। আবার ব্যর্থ কিছু অভিনেতা, অভিনেত্রীর স্বপ্ন ছিল ২ মে’র পর গোটা টলিউড শাসন করবেন একা। উচ্চাকাঙ্ক্ষীরা নানারকম ভাবতেই পারেন, কিন্তু দলটার নাম যখন বিজেপি, তখন এত বড় ভুল হল কেমন করে? বিন্দুমাত্র আক্কেল থাকলে পুরনো দল করা লোকেদের ব্রাত্য করে টালিগঞ্জের কিছু বাতিল ধান্দাবাজ নায়ক-নায়িকার ঘাড়ে বন্দুক রেখে দু’শো আসন জেতার দুঃস্বপ্ন কেউ দেখে! বিশেষ করে যে দলটার আজও মূল শক্তি সঙ্ঘের আদর্শ ও শক্তি। সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বলে যাঁরা বড়াই করেন, তাঁদের এ কী অবস্থা! ভোট মিটতেই অবাঙালি কেন্দ্রীয় নেতারাই-বা নিখোঁজ কেন? কখনও পাঁচতারা হোটেল, আবার কখনও ঝাঁ-চকচকে পার্টি অফিসে তাঁদের কাজু আমন্ড সহযোগে যোগদান মেলার আসরে এক কেন্দ্রীয় নেতার বিস্তৃত ঠোঁট থেকে লালা ঝরে পড়ার ছবি, সব মনে আছে। মধুমাস কোথায় হারিয়ে গেল? 
অথচ গতবছর ঠিক এই সময় কোভিডের প্রথম ঢেউ একটু স্তিমিত হতেই বঙ্গ রাজনীতি আন্দোলিত হয়েছিল একটিমাত্র বাক্য ঘিরে। গত দীপাবলিতেও সেভাবে বাজি ফাটেনি। তখনও মেদিনীপুরের স্বঘোষিত ‘ভূমিপুত্র’ দলত্যাগও করেননি। তৃণমূলের মন্ত্রী হয়ে বসে আছেন। আর গাছেরও খাচ্ছেন, তলারও কুড়োচ্ছেন। তবে অমিত শাহদের সঙ্গে ডিল—কলা-মুলোর হিসেব হয়ে গিয়েছে পাক্কা। তাই দল ছাড়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছেন ধীরে ধীরে। হঠাৎ নাটকীয় ঢঙে মেদিনীপুরে এক সভায় তিনি বলে বসলেন, ‘আমি লিফটেও উঠিনি, প্যারাস্যুটেও নামিনি’। হয়তো কোনও অরাজনৈতিক গরিব খেটে খাওয়া পরিবার থেকে উত্থান, ভেবেছিল বঙ্গবাসী। ভাগ্যিস, হাউই কিংবা রকেটের কথা বলেননি, এটুকুই রক্ষে। আহা যেন শোলে মার্কা কোনও হিন্দি ছবির ডায়লগ। ঘরে বাইরে হই হই পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু, একবছর অতিবাহিত হওয়ার পরই আক্কেল গুড়ুম হয়ে গিয়েছে। যে দলে বা ডালে তিনি বাসা বেঁধেছিলেন মনে হচ্ছে তাদের এই দুর্দিনে এখন সবচেয়ে বড় লায়াবিলিটি তিনিই। কারণ বক্তার দৌড় অমিত শাহ থেকে এরাজ্যের প্রান্তিক মানুষ, সবাই গত ১১ মাসে দেখে ফেলেছে। আর এখন দেখছে ইঁদুরকে বাঘ বানানোর আফটার শকটা ক্ষমতা দখলের মিথ্যে স্বপ্ন ফেরি করা দলটার গতরে কত ভয়ঙ্করভাবে লাগে! যাঁরা তাঁর কথায় ভুলে দল ছেড়েছিলেন তাঁরা প্রকাশ্যে বলছেন, আমাদের সর্বনাশ করেছেন। বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে তাঁরা অনেকেই আবার পুরনো দলে ফিরেছেন। বাকিরা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন, অপেক্ষা করছেন কখন ডাক আসবে। তাঁর কথায় ভুলে যে অধিকাংশেরই রাজনৈতিক কেরিয়ারের সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে, একবাক্যে বলছেন সবাই। একই সঙ্গে তাঁর নিজের জেলাতেও গেরুয়া দলের ভিত্তি আজ কম্পমান। দলবদল হচ্ছে সেখানেও। গোটা দক্ষিণবঙ্গেই একই অবস্থা। আর উত্তরেও দ্রুত ভাঙছে ভিত্তি। প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, শূন্যগর্ভ আস্ফালন দিয়ে আর যাই হোক রাজনীতি হয় না। বিশেষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো দশকের পর দশক ধরে পরীক্ষিত জননেত্রীর বিরুদ্ধে। আদি আর নব্যের লড়াইও আবর্তিত হচ্ছে তাঁকে ঘিরেই। এমন চললে আসন্ন পুরভোটে দলের অস্তিত্বরক্ষাই যে কার্যত অসম্ভব হয়ে যাবে তা জলের মতোই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।
বিজেপির মতো সংগঠনভিত্তিক সঙ্ঘ পরিবারের আদর্শে অনুপ্রাণিত একটা দল ক্ষমতা দখলের লোভে এমন ব্লান্ডার করবে তা বোধহয় কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। না-হলে দল ভাঙিয়ে বাংলা দখলের দুঃস্বপ্ন কেউ দেখে! কোনও বড় দলের পাঁচজন খেলোয়াড়কে ভাঙিয়ে নিয়ে গেলেই নতুন সেই দলটা চ্যাম্পিয়ন হয় না। ছেলের মাথা না থাকলে দশটা অঙ্কের শিক্ষক দিয়েও আইআইটির মেধা তালিকায় জায়গা হয় না। আজ বঙ্গ বিজেপিরও সেই একই অবস্থা। আর আজ ২৮ বছর দল করা ‘আদি নেতা’ হাওড়ার সুরজিৎ সাহা দল-বিরোধী মন্তব্য করার জন্য বহিষ্কৃত হন। অথচ স্বয়ং রাজ্য সভাপতির শিক্ষাদীক্ষা, দৌড় নিয়ে মুখ খুলেও বেমালুম পার পেয়ে যান তথাগত রায়। সুরজিৎ তো ঠিকই বলেছেন, পুরভোটে হাওড়ায় যাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তিনি আগে তাঁর নিজের বুথে জিতে দেখান। আসলে অতিরিক্ত স্টেরয়েড দিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে রাজ্যে দু’শো আসনের স্বপ্ন দেখা দলটা আজ আবার কোনওক্রমে কয়েকটা বিধানসভা আসন জয়ের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। ২০১৯-এর লোকসভায় ১৮টি আসন জেতার মধুর স্মৃতি তাই ক্রমশ ফিকে হতে বাধ্য। আগামী চব্বিশে তাই আবার নতুন করে পথচলা শুরু করতে হবে। লোভী দলবদলুদের দিয়ে সেই কাজ যে সম্ভব নয়, তা কে না জানে। আর এখানেই ২৮ বছর দল করাদের সঙ্গে গত একবছর উড়ে এসে জুড়ে বসাদের লড়াই তীব্র হবে। বঙ্গ বিজেপির সেই মুষলপর্ব পুরভোটে আরও চরম আকার নেবে। 
আর এই সঙ্কটের দায় শুধু একজনের নয়, গোটা দলের। বিজেপি ভেবেছিল অসম আর ত্রিপুরার কায়দায় বাংলা দখল করতে। বঙ্গ-রাজনীতি, বঙ্গ-সংস্কৃতি যে আদ্যন্ত এক অবাঙালি-প্রধান উগ্র সাম্প্রদায়িক দলকে অত সহজে গ্রহণ করবে না, এই সার সত্যটা তাঁরা ভেবেই দেখেননি। বিশেষ করে সাধারণ ঘরের মহিলারা। তার উপর নোট বাতিল থেকে শুরু করে জিএসটি, পেট্রল ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি যাবতীয় ইস্যুতে মানুষ নরেন্দ্র মোদির উপর বীতশ্রদ্ধ। এই পরিস্থিতিতে এক মেদিনীপুরের বেইমান ভূমিপুত্রকে সামনে রেখে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একচুলও অনিষ্ট করা সম্ভব নয়, এই সার সত্যটা আগেই বোঝা উচিত ছিল। আসন্ন পুরভোটেও এই ভুলের চড়া মাশুল দিতে হবে গেরুয়া শিবিরকে। বিজেপির মতো দল ব্যক্তি কেন্দ্রিক মোহে চালিত হলে তার পরিণাম যে কী বিষময় হয়, তারই প্রমাণ গোটা ঘটনাপ্রবাহ।
একবছর আগে বলেছিলেন, লিফটেও উঠিনি, প্যারাস্যুটেও নামিনি। আর আজ একবছর বাদে? টাকা, পেশিশক্তি, কেন্দ্রের সব এজেন্সিকে নামিয়েও দলটা একচুলও এগতে পারেনি। উল্টে, ক্রমেই অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। চব্বিশের লোকসভা ভোটে আবার মোদির ডেলি প্যাসেঞ্জারি শুরু হওয়ার আগে ভূমিপুত্রের সৌজন্যে দলটাই না পাতালে ঢুকে যায়! তখন ব্যর্থ এই মানুষটির উপর অমিত শাহরা আর আস্থা রাখতে পারবেন তো?

14th     November,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ