বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

১৮ লক্ষ প্রদীপ এবং কিছু বাস্তব
শান্তনু দত্তগুপ্ত

আমাদের প্রধানমন্ত্রী কি আরাধনা কশ্যপের নাম শুনেছেন? না শোনারই কথা। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তাঁর ৯৮ কোটি ভোটারের প্রত্যেকের নাম জানার বা শোনার কথা নয়। এমনকী আরাধনা কশ্যপের যে ১১ বছরের একটি মেয়ে আর আড়াই বছর বয়সের একটি ছেলে রয়েছে, সেটাও জানেন না মোদিজি। এই তথ্য তাঁর ভোটের কাজে লাগবে না। প্রচারের কাজেও না। বরং উত্তরপ্রদেশে কত লোক আজ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় বাড়ি পেয়েছে, সেই পরিসংখ্যানটা তাঁর কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সংখ্যাটা যে কম না... ৯ লক্ষ! কতদিনে এই বাড়ি হয়েছে? আগের সরকারের ভূমিকা কী? এইসব প্রশ্ন অবান্তর। উড়ালপুল কার জমানায় তৈরি হয়েছিল, তাতে মোদি বা যোগী সরকারের কিছুই আসে যায় না। উদ্বোধন তিনি করছেন। এটাই সাফ কথা। তার মানে, ৯ লক্ষ মানুষকে তিনি ‘লাখপতি’ করেছেন। ৯ লক্ষ মানুষকে তিনিই থাকার জায়গা দিয়েছেন। ফলে এই সব মানুষের তো পাল্টা কিছু কর্তব্য থাকে নাকি? আছে তো! দীপাবলিতে এঁদের প্রত্যেককে দু’টি করে প্রদীপ জ্বালাতে হবে। অর্থাৎ ১৮ লক্ষ প্রদীপ জ্বলবে উত্তরপ্রদেশে। তাতেই নাকি সন্তুষ্ট হবেন শ্রীরাম। মোদিজি না বলিয়াও যে কথাটি বলে ফেললেন... বাড়ি বানিয়ে দিয়েছি, এবার ভোটটাও আমাকেই কিন্তু দিতে হবে। লখনউয়ের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলে গেলাম... বিজেপি সরকার তোমাদের অনুগ্রহ করেছে। তার প্রতিদান চাই। ১৮ লক্ষ ‘দিয়া’ এবং আবডালের দাবি, পরিবারের সকলের ভোট। 
আরাধনা কশ্যপও এই তালিকাতেই পড়েন। তিনিও উত্তরপ্রদেশের ভোটার। কিন্তু পরিবার বলে তাঁর আজ আর কিছু নেই। স্বামী রামন কাশ্যপ পেশায় ছিলেন সাংবাদিক। তিকুনিয়ায় গিয়েছিলেন খবর করতে। একটি গাড়ি তাঁর স্বামীকে পিষে দিয়ে চলে গিয়েছে। হাসপাতাল পর্যন্তও প্রাণটুকু ছিল না তাঁর। ঠিক যেভাবে ওইদিন প্রাণটা চলে গিয়েছিল লভপ্রীত সিংয়ের। কত বয়স ছিল তাঁর? মাত্র ২০ বছর! কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্রর নামে নথিভুক্ত গাড়ি, চালকের আসনে ছেলে আশিস মিশ্র... তাঁরাই তো সরকার! গাড়ি থামবে না। সামনে যে আসবে, তাকেই পিষে দিয়ে এগিয়ে চলবে বিজেপি সরকারের ডবল ইঞ্জিন বিজয় রথ। চাকায় জড়িয়ে যাচ্ছে শরীর। তাও কমছে না গতি। আর নরেন্দ্র মোদি? ঘটনাস্থল থেকে ঠিক ১২৯ কিমি দূরে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন তিনি। ৩৫ মিনিটের বক্তৃতা। তাতে একটা শব্দও নেই লখিমপুর নিয়ে... রামন কশ্যপকে নিয়ে... লভপ্রীতকে নিয়ে। তিনি ব্যস্ত ১৮ লক্ষ দিয়া জ্বালানোর টোটকা দিতে। ঠিক যেভাবে করোনা তাড়াতে থালা বাজানো, হাততালি দেওয়া... এমন অনেক কারবার প্রেসক্রিপশনে লিখেছিলেন তিনি। 
এতে রামচন্দ্র খুশি হবেন কি? জানা নেই। তবে এই সুযোগে মোদিজির প্রাক-ভোট প্রচারটা ভালোই সেরে নেওয়া গেল। একেবারে সরকারি কায়দায়। সরকার আর দল যে পৃথক দুই সত্তা, সে ব্যাপারে আমাদের হর্তাকর্তাবিধাতা কেয়ার করেন না। দরকার কী? ওই যে অমিতাভ বচ্চনের একটা ডায়লগ ছিল না... ‘হাম যাঁহা পে খড়ে হোতে হ্যায়, লাইন ওয়হিঁ সে শুরু হোতা হ্যায়’। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ওই আদর্শে বিশ্বাসী। তিনি যা করবেন, সেটাই স্টাইল। সেটাই নিয়ম। বাকিদের জন্য অবশ্য এসব প্রযোজ্য নয়। তখন তাঁর দলের খোল-করতাল বাজানেওয়ালারা হাঁ হাঁ করে উঠবে, চেঁচামেচি জুড়ে দেবে। প্রধানমন্ত্রীর ব্যাপারটাই আলাদা। তিনি শ্রীরামকে খুশি করার উপায় জানেন। আপনারা জানেন? মোটেও না। তা‌ই তাঁকে তো গুরুত্ব দিতেই হবে! পুরাণে আছে, সূর্যের দক্ষিণায়ন শুরু হলে দেবতাদের রাত। তখন তাঁরা নিদ্রা গিয়ে থাকেন। তাই যখন-তখন তাঁদের ডাকা যায় না। রাবণবধের জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মা পর্যন্ত মহামায়াকে স্মরণ করে রামচন্দ্রের জন্য অনুমতি নিয়েছিলেন। বসন্তকালের জন্য অপেক্ষা নয়, অকালেই বোধন হয়েছিল মা দুর্গার। বিষ্ণুর অবতার হওয়া সত্ত্বেও জাগ্রত করতে হয়েছিল মাকে। নিজ হাতে নবপত্রিকা বেঁধেছিলেন রামচন্দ্র। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, রাবণবধ। মহাবীর রাবণ মহাদেবের আশীর্বাদে সুরাসুরের অবধ্য ছিলেন। তাই ব্রহ্মার বিধান ছিল, রামচন্দ্রের হাতে বিনাশ হবে রাবণের। তারপরও কিন্তু অঙ্ক অতটাও সহজ ছিল না। কারণ, লঙ্কাধিপতি ছিলেন মহামায়ার ভক্ত। রামসেনার দাপটে রাজপাট খোয়ানোর আশঙ্কা দেখা দিতেই মায়ের শরণে স্থান নিয়েছিলেন রাবণ। কালীরূপে মা তাঁকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। তাই বাধ্য হয়ে অকাল বোধন। স্বয়ং রামচন্দ্র ছাড় পাননি। অথচ, মোদিজি কি না ভোটের প্রয়োজন হলেই দেবদেবীদের ডেকে তোলেন। তিনি হয়তো তেমনই মহাপুরুষ। আমরাই চিনতে পারছি না। আমাদের এ ব্যর্থতা... অপরাধ। মোদিজি নিজেই বলেন, ‘কিছু লোক আছে, যারা শুধু আমার সমালোচনা করে সময় নষ্ট করে।’ আমাদের প্রধানমন্ত্রী শুধুই শোনেন। তিনি নাকি বলেন না। কাজে উত্তর দেন। এও এক ভয়ানক কথা। মোদিজি না বললে আমরা তো বোবা! হ্যাঁ, একটা বিষয় নিশ্চিত... মোদিজি যুক্তিসঙ্গত, বাস্তবধর্মী কথা কম বলেন। যে কথাগুলো মানুষের কষ্ট, দারিদ্র লাঘব করতে পারে... তেমন কিছু তাঁর মুখে শোনা যায় না। মোদিজি তার বদলে শ্রীশ্রী রামচন্দ্রের সন্তুষ্টির উপায় খোঁজেন। দেবদেবীরা প্রতিবাদ করবেন না... সমালোচনাও করবেন না। 
হিন্দুত্ব যে বিজেপির রাজনৈতিক অন্ন! এ ছাড়া গতি কী! তাই শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে দেবী কাত্যায়নীকে ‘মেনশন’ করে টুইট লেখেন মোদিজি। বলেন, ‘মায়ের আশীর্বাদ ঝরে পড়ুক আমাদের উপর। সমাজ গড়ে উঠুক সৌভ্রাতৃত্ববোধ এবং স্নেহের ছায়ায়।’ ব্রহ্মা দেখেছিলেন, গভীর অরণ্যের শেষে বছর দশেকের এক বালিকাকে। সে খেলা করছে বেলগাছের নীচে। ব্রহ্মাদেব বুঝেছিলেন, ওই বালিকাই মহামায়া। ওখানেই হবে অকাল বোধনের পুজো। পুরাণ আমাদের দেখিয়েছে, নানা রূপে মা এসেছেন... কখনও তিনি চণ্ডী, কখনও দুর্গা, কখনও কেবল এক বছর দশেকের বালিকা। শাস্ত্র আমাদের শিখিয়েছে, মানুষের মধ্যেই আছেন ঈশ্বর। স্বামী বিবেকানন্দ বলে গিয়েছেন... ‘জীবে প্রেম করে যেই জন...’। মোদিজি, হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী আরাধনা কশ্যপের ওই বছর এগারোর সন্তানের মধ্যেও যে মা লুকিয়ে আছেন! তার সঙ্গে কী ন্যায়বিচার করল আপনার সরকার? ২০ বছরের লভপ্রীত সিংয়ের মাও তো দেবীরই কোনও এক রূপ! ছেলের মৃতদেহ দেখার পর বারেবারে সংজ্ঞা হারাচ্ছেন তিনি। উত্তরপ্রদেশে ১৮ লক্ষ দিয়া জ্বালিয়ে এই অবিচারের অন্ধকার দূর হবে কি? কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে, আপনার তরফ থেকে একটাও বিবৃতি জারি হয়নি। এখনও না। কেন? ওই মানুষগুলো কি এতটুকুরও যোগ্য নয়? করুণা তারা চায়নি। টাকাও নয়। তারা চেয়েছিল বিচার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী অজয় মিশ্র... এই মর্মান্তিক ঘটনার পরও তিনি বহাল তবিয়তে স্বপদে! সুপ্রিম কোর্টের গুঁতোয় শেষমেশ গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাঁর সোনার টুকরো ছেলেকে। তারপর? সময় বলবে। বিজেপি নেতাদের ভাবটা এমন... কি এবার খুশি তো? না মশাই, তাঁরা খুশি নন। কারণ, ওই পরিবারগুলো কেউ হারিয়েছে স্বামীকে, কেউ সন্তানকে, কেউ পিতাকে। গণতন্ত্রের নতুন সংজ্ঞা শিখিয়েছে লখিমপুর। নতুন উদাহরণ দিয়েছেন মোদি... লখনউয়ের মঞ্চ থেকে। আমি ভোটারদের জন্য কী কী দয়া করলাম... এটাই মোদ্দা কথা। কয়েকটা প্রাণ গাড়ির চাকার তলায় যেতেই পারে। ওটা অ্যাক্সিডেন্ট। প্রদীপ কিন্তু জ্বালাতে হবে! ওটা নির্দেশ। কারণ, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। দলের, প্রশাসনের পেটোয়ারা ঘুরবে বাড়ি বাড়ি... চলবে তদারকি... দিয়া জ্বলছে তো? প্রধানমন্ত্রী বলেছেন... এটাই ফতোয়া।
আজ সপ্তমী। বৃহদ্ধর্মপুরাণ মতে এই তিথিতেই রামচন্দ্রের ধনুর্বাণে প্রবেশ করেছিলেন দেবী চণ্ডিকা। অষ্টমী-নবমীতে মহাযুদ্ধ হয়েছিল রাম-রাবণের। দশমীতে রামচন্দ্র করেছিলেন বিজয়োৎসব। রাবণবধের। মহাবীর ছিলেন রাবণ। কিন্তু তাঁর স্বৈরাচার কোনও বাধা মানেনি। আঘাত হেনেছিল বনবাসী রামচন্দ্রের সম্মানে। বাল্মিকী রামায়ণে রামচন্দ্র একজন রাজ্যচ্যুত সাধারণ মানুষ। স্বর্ণলঙ্কার অধিপতি, মহাদেবের আশীর্বাদধন্য হয়েও রাবণ পরাভূত হয়েছিলেন তাঁর হাতে। কারণ তিনি ভেবেছিলেন, আমি যা করব, সেটাই নিয়ম। আমাকে বধ করার ক্ষমতা কারও নেই। ইতিহাস পুনরাবৃত্তি ঘটায়। নতুন আঙ্গিকে ফিরে ফিরে আসে পুরাণের শিক্ষাও। স্বৈরাচার পতনের মূল... তা সে রাবণ হোক, বা হিটলার। 
অমিত শাহ অবশ্য বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচারী নন। বরং তাঁর মতো গণতান্ত্রিক নেতা ভারত পায়নি। হয়তো তাই। আমরাই বুঝতে পারছি না। তবে দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের জন্য একটা কথা না বলে পারছি না। জটায়ুর একটা উপদেশ। বৃদ্ধ জটায়ুকে হত্যা করেছিলেন রাবণ। মৃত্যুমুখে সেই পক্ষীসম্রাট বলেছিলেন, ‘সেই ভারই বহনীয়, যা অবসন্ন করে না।’ এই উপদেশ ভারতবাসীর জন্যও এখন লাগসই হতে পারে। কেন জানেন? কারণ, দায় যে আমাদের! এমন ভার আমরা মাথায় তুলেছি, যা আর বহনযোগ্য নয়। হয় এই ভার নামাতে হবে... না হলে পিষে যেতে হবে। ঠিক লখিমপুরের মতো। আবার ভাইকে হারাবেন পবন, সন্তানসম ভাইপোকে হারাবেন কেবল সিং... স্বামীহারা হবেন আরাধনা। 
তাঁরাও যে বিজয়ার অপেক্ষায়! 

12th     October,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ