বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

কার আইন, কার আদেশ?
পি চিদম্বরম

শব্দগুলি জোরে এবং স্পষ্ট, উচ্চাঙ্গে, প্রায় নাটকীয়ভাবে বেজে ওঠে, ‘আমরা, ভারতের জনগণ ... নিজেদেরকে এই সংবিধান দিয়েছি।’ এবং স্বাধীনতা, সৌভ্রাতৃত্ব এবং অন্যান্য উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে সবাইকে সুরক্ষিত করার জন্য আমরা আমাদেরকে এই সংবিধান দিয়েছি।
ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ প্রত্যেক অফিসার, মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর জন্য বাধ্যতামূলক করা আবশ্যক। প্রত্যেকেই সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়েছেন। তাঁদের প্রত্যেকের প্রথম বাধ্যবাধকতা হতে হবে নাগরিকদের স্বাধীনতা সুরক্ষিত রাখা এবং সৌভ্রাতৃত্বের প্রচার করা। তাঁদের তরফে এটা করার জন্য আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে একটি সংসদ এবং রাজ্যে রাজ্যে বিধানসভা তৈরি করেছি। আমরা রাজ্য বিধানসভাকে ‘পাবলিক অর্ডার’ এবং ‘পুলিস’ আইন প্রণয়নের দায়িত্ব দিয়েছি। অন্যদিকে, সংসদ ও বিধানসভা উভয়কেই দিয়েছি ফৌজদারি আইন, ফৌজদারি কার্যবিধি এবং প্রতিরোধমূলক আটক (প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন) সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের দায়িত্ব। 
জনগণের আদেশ 
আইনের বাস্তব প্রয়োগের জন্য আমরা এগজিকিউটিভ বা একটি কার্যনির্বাহী তৈরি করেছি। আমরা এগজিকিউটিভের উপর একটা চেক  বা নজরদারি রাখি নাগরিকদের মৌলিক অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে। এগজিকিউটিভদের সতর্ক করে থাকি এই বলে যে, ‘কোনও ব্যক্তি তাঁর জীবন এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হবেন না, আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি ব্যতীত।’
আমরা কার্যনির্বাহীকে নির্দেশ দিয়েছিলাম যে, ‘গ্রেপ্তার হওয়া কাউকেই তাঁকে না জানিয়ে হেফাজতে আটক করে রাখা যাবে না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই ধরনের গ্রেপ্তারের কারণ তাঁকে অবহিত করতে হবে, তাঁর আইনি পরামর্শ গ্রহণের অধিকার নস্যাৎ করা যাবে না, আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তাঁকে তাঁর পছন্দের একজন আইনজীবীর সাহায্য গ্রহণের সুযোগও দিতে হবে। ’
আমরা কার্যনির্বাহীকে আরও নির্দেশ দিয়েছিলাম যে এটা পর্যবেক্ষণ করুন ‘গ্রেপ্তার হওয়া এবং হেফাজতে আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে এইভাবে ধরার ২৪ ঘণ্টার ভিতরে নিকটতম কোনও বিচারকের সামনে হাজির করা হবে ... এবং একজন বিচারকের আদেশ ছাড়া এই ধরনের কাউকেই ওই নির্ধারিত সময়ের পর হেফাজতে আটকে রাখা চলবে না।’ 
উপদেশগুলি ছিল রবার্ট বার্নসের ‘ইঁদুর এবং মানুষের সেরা প্রতিষ্ঠিত পরিকল্পনা’-র মতো। আমাদের দোষ ছিল আমরা উত্তরপ্রদেশ রাজ্যকে আমলে নিইনি!
প্রথমে ট্র্যাজেডি, তারপর কমেডি
লখিমপুর খেরির মর্মান্তিক ঘটনায় আটজনের মৃত্যু হয়েছে। চারজন কৃষক একটা এসইউভি গাড়িতে চাপা পড়েছিলেন এবং অন্য চারজনের মৃত্যু হয়েছিল ওই কৃষকদের মৃত্যুর পর সংঘটিত হানাহানিতে। রাজনৈতিক নেতারা সংশ্লিষ্ট গ্রামে যাবেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকজনের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। এই সম্পূর্ণ অধিকার তাঁদের আছে, ‘লিবার্টি’ কথাটি থেকে আমরা এটাই বুঝি। শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানোতে সৌভ্রাতৃত্ব গুরুত্ব পেয়ে থাকে। 
কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ওয়াধেরা লখিমপুর খেরিতে যাওয়ার সময় তাঁকে সীতাপুরের কাছে আটকে দেওয়া হয়েছিল। নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত কিছু তথ্য বিতর্কিত নয়: সময়টা ছিল ৪ অক্টোবর সোমবার ভোর সাড়ে ৪টে। প্রিয়াঙ্কাকে জানানো হয়েছিল যে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫১ ধারা মতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। পুরুষ পুলিসকর্তারা ধাক্কা মেরে তাঁকে পুলিসের গাড়িতে তোলেন। ৬ অক্টোবর, বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁকে পিএসি গেস্ট হাউসে আটক রাখা হয়েছিল। আটকে রাখার এই ৬০ ঘণ্টার ভিতরে—
> গ্রেপ্তারের কারণ কী, মিসেস ওয়াধেরাকে সেটা জানানো হয়নি;
> তাঁকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেওয়া হয়নি এবং তাতে তাঁর স্বাক্ষরও নেওয়া হয়নি; 
> তাঁকে বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয়নি;
> তাঁকে এফআইআরের কপি দেওয়া হয়নি, যদি তা হয়ে থাকে; 
> তাঁকে তাঁর আইনি পরামর্শদাতার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি, যিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁরই জন্য গেটে অপেক্ষায় ছিলেন; এবং
> ৫ অক্টোবর মঙ্গলবার তাঁকে বলা হয়েছিল যে তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫১ ধারা এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ১০৭ ও ১১৬ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
আইনের ঠিক কতগুলো বিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে সে গুনে বলা মুশকিল! আপনার যদি ইনটেলেকেচুয়াল কিউরিওসিটি থাকে তবে অনুগ্রহ করে সংবিধান, ফৌজদারি কার্যবিধি (সিআরপিসি) এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির (আইপিসি) অনুলিপিগুলি সংগ্রহ করুন। এরপর চোখ বুলিয়ে নিন অনুচ্ছেদ ১৯, ২১ এবং ২২; ধারা ৪১বি, ৪১ডি, ৪৬, ৫০, ৫০এ, ৫৬, ৫৭, ৬০এ, ১৫১, বিশেষ করে ফৌজাদারি কার্যবিধির উপধারা (২) ও ১৬৭; এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ১০৭ ও ১১৬ ধারার উপর। 
অজ্ঞতা নাকি দায়মুক্তি?
আমার মনে হয়, উত্তরপ্রদেশে, যেখানকার মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, সেখানে আইনশৃঙ্খলার ধারণার ভিন্ন কোনও অর্থ রয়েছে। সেখানে আইন একটা আছে বটে, তবে তা যোগী আদিত্যনাথের আইন, ভারতীয় আইন নয়। অর্ডার বা আদেশ 
আছে, প্রকৃতপক্ষে অনেক আদেশ, সেগুলিও 
যোগী আদিত্যনাথের আদেশ, বৈধ আদেশ কিছু 
নয়। উত্তরপ্রদেশের পুলিস যে ‘ল অ্যান্ড অর্ডার’ 
বা আইনশৃঙ্খলা মেনটেন করে সেটাও যোগী আদিত্যনাথের ল এবং যোগী আদিত্যনাথের 
অর্ডার।
আসুন, উত্তরপ্রদেশ পুলিসের প্রজ্ঞার শেষ মুক্তাটি, মানে অভিযোগগুলি একবার দেখি। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫১ ধারায় কোনও ‘অপরাধ’ অন্তর্ভুক্ত নয়, সুতরাং ওই ধারায় কাউকে ‘অভিযুক্ত’ করা 
যাবে না।
ভারতীয় দণ্ডবিধির ১০৭ এবং ১১৬ ধারা দুটি হল প্ররোচনা সম্পর্কিত। এগুলো একক চার্জ বা অভিযোগ হতে পারে না। প্ররোচনার অভিযোগটি কেবল তখনই অর্থবহ হয় যখন প্ররোচিত ব্যক্তির নাম এবং সেই প্ররোচনায় যে অপরাধটি সংঘটিত হয়েছিল পুলিস তা জানায়। পুলিসের কেউই এই গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটিটা লক্ষ্য করেছেন বলে মনে হয় না। যে চার্জটা আনা হয়েছে তা স্রেফ হাস্যকর!
এর একমাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে যে, উত্তরপ্রদেশ পুলিস সংবিধান বা আইন জানে না (যার অর্থ, এটা তাদের অজ্ঞতা), অথবা উত্তরপ্রদেশ পুলিস সংবিধান ও আইনের পরোয়া করে না (যার অর্থ, দায় থেকে মুক্তি পাওয়া)। উভয় ব্যাখ্যাই উত্তরপ্রদেশ পুলিসকে কলুষিত করে, যে পুলিসের ডিরেক্টর জেনারেল পদমর্যাদার কয়েকজন অফিসার (ডিজিপি) রয়েছেন। অথচ উচ্চপদস্থ পুলিস অফিসার থেকে শুরু করে বিনম্র কনস্টেবল পর্যন্ত, সকলেরই সুনাম-সুখ্যাতি প্রাপ্য। সাড়ে ২৩ কোটি জনসংখ্যার রাজ্য উত্তরপ্রদেশের জন্য একটি ভালো পুলিস বাহিনী জরুরি, এই প্রয়োজনটা অন্য যেকোনও কিছুর 
চেয়ে বেশি।
স্বাধীনতা একটা সুনামিতে ভেসে যায় না। অনবরত ধেয়ে আসা তরঙ্গের আঘাতেই এটি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। উম্ভা (সোনভদ্র), উন্নাও-১, শাহজাহানপুর, উন্নাও-২, এনআরসি/সিএএ, হাতরাস এবং এখন লখিমপুর খেরি— ঢেউগুলো আপনি দেখতে পাচ্ছেন কি?
 লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত

11th     October,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ