বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

ক্ষুধার দেশে মোদিজিকে
ধন্যবাদ, শুভেচ্ছা...
হিমাংশু সিংহ

ক্ষুধার বিশ্বে ভারত সেঞ্চুরি পার করেছে। পেয়েছে ১০১তম স্থান। এজন্য অবশ্যই তাঁর বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য। গত সাত বছর ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু একচ্ছত্র অধিপতি যিনি সেই নরেন্দ্র মোদির। আরও শুভেচ্ছা এই কারণে যে জঙ্গি রাষ্ট্র পাকিস্তান এই তালিকায় ৯২তম স্থানে। আর প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও নেপাল যুগ্মভাবে ৭৬তম স্থানে। থাইল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কা রয়েছে যথাক্রমে ৫৩ ও ৬৫ নম্বর স্থানে। আর আমরা একশো দেশের পিছনে। এককথায় এটাই মোদি জমানার উন্নয়নের লেখচিত্র। গাল ভরা ঘুরে দাঁড়ানোর নির্মম খতিয়ান। কাজ নেই, ব্যবসা ছত্রখান, পেট্রল-ডিজেল প্রতিনিয়ত দামি হচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায় মানুষ নাজেহাল। ঘরে ঘরে তাই অনাহার তো বাড়বেই। স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রসঙ্ঘ, বিশ্বব্যাঙ্ক এবং ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল (এফএও) সংস্থার তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি ওই রিপোর্টকে সরকার মানেনি। স্বীকার করতে চায়নি বাস্তবটাকে। কিন্তু গদিতে বসে না মানলেই প্রকৃত বাস্তব মিথ্যা হয়ে যায় না। তাই দেশজুড়ে অশুভ শক্তির বিনাশের দশেরার মধ্যেই রীতিমতো শোরগোল পড়ে গিয়েছে।
সরকারের দাবি মতো, দেশ আত্মনির্ভর হচ্ছে। খুব ভালো কথা। কৃষিতে, বিজ্ঞানে, প্রতিরক্ষায় সমস্ত বিভাগে আমরা আগুয়ান। রেকর্ড ধান চাল উৎপাদনের সরকারি ফিরিস্তি ঢালাও করে কাগজে ও অন্যান্য গণমাধ্যমে বিস্তারিত ছাপাও হয় নিয়মিত। কিন্তু যেটা ছাপা হয় না, সরকার বাহাদুরের কৃপায় আজীবন অন্ধকারেই থেকে যায়, তা হচ্ছে এই রেকর্ড ফসল উৎপাদনের পরেও গরিবের ঘরে ক্ষুধা আর অনাহারের জ্বলন্ত উদাহরণ। তিনটে পাশ করেও মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলের কাজ না পাওয়ার কাহিনি। বিনা পয়সায় চাল গম দেওয়ার ঢালাও প্রচারের পরও অজ্ঞাত কারণে তা গরিবের উঠোনে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছয় না। প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা। পিএম কিষান স্কিম। সরকারি প্রকল্পের শেষ নেই। বরাদ্দ টাকাও অঢেল। হাজার হাজার কোটির আয়োজন। কিন্তু অফিসার, দালাল আর কামানেওয়ালা নেতার সৌজন্যে কোথায় যেন আসল উদ্দেশ্য হাওয়া হয়ে যায়। মধ্যিখানে নেপোয় মারে দই! কেন ও কীভাবে? এই রহস্যের পর্দা ফাঁস কোনও সরকারের আমলেই হয় না। এ আমলেও হবে না, এটাই ভারতীয় রাজনীতির চিরন্তন দস্তুর। ইদানীং আবার প্রশ্ন করতেই ভয় হয়, দেশবিরোধী কাজ আখ্যা দিয়ে পাকিস্তানি বলে না দেগে দেয় মোদি সরকার। প্রশাসন কালো দিকটা দেখায় না, আমরাও তাই বাধ্য দেশবাসীর মতো তা সচরাচর দেখতে পাই না। এভাবেই আসল সত্যিটা কখন হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। ওসব ছেড়ে নরেন্দ্র মোদি সরকারের মন্ত্রীসান্ত্রি কেষ্টবিষ্টুদের হরেক কিসিমের দাবি নিয়ে উদ্বাহু হই। চোখে পড়ে না গরিব শ্রমিক, কৃষক খেটে খাওয়া মানুষের ঘরের সঙ্কট, ক্ষুধা, অনাহারের ইতিবৃত্ত।
অথচ সরকার ঠান্ডা ঘরে বসে যাই দাবি করুন, প্রকৃত চিত্র কিন্তু আদৌ গরিবি-রেখা থেকে বেরিয়ে আসা মানুষের গৌরবময় উত্তরণের কথা বলছে না। গরিব আরও গরিব আর আমির আরও আমির হচ্ছে। সেই কারণেই সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র উঠে আসছে গোটা বিশ্বের ক্ষুধার সূচকের (গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স) সাম্প্রতিকতম রিপোর্টে। সেই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে আমাদের শ্রেষ্ঠ শারদ উৎসবের দিনগুলির মধ্যেই। কোনও ক্ষমতালোভী বিরোধী দল নয়, ঠোঁটকাটা সাংবাদিক নন, ওই রিপোর্ট প্রস্তুত করেছে বেশ কয়েকটি প্রথম সারির আন্তর্জাতিক সংস্থা মিলে। ওই সংস্থাগুলির মধ্যে রয়েছেন মার্কিন ও জার্মান বিশেষজ্ঞরাও। আর তা প্রকাশ করেছে একটি বিখ্যাত বিদেশি সংস্থা, কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড। চলতি একুশ সালে বিশ্বজোড়া ক্ষুধার সূচক বলছে, ভারতের অবস্থা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে অত্যন্ত শোচনীয়। দেশে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা কিছুতেই কমছে না। উল্টে অনাহার ও খাদ্যের হাহাকার বাড়ছে। এই গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সের বিচারে একবছর আগেও বিশ্বের ১১৬টি দেশের নিরিখে ভারতের স্থান ছিল ৯৪ নম্বরে। আর এই পুজোর মধ্যে কোভিড বিধি ভেঙে আমরা যখন আনন্দে আত্মহারা, তখন যে রিপোর্ট বেরিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে আমরা নামতে নামতে ১০১ নম্বর স্থানে! মাত্র একবছরে এতটা অবনমন কেন? শোচনীয়ভাবে পাশের পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, মায়ানমারের চেয়েও পিছিয়ে। আরও বড় বিস্ময়, পিছিয়ে ইথিওপিয়ার চেয়েও। আন্তর্জাতিক সংস্থার এই চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট নিঃসন্দেহে উৎসবের মধ্যেও প্রতিটি দেশবাসীর চোখ কপালে তোলার পক্ষে যথেষ্ট। 
এই অবনমনের ব্যর্থতা শুধু অনাহার আর ক্ষুধার সূচকেই সীমাবদ্ধ নেই। আছে যুদ্ধক্ষেত্রেও। ৫৬ ইঞ্চি ছাতির সেই দাপট যেন কোথায় স্তিমিত বিগত বেশ কিছুদিন ধরে। নাকি হিসেব তোলা থাকছে আগামী চব্বিশ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে ফের কোনও বিতর্কিত ধামাকার জন্য। আবার জাতীয়তাবাদ উস্কে একটা নাড়া দেওয়া বালাকোট অভিযান, ব্যস! চীন সেনা ঢোকাচ্ছে, ভিতরে ঢুকে নিঃশব্দে আস্ত ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে, লাদাখে লালফৌজ অস্ত্র বাড়াচ্ছে, যুদ্ধবিমান চক্কর কাটছে, আর আমরা রাফাল হাতে কেমন নির্বিকার। সংবাদমাধ্যমে প্রায় ছাপা হয় হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে অস্ত্রশস্ত্র কেনার ‘সাফল্য কাহিনি’। শত্রু নিকেশের নানা পরিকল্পনার কথা। শুধু রাফাল আনতেই খরচ ৬০ হাজার কোটি, যা ভারতের আকাশযুদ্ধে আরও শক্তিশালী হওয়ার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সন্দেহ নেই। আধুনিক হিংসায় উন্মত্ত বিশ্বে এই সমরসজ্জার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাও নির্বুদ্ধিতা। কিন্তু আসল সময়ে পাল্টা জবাব কই? রাফাল, এস ৪০০ মিসাইল সিস্টেম কি পরের ভোটের আগে দেশবাসীর আবেগকে নাটকীয়ভাবে নাড়া দিতে আচমকা সার্জিকাল স্ট্রাইকের জন্য আপাতত তোলা থাকবে! 
উৎসবের মধ্যেও সুদূর কাশ্মীরে যে একঝাঁক জওয়ান মারা গেল তাঁদের পরিবারের কথা সরকার, সাধারণ মানুষ কেউ আমরা ভেবেছি? ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পার হলেই আমরা সব ভুলতে শুরু করি। এই উৎসবের আবহেও পাকিস্তানের মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হাতে আবার নয় নয় করে সাতজন সেনা প্রাণ হারিয়েছেন গত এক সপ্তাহে। গত ১০ অক্টোবরই প্রাণ হারান পাঁচ জন সেনা। পুজোর মধ্যেই আরও দু’তিনজন। তাঁদের আত্মবলিদানের কথা আলোচনা করার চেয়ে নকল ‘বুর্জ খালিফা’ নিয়ে মেতে থাকাটাই চকমকি আলোর নীচে দাঁড়িয়ে আমাদের মতো সুখবিলাসী মধ্যবিত্তের অগ্রাধিকার। তাই ওঁরা, দেশের আসল নায়করা আপাতত ব্রাত্য। বদলে সিনেমার নকল হিরোদের নিয়ে মাতামাতিতে মগ্ন হই আমরা। একটা না চলা সিরিয়ালে মুখ দেখাতে পারলেও কেল্লা ফতে। এঁরাই নাকি আধুনিক যুগের চকচকে সেলিব্রিটি। যুবক যুবতীদের রোল মডেল! আর কার্গিল যুদ্ধের শহিদ বীর সেনার পরিবার অন্ধকারে দিন কাটায়। সেদিকে প্রচারের আলো পৌঁছয় না। এ দুঃখও অনাহারের চেয়ে কম কীসে? সেদিকে নজর না দিয়ে এই উৎসবের মধ্যেও বিএসএফ নিয়ে সরকার এক আশ্চর্য নির্দেশিকা জারি করেছে। এবং দ্রুত তার গেজেট নোটিফিকেশনও বেরিয়ে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ ও পাঞ্জাবে এখন থেকে সীমান্তের ভিতর ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত তল্লাশি অভিযান চালাতে পারবে সীমান্ত রক্ষীরা। নিঃসন্দেহে পশ্চিমবঙ্গ ও পাঞ্জাবের রাজ্য পুলিসের ক্ষমতা খর্ব করতেই এই ব্যবস্থা। এবং এর পিছনে ভোটসর্বস্ব রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ষোলোআনা কাজ করছে। পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার তার প্রতিবাদও করেছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয় হলেও তাতে কেন্দ্রের নাক গলানোর এই অতি সক্রিয়তা কমার কোনও লক্ষণ নেই। আর বিএসএফ সীমান্তটাই ঠিকমতো সামলাতে পারে না, তাদের হাতে বাড়তি এই বিরাট এলাকা পাহারা দেওয়ার ভার দিলে তার ফল কী হবে সহজেই অনুমান করা যায়!
আসলে উপর থেকে নীচ সব কিছুই রাজনৈতিক স্বার্থে চালিত হলে তার পরিণাম বিষময় হতে বাধ্য। হচ্ছেও তাই। কোভিড পর্বে বিনা পয়সায় গত প্রায় দু’বছর ধরে সরকার ঢালাও চাল-গম দিচ্ছে। মাঝে মাঝে এও প্রকাশিত হচ্ছে, ঠিক কত কোটি মানুষ সেই সুবিধা পেয়েছেন তার ঢালাও পরিসংখ্যান। সংখ্যাটা কোনও মাসেই ৮০ কোটির কম নয়। তবু দেশে অনাহার বাড়ছে কোন হিসেবে? তাহলে কি বিনা পয়সায় দেওয়া ওই চাল গম ডাল প্রকৃত গরিবের ঘরে পৌঁছচ্ছে না। মাঝপথে কোথাও গায়েব হয়ে যাচ্ছে। অবিলম্বে এর সর্বোচ্চ পর্যায়ের তদন্ত হওয়া উচিত। সরকার বাহাদুর মানুন আর নাই মানুন, বিদেশি সংস্থার রিপোর্ট চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে হাজারো ডিজিটাল ব্যবস্থা কার্যকর করার পরও সরকারি গণবণ্টন ব্যবস্থায় ঘুঘুর বাসা আগের মতোই রয়ে গিয়েছে। একটুও ভাঙা যায়নি। ফড়ে দালালরা আগের মতোই সমান সক্রিয়। যেমন নোট বাতিল করে কালো টাকাকে খতম করা যায়নি তেমনি এই নয়া ব্যবস্থাতেও সরকারি চাল-গম বণ্টনের আকাশপ্রমাণ দুর্নীতিও শেষ হয়নি! তাই কোষাগার থেকে যত টাকাই খরচ হোক না কেন গরিব মানুষ সেই তিমিরেই। মোদিজি আপনি এবারও পারলেন না।

17th     October,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ