বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

গণেশ জননী নবপত্রিকাবাসিনী দুর্গা
চৈতন্যময় নন্দ

মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত সপ্তশতী চণ্ডীতে দেবী দুর্গা শস্যদেবীরূপে যেন জগতে অবতীর্ণা এ বার্তা দৃপ্ত কণ্ঠে বিঘোষিত। সর্বজীবের প্রাণরক্ষার উপযোগী শাক-শস্যের দ্বারা তিনি পৃথিবীকে পালন করেন তাই মহাজননী শারদেশ্বরীর আর এক নাম শাকম্ভরী। 
চণ্ডীতে তাঁর নিজমুখে ঘোষণা, ‘হে দেবগণ, অনন্তর আমি আত্মদেহ সমুদ্ভূত প্রাণধারক শস্য সমূহের দ্বারা যতদিন না বৃষ্টি হয় ততদিন পর্যন্ত সমগ্র ত্রিভূবন পরিপালন করিব। এইজন্য আমি ‘শাকম্ভরী’ বলিয়া জগতে খ্যাতিলাভ করিব।’ শাকের অর্থ শস্য। রামায়ণে ও কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ আছে, ফলমূলাদি সহ শাকসমূহ ও শস্যাধিষ্ঠাত্রী রূপে দেবী দুর্গা পূজিতা হন। নবপত্রিকার অর্চনা সেই প্রেরণারই জীবন্ত প্রতিমা।
দেবীশক্তির মূল সার্থকতা কৃষি জীবনে শস্যলক্ষ্মীরূপে। কৃষিজ সম্পদের মধ্যেও দেখি মহাশক্তির অস্তিত্ব। ‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা’ এই কথা বলা হয়। মা দুর্গা যে শুধু সমস্ত নারীর মধ্যেই প্রকটিত তা নয়, সকল উদ্ভিদের মধ্যেও তাঁর অধিষ্ঠান। উদ্ভিদ জগতের মধ্যে মাতৃত্বের দর্শন সর্বদেশীয় ব্যাপকতার এক দার্শনিক নিদর্শন। শস্যলক্ষ্মীরূপে মা দুর্গার প্রতিনিধি ‘নবপত্রিকা’র মূল উত্তরণ। এই নবপত্রিকা আসলে দেবীর প্রতীক শস্যবধূর-ই পুজো। নব মানে নয় এবং পত্রিকার অর্থ পাতা আছে এমন কিছু বৃক্ষলতা। মঙ্গলদায়িনী জগন্মাতা দুর্গা এখানে নয়টি গাছগাছড়াকে আশ্রয় করে অধিষ্ঠিতা। নয়টি গাছের চারার সমষ্টিগত মূর্তি নবপত্রিকা ধরিত্রীর উর্বরা শক্তিকে বারবার জাগিয়ে দেয়। যেসব ভেষজদ্রব্য ব্যবহার করলে মানুষ সুস্থ থাকে এইসব বৃক্ষ-লতার মধ্যে তাও বিদ্যমান। এই নয়টি গাছের নাম হল— কলা, কচু, হলুদ, জয়ন্তী, ডালিম, অশোক, বেল, মান ও ধান। এই নয় রকম গাছের চারাকে একসঙ্গে অপরাজিতা লতা দিয়ে বেষ্টন করে নবপত্রিকা তৈরি করা হয়।
কদলী দাড়িমী ধান্যং হরিদ্রা মানকং কচুঃ।
বিল্বাশোকৌ জয়ন্তী চ বিজ্ঞেয়া নবপত্রিকা।
শারদীয়া পুজোর সপ্তমীর দিন দুর্গা প্রতিমার ডানদিকে নবপত্রিকাকে স্থাপন করার রীতি। এই নবপত্রিকাকে লাল পাড় শাড়ি পরিয়ে সিঁদুর লাগিয়ে ঘোমটা দিলে দেখায়, ঠিক যেন এক নতুন বউ। তাই এই নবপত্রিকার নাম ‘কলা বউ।’ সিদ্ধিদাতা গণেশের পাশে এঁকে রাখা হয় বলে অনেকে গণেশের বউ বলে বর্ণনা করে থাকেন। কেউ কেউ মনে করেন, বাস্তবে এ ধারণা একেবারে ভুল। ইনি গণেশ জননী নবপত্রিকাবাসিনী দুর্গা। নবদুর্গারূপে পূজিতা। মহাকবি কৃত্তিবাস রচিত রামায়ণে নবপত্রিকা পুজোর কথা পাই— ‘বাঁধিলা পত্রিকা নববৃক্ষের বিলাস।’
শস্যদেবীরূপে নবপত্রিকার আরাধনা সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা কৃষিভিত্তিক বঙ্গ জীবনের পরিচায়ক। কলা, কচু, ধান, মান, বেল, হলুদ আমাদের দৈনন্দিন কৃষিনির্ভর জীবনের সম্পদ ও আবশ্যকীয় উপকরণ। বাংলার কৃষক খেত-খামারে যা ফলায়, যা পায় সবকিছুর মধ্যেই সে মাতৃত্বের সৃজনী ও পালনী শক্তিকে দর্শন করে। তাই পরাশর স্মৃতিতে দেখি, ‘কৃষিধন্যা কৃষিন্মেধ্যা জন্তুনাং জীবনং কৃষিঃ’— কৃষি ধন্যা, কৃষি পূজ্যা, কৃষিই প্রাণীগণের জীবন বা জীবিকা স্বরূপ।
শাস্ত্রকারেরা বলেছেন, নবপত্রিকার প্রত্যেক গাছে একজন করে দেবীমূর্তি আছেন। কদলী বৃক্ষকে চিন্তা করা হয়েছে ব্রহ্মাণীরূপে, ডালিম গাছে রক্তদন্তিকা, ধানের দেবী লক্ষ্মী, হলুদে দুর্গা মানে চামুণ্ডা, কচুতে আছেন কালিকা, বেলে শিবা, অশোকের দেবী শোকরহিতা আর জয়ন্তী গাছে কার্তিকী। এই অধিষ্ঠাত্রী দেবীদের সমবেত নামই হল নবপত্রিকাবাসিনী দুর্গা।
অনেকের মতে, বিশ্বাত্মিকা ভগবতী দুর্গা শস্যদায়িনী রূপেই প্রকট। নবপত্রিকার পুজো সে ভাবেরই সঙ্কেত দান করে। সুকুমার সেন তাঁর ‘পূজার পাঁচালি’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘আমাদের বাংলাদেশ বা পাশের রাজ্যগুলি চিরকালই ধান্যোপজীবী। আজ থেকে হাজার-দেড় হাজার বছর আগে এদেশে ফসলের দেবী যিনি ছিলেন, তিনিই আমাদের আসল দুর্গাদেবী। এই ধান্যমাতা দেবীর আসল নাম ছিল শারদা। এই দেবীর পূজাই হল শারদীয়া পূজা। এ পূজা শরৎকালে হতো। শারদাদেবী বৈদিক আমলে পরিচিত ছিলেন ‘উষা’ নামে। দেবীর পূজা হতো উষাকালে। দীর্ঘকাল পরে দেবী উষা মার্কণ্ডেয় পুরাণের মহাদেবীতে পরিণত হলেন। এবং পরবর্তীকালে মহিষমর্দিনীর সঙ্গে এক হয়ে যান। সেই সময় থেকে মহিষমর্দিনী মূর্তিটি পূজার প্রতিমারূপে গৃহীত হয়।’
ভারতের নদনদী, সাগর, সরোবরের জলে অনুষ্ঠিত হয় নবপত্রিকার অভিষেক। পতিতার গৃহের মৃত্তিকা সহ বিভিন্ন স্থানের মাটি, পথ্যশস্য,পঞ্চরত্ন ইত্যাদি নানাবিধ সুগন্ধী তৈলদ্রব্য কলাবউ-এর স্নানে অর্পিত হয়। সেইসঙ্গে লাগে পঁচাত্তর প্রকারের উপকরণ। ‘ওঁ আত্রেয়ী ভারতী গঙ্গা। 
যমুনা চ সরস্বতী’ ইত্যাদি মন্ত্রে সকল নদী ও সাগরের জলে যখন নবপত্রিকা স্নান শুরু হয়, তখন আমাদের স্মরণ করায় অখণ্ড ভারতের মানচিত্রটিকে। এ যেন গোটা ভারতের এক মিলন বন্ধন। এই পবিত্র স্নানের মধ্য দিয়ে জাতির সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় চিন্তার সুমহৎ তত্ত্বটি অতি পরিষ্কার ভাবে ফুটে উঠেছে।
নবপত্রিকার মহাস্নানকালে বিভিন্ন রাগ রাগিণীতে গীত ও বাদ্য বাজানোর বিধি মন্ত্রে দৃষ্ট হয়। যেমন: মালব রাগে বিজয় বাদ্য, ললিত রাগে বেদবাদ্য, বিভাস রাগে দুন্দুভি বাদ্য, ভৈরব রাগে ভীমবাদ্য, কেদার রাগে ইন্দ্রাভিষেক বাদ্য, বারারি রাগে শঙ্খবাদ্য, বসন্ত রাগে পঞ্চশব্দ বাদ্য ও ধানসি রাগে ভৈরব বাদ্য।
এক একটি উদ্ভিদকে এক এক রকম মন্ত্রে  এক এক রকম জলে স্নান করিয়ে তারপর পুজো করার নির্দেশ দিয়েছেন শাস্ত্রকাররা। যেসব পবিত্র মন্ত্রে কলাবউকে অর্চনা করতে হয় তার প্রতিটি মন্ত্র অতি সজীব ও প্রাণস্পর্শী। ঈষৎ উষ্ণজলে কলাগাছকে স্নান করিয়ে বলা হয়— হে চণ্ডিনায়িকা নবপত্রিকে! তুমি কদলীবৃক্ষে অধিষ্ঠান করে আছ। কিন্তু মূলে হচ্ছে তুমি বিষ্ণুবক্ষবিলাসিনী। বিষ্ণুর বক্ষে যে পালনী শক্তি, সেই শক্তি আছে এই কদলী বৃক্ষে। হে দেবি দুর্গা! তুমি পূজার সমীপস্থ হও। কদলী রূপে সর্বত্র শান্তি বিধান কর। ‘রম্ভা রূপেণ সর্বত্র শান্তিং কুরু নমোহস্তুতে।’ হলুদ গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী দুর্গাকে শিশির জলে স্নান করিয়ে এই মন্ত্রে অর্চনা করতে হয়— হে হরিদ্রে! তুমি শঙ্কর প্রিয়ে। শিবের মতো তোমার রূপ। তুমি রুদ্ররূপে আমায় সর্বসিদ্ধি প্রদান কর। ‘সর্বসিদ্ধিং প্রযচ্ছ মে।’ ধানের অধিষ্ঠাত্রী মা লক্ষ্মীর চরণে প্রণতি জানিয়ে বলি, ধান্যরূপা হে দেবী! জগতের মঙ্গলের জন্য ব্রহ্মা তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। তুমি জগতের প্রাণদায়িনী। তুমি দেবী উমার প্রীতিদায়িকা। স্থিরা হয়ে তুমি আমাদের গৃহে কামপ্রদা হয়ে সর্বদা রক্ষা কর। ‘রক্ষ মাংসদা।’

লেখক প্রাবন্ধিক ও গ্রন্থপ্রণেতা

12th     October,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ