বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

প্রচার করুন মোদিজি... কিছু পরামর্শ
শান্তনু দত্তগুপ্ত

এনডিএমসি সেন্টারের গেটের ঠিক মুখটায় নরেন্দ্র মোদির প্রমাণ সাইজের একটা কাট আউট। ঢুকেই বাঁদিকে আর একটা। তবে এই কাট কাউট কোভিড ভ্যাকসিনের ভায়াল আর সিরিঞ্জের। পাশে লেখা... ১০০ কোটি ডোজের জন্য ধন্যবাদ মোদিজি। তার ঠিক পরেই বিরাট আকারের একটা ফ্লেক্স... মোদিজি সেখানেও জ্বলজ্বল করছেন। সেই ছবির ক্যাপশন—বিশ্বপ্রিয় নেতা। এই ছিল দিল্লিতে বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকের আয়োজন। আর সবটাই মোদিময়। প্রতি পদক্ষেপে প্রমাণের মরিয়া চেষ্টা—নরেন্দ্র মোদি এখনও কতটা জনপ্রিয়। রীতিমতো আগ্রহের সঙ্গে সবক’টি পোস্টার, কাট আউট দেখলেন প্রধানমন্ত্রী। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তারপর ঢুকে পড়লেন তাঁদের দলীয় বৈঠক-যজ্ঞে। এটাই চাইছিলেন। প্রচার চাই। এই ক’বছরের কী কী করেছে তাঁর সরকার... দেখাতে হবে মানুষকে। বোঝাতে হবে—মোদি ছাড়া গতি নেই। কিন্তু কোন কোন কাজের প্রচার করবে দল? তার তালিকা কি ঠিক হয়ে গিয়েছে? না হয়ে থাকলে সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে কিছু সাজেশন দেওয়ার ধৃষ্টতা করছি।
নোট বাতিলের যন্ত্রণা
মোদিজি, প্রথমেই আপনাকে বলতে হবে নোট বাতিলের কথা। পাঁচ বছর পূর্ণ করল এই ‘অর্থনৈতিক সংস্কার’। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর ঠিক রাত ৮টায় জাতির উদ্দেশে বলতে শুরু করেছিলেন আপনি। ঠিক তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভারতীয় অর্থনীতি থেকে মুছে গিয়েছিল ৫০০ ও হাজার টাকার সেই সময়ের নোট। পথে বসেছিল লক্ষ লক্ষ পরিবার। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ছোট ছোট ব্যবসার ঝাঁপ। শুরু হয়েছিল ব্যাপক ‘ছাঁটাই অভিযান’। দপ্তরে চাকরি নেই, পেটে খাবার নেই। বাড়ি-গাড়ির কিস্তির টাকা মেটাতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলেন বহু মানুষ... বহু ভারতীয়। কালো টাকা উধাও করে দেওয়ার এই মোদি-সংস্কারের ঘুড়ি গোঁত্তা খেয়ে নেমেছিল মাটিতে। তারপর? প্রায় সব ৫০০ ও হাজার টাকার নোট 
ফিরে এসেছিল রাজকোষে। তাহলে কালো টাকা 
কি দূর হল? না, হল না। নোট বাতিলের পাঁচ বছর পর, ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ভারতের বাজারে 
নগদের পরিমাণ দেশের গড় উৎপাদনের (জিডিপি) ১৪.৫ শতাংশ। ঠিক যেমনটা ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ছিল। এই অনুপাত যতটা কম হয়, ততই অর্থনীতির পক্ষে মঙ্গল। একদিকে লেনদেনে স্বচ্ছতা থাকে, উল্টোদিকে ক্যাশলেস ব্যবস্থা গুরুত্ব পায়। অর্থাৎ আজকের তারিখে দাঁড়িয়ে একটা বিষয় পরিষ্কার—এই সরকারের সিদ্ধান্ত ভুলই ছিল। এমনকী, ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিং, ফোন পে, ওয়ালেট ব্যবহারের যে উড়ান মোদিজির সংস্কার নিয়েছিল, ডানা ছাঁটা গিয়েছে তারও। 
অপুষ্ট শিশু
গত মাসের ১৭ তারিখ একটি রিপোর্ট সামনে এসেছিল। তাতে দেখা যায়, বিশ্ব ক্ষুধাসূচকে ১১৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০১। হাঁ হাঁ করে উঠেছিল নরেন্দ্র মোদির সরকার। দাবি করেছিল, এসব রিপোর্ট ভুলভাল। আমাদের দেশের মাত্র ৩.৯ শতাংশ অঙ্গনওয়াড়ি শিশু প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় না। কিন্তু সম্প্রতি একটি আরটিআইয়ের জবাবে সেই মহিলা ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রকই জানিয়েছে, ভারতের ৩৩ লক্ষেরও বেশি শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। আর তাদের মধ্যে প্রায় ১৮ লক্ষ শিশুর অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ (সিভিয়ার অ্যাকিউট ম্যালনারিশড চিলড্রেন)। অর্থাৎ তাদের প্রাণ সংশয় রয়েছে। এই তথ্যটি কিন্তু গত মাসে সামনে আনেনি সরকার। গত বছর নভেম্বর মাসের তুলনায় মারাত্মক অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা বেড়েছে ৯১ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান যথেষ্ট উদ্বেগজনক। দেশে শিশুর সংখ্যা প্রায় ৪৬ কোটি। তার মধ্যে মহারাষ্ট্র, গুজরাত এবং বিহার রয়েছে অপুষ্টিজনিত রোগে ভোগা শিশুদের তালিকার শীর্ষে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর নেপথ্য কারণ কোভিড মহামারী। এই রোগ এবং তার ফলে বারবার লকডাউন আঘাত হেনেছে প্রায় সবরকম আর্থ-সামাজিক সেক্টরে। উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত ছাড়া সমাজের অন্যান্য আর্থিক সেক্টরের মানুষ প্রায় নিঃস্ব হয়ে গিয়েছে। নরেন্দ্র মোদি মহাশয় এবং তাঁর অর্থমন্ত্রী নির্মলাদেবী আর্থিক প্যাকেজের ঢাক পিটিয়ে থাকেন। বিনামূল্যে সকলকে রেশন পৌঁছে দেওয়ার প্রচার চালান। কিন্তু সত্যিই কি এই পরিষেবা বা প্যাকেজ সাধারণের দরজা পর্যন্ত পৌঁছেছে? তাহলে ৩৩ লক্ষ ২৩ হাজার ৩২২টি শিশু অপুষ্টির কারণে আজ ধুঁকছে কেন? ১৭ লক্ষ ৭৬ হাজার ৯০২টি শিশুর মৃত্যুর আশঙ্কায় কেন ভুগছেন অভিভাবকরা? কেন তারা অপুষ্টির জন্য অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হচ্ছে... কো-মরবিড হয়ে পড়ছে? আর কেনই বা ১ লক্ষ ৫৩ হাজার ৫২ ভারতীয় ২০২০ সালে আত্মহত্যা করেছেন? এই রিপোর্টও কিন্তু সরকারি—এনসিআরবি’র। অর্থাৎ, এতে জল আছে বলে আপনারা হাঁকডাক করতে পারবেন না। গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো তথ্য কী জানেন? এই দেড় লক্ষ মানুষের মধ্যে ১১ হাজার ৭১৬ জন কোনও না কোন ব্যবসায় পেট চালাতেন। তাঁরা কেন আপনাদের প্যাকেজ পাননি?
জ্বালানির জ্বালা
সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্যে বহু বছর পর মোল্লা নাসিরুদ্দিনের একটা গল্প মনে পড়ে গেল। মোল্লা সাহেবের কাছে এসে একজন গ্রামবাসী বলেছিল, আর থাকা যাচ্ছে না। একটা ঘরে থাকি... এতজন লোক মিলে! জায়গার বড্ড অভাব। কী করা যায়? মোল্লা নাসিরুদ্দিন তাকে ওই ঘরেই দু’টো গোরু 
এনে রাখতে বলেছিলেন। তারপর দু’টো ছাগল, 
আর শেষে দু’টো মুরগি। মোল্লা বলছেন, কথা ফেলাও যায় না। আবার থাকাও যাচ্ছে না। শেষে আবার 
এসে সেই গ্রামবাসী কেঁদে পড়ল মোল্লার পায়ে। 
এবার মোল্লা সাহেব প্রথমে মুরগি দু’টো, তারপর ছাগল আর সবশেষে গোরু দু’টিকে বের করে 
দিতে বললেন। তিনদিন পর একগাল হাসি নিয়ে গ্রামবাসী হাজির। এবার ঘরে অনেক জায়গা। বেশ হাত-পা ছড়িয়ে থাকা যাচ্ছে। 
ঠিক এমনটাই ‘বিশ্বপ্রিয়’ মোদিজির সরকার করল আমাদের জন্য। প্রথমে তেলের দাম বাড়িয়ে নাভিশ্বাস তুলল। তারপর ১০টাকা-৫টাকা করে ছেঁটে দিল। প্রথমে কেন্দ্র, তারপর বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি। ভাবটা এমন, আমরা মানুষের জন্য কতই না ভাবি! সামনে সাত রাজ্যের ভোট আসছে। এমন একটু গ্যালারি শো না দিলে হয়!
দেশদ্রোহী
শ্যাম মীরা সিংকে চিনতে পারছেন মোদিজি? নাঃ, আপনি চিনবেন না। এ উত্তর-পূর্বের অচ্ছেদ্দা করা একটা রাজ্যের সাংবাদিক। তিনটি শব্দ লিখেছিলেন শ্যাম—‘ত্রিপুরা ইজ বার্নিং’। ত্রিপুরা জ্বলছে। তার জন্য এই সাংবাদিকের উপর ইউএপিএ’র ধারা চাপিয়েছে বিজেপি সরকার। এ রাষ্ট্রদ্রোহী। এডিটর্স গিল্ড বলেছে, নিজেদের ব্যর্থতা থেকে নজর ঘোরাতে সংঘর্ষ বাঁধানো হচ্ছে ওই রাজ্যে। যাঁরা সত্যিটা সামনে আনতে চাইছেন, তাঁদের গায়েই লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশদ্রোহীর স্টিকার। আর পুলিস বলছে, এ রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিব্যি ভালো আছে। সংঘর্ষ, আগুন বা ভাঙচুরের যে সব ছবি বাজারে ঘুরছে, সবক’টা ভুয়ো। সত্যিই কি তাই মোদিজি? আপনারা অবশ্য ভালো বলতে পারবেন। আপনাদের অনেক নেতা-মন্ত্রীই এর আগে শিলচর, এমনকী বাংলাদেশের হিংসার ছবি বা ভিডিও পশ্চিমবঙ্গের বলে চালিয়ে দিয়েছেন। প্রচার করেছেন শিঙা ফুঁকে। সত্যি-মিথ্যেটা বেআব্রু হয়ে যাওয়ার পর অবশ্য আপনাদের মধ্যে এতটুকু অনুশোচনা দেখা যায়নি! এটাই যে আপনাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার দস্তুর! 
আশা করি, এই তথ্য এবং ঘটনাবলি আগামী দিনে আপনাদের প্রচারে কাজে লাগবে। পারবেন তো এই পরিসংখ্যান মানুষের সামনে তুলে ধরতে? ১০০ কোটি ডোজ বা ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজের আড়ালে কত মৃত্যু, কত নিঃস্ব মানুষ রয়েছে, তার পরিসংখ্যানটাও দয়া করে প্রকাশ্যে আনবেন। মানুষ আপনাদের ভোট দিয়ে কুর্সিতে বসিয়েছে। আমাদের জন্য ভালো কিছু করলে, তা এমনিই দেখা যাবে। ফ্লাডলাইট জ্বালিয়ে তার প্রচার না করলেও চলবে। এখনও মানুষ ইন্দিরা গান্ধীর ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রীয়করণ কিংবা মনমোহন সিংয়ের ১০০ দিনের কাজ, খাদ্য সুরক্ষা, আরটিআইয়ের কথা বলে। আপনার কোন কাজের কথা জাহির করছে ভারত? দল কী প্রচার করছে, ছেড়ে দিন। কান পেতে শুনুন মানুষ কী বলছে... বহু অনাহার, মৃত্যু, কর্মহারার কান্না শুনতে পাবেন। আর শুনবেন শ্যাম সিংয়ের হুঁশিয়ারি—‘আমার দেশের প্রধানমন্ত্রী কাপুরুষ হতে পারেন, আমরা সাংবাদিকরা নই। আবার একই কথা বলব... ন্যায়ের জন্য লড়ব।’

9th     November,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ