বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

সিপিএমের রাজনৈতিক
ভবিষ্যৎ কী হতে চলেছে?
সমৃদ্ধ দত্ত

রেডিওর বাংলা নাটক, ওয়েসিস মনের মতো গান মনে রাখা কথা, বোরোলিনের সংসার, দূরদর্শনের চিত্রহার, চিত্রমালা, অ্যাম্বাসাডর গাড়ি, ক্রিক রো অথবা টালা পার্কের সারারাতের জলসা, পুজোর সময় নতুন গান, ছোট ছোট বিজয়া সম্মিলনী, রবীন্দ্রজয়ন্তীতে পাড়ায় পাড়ায় শ্যামা শাপমোচন, চিত্রাঙ্গদা অথবা ছোটদের মুখে ‘ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছো’ আবৃত্তি। টাইপরাইটারে অ্যাপ্লিকেশন পাঠানো, লেটার বক্সে ইনল্যান্ড লেটার অথবা পোস্টকার্ড পেয়ে অজানা দূরাগত সংবাদের আগ্রহে হৃদয়ে তরঙ্গ ওঠা। অনুপ জালোটার ‘অ্যায়সি লাগি লগন’ ভজনের ডাবল ক্যাসেট সাংঘাতিক হিট হওয়া, মোহন বাগান, ইস্ট বেঙ্গল, মহামেডানে সিংহভাগ বাঙালি স্টার ফুটবলারের স্বর্ণচ্ছটাময় দিন। বাঙালির এই তাবৎ নস্টালজিয়ায় নবতম সংযোজন হতে চলেছে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্কসবাদী)। সংক্ষেপে বাঙালির মুখে মুখে বিখ্যাত টার্ম, সিপিএম। 
আমরা আগেই বুঝতে পারছিলাম, এভাবে ক্রমাগত লোকসান করতে থাকলে এবং নতুন আধুনিক যুগের আগ্রাসী উৎপাদন স্ট্র্যাটেজির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারা প্লাস পরিচালকবৃন্দের উদাসীনতার কারণে বার্ন, ব্রেথওয়েট, জেশপ কিংবা ডানলপের মতো ব্র্যান্ডেড কোম্পানিগুলি ধীরে ধীরে মুছে যাবে। ঠিক তাই হয়েছিল। বাঙালির কাছে একসময় ভালো চাকরি মানেই এইসব কোম্পানিকে বোঝাত। পাত্র হিসেবে এইসব কোম্পানির কর্মী অফিসারদের কদর ছিল বিয়ের বাজারে। কিন্তু সেগুলি ক্রমেই বাঙালি মন থেকে অন্তর্হিত হয়ে গেল। দমদম অথবা হাওড়ায় গেলে ওইসব জমির দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে এখানে একসময় কত গমগম করত! ব্যস! ওইটুকুই।
আমরা আন্দাজ করছিলাম, যেভাবে বিদেশি আধুনিক সংস্থার গাড়ি যৌথ ভেঞ্চার করে ঢুকে পড়ছে ভারতের বাজারে এবং দেশীয় সংস্থা মারুতিও জাপানের সুজুকি কোম্পানির সঙ্গে বাণিজ্য আঁতাত করে নিজেদের উন্নীত করে আরও মোহময় এবং আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে, এদের সঙ্গে লড়াই করতে পারবে না আমাদের প্রিয়তম অ্যাম্বাসাডর। ঠিক তাই হল। কারণ, অ্যাম্বাসাডর নিজেদের বদলাতে পারলো না। আধুনিকতা এল না। তাই সে ধীরে ধীরে মানুষের আলোচনা, কৌতূহল অথবা ভিস্যুয়ালাইজেশনের অভিঘাত থেকে হারিয়ে গেল। আজ বাঙালি মধ্যবয়সিরা মাঝে মাঝে ঘরোয়া পারিবারিক আড্ডায় বলে থাকেন, রাঙা মেসোর একটা অ্যাম্বাসাডর ছিল মনে আছে? সেই যে প্রতি বছর আমাদের সব ভাইবোনকে নিয়ে জেমিনী সার্কাস দেখাতে নিয়ে যেতেন যে গাড়িতে? আমরা মনে করে আজও হাসাহাসি করি যে, কোনও এক বছর চিড়িয়াখানায় যাওয়ার সময় একসঙ্গে সবথেকে বেশি কতজন ঢুকেছিলাম সেই গাড়িতে। এর বাইরে আর অ্যাম্বাসাডরের অস্তিত্ব অথবা গুরুত্ব আজ আমাদের কাছে নেই। তবে অবশ্যই রাস্তায় এখনও দেখা যায়। ট্যাক্সির রূপে কিংবা প্রাইভেট গাড়ি অথবা অফিসের ভেহিকেল হিসেবে। আমরা অন্য গাড়ি অথবা বাসে ট্রামে চেপে তার চলে যাওয়া দেখি নিস্পৃহ দৃষ্টিতে। কখনও ভাবি না যে, আমাকে একটা অ্যাম্বাসাডর কিনতে হবে। 
সন্দেহটা আগেই হয়েছিল। ২০২১ সাল মোটামুটি আমাদের নিশ্চিত করে দিয়ে যাচ্ছে যে, অনুমানটি সঠিক। অর্থাৎ সিপিএম ক্রমেই বাঙালির নস্টালজিয়ায় ঢুকে পড়বে। অর্থাৎ আগামী দিনে বাঙালি নতুন প্রজন্মকে পুরনো প্রজন্ম বলবে, তোরা জানিস না, সিপিএম একসময় কী প্রচণ্ড শক্তিশালী ছিল। কী দাপট ছিল! কী হাঁকডাক! তবে বহু অতীত স্মৃতি আছে, যেগুলির অভিঘাত ক্রমেই কমতে থাকে। একসময় সেগুলি মানুষ সম্পূর্ণ ভুলেও যায়।  সিপিএম কিন্তু চিরস্মৃতিতে থেকে যাবে। কারণ, এই দলটি বহু রেফারেন্স পয়েন্ট তৈরি করে রেখে গিয়েছে। যে কোনও ঘটনার প্রেক্ষিতে আমাদের মনে পড়ে সিপিএমের কথা। যেমন আজ যদি কোনও নেতানেত্রীকে দেখা যায়, বিরোধীদের সম্পর্কে অপশব্দ ব্যবহার করতে, আমরা সমালোচনা করি, ধিক্কার দিই। কিন্তু তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে বিরোধী দলনেত্রীকে ‘কালীঘাটের ময়না’সহ আরও অশালীন শব্দ বলেছিল একসময় এই দলটির নেতারা। ভোটের আগে, ভোটের পরে রাজনৈতিক হিংসা কিংবা সন্ত্রাস এখন যদি ইস্যু হয় হঠাৎ, বাঙালির তখন দ্রুত মনে পড়ে যায় সিপিএমের রেফারেন্স। কতরকম রাজনৈতিক থ্রিলার রচনা করেছিল তারা। ওরকম গণহত্যার সাসপেন্স থ্রিলার আর হল না। সেই বিজন সেতু থেকে ছোট আঙারিয়া। নানুর থেকে খেজুড়ি। কেশপুর গড়বেতা থেকে নন্দীগ্রাম।  রাজনৈতিক ডার্ক হরর চিত্রনাট্যকে একটা অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল এই দল। এখন দু একটি রাজনৈতিক হিংসার সংবাদ উপস্থিত হলেই এইসব মনে পড়ে মানুষের। তারা চোখ বড় বড় করে বিবরণ দেবে। আর উদাসীনভাবে শুনবে নয়া প্রজন্ম। তারা তো রাজনীতিতে শুধুই বিজেপি বনাম তৃণমূলের দাপট দেখছে। তাদের মনে এখন আর ওসব কথা দাগ কাটবে না। তারা এগিয়ে যাওয়া জীবনে ঢুকে গিয়েছে। ঠিক যেভাবে জীবন বদলে যায় টুজি, থ্রিজি, ফোর জি, ফাইভ জির হাত ধরে। কিন্তু পিছনেই রয়ে গিয়েছে সিপিএম। বেসিক মোবাইল হ্যান্ডসেট আর টেক্সট মেসেজের মতোই পুরনো হয়ে। আপডেট করতে পারেনি নিজেদের। তাই বাঙালি জীবনে সিপিএম স্মৃতির দলে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। 
সিপিএমকে একাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামক এক নেত্রী শেষ করে দিলেন, এটা সম্পূর্ণ ঠিক নয়। একইসঙ্গে সিপিএমেরও কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। তারা মন দিয়ে নিখুঁত কৌশলে প্রতিটি নির্বাচনের আগে ও পরে আত্মহত্যা করেছে। আত্মঘাতী নানাবিধ সিদ্ধান্ত অথবা অবস্থান নিয়েছে। অযোগ্যদের পার্টির মুখ করেছে। পার্টি থেকে শিক্ষাকে বিদায় করেছে। সিপিএম বিগত ১০ বছর ধরে রাজনীতি ছাড়া বাকি সব করেছে। সিপিএম কেন এভাবে বাঙালি রাজনীতি থেকে বিদায় নিল? কারণ, সিপিএমের কাছে মানুষের নতুন করে কিছু‌ই পাওয়ার নেই। একটি দল সম্পর্কে একটা আগ্রহ তো থাকবে? অর্থাৎ এই দল ক্ষমতায় এলে অথবা ক্ষমতাসীন থাকলে কী কী হতে পারে সেই আশাবাদ। 
সিপিএমের পুঁজি ছিল বামপন্থা। অর্থাৎ গরিবদের জন্য সরকার নানাবিধ অনুদান, সুযোগ সুবিধা, আর্থিক নিরাপত্তা ইত্যাদি দেবে। তৃণমূল সরকার সিপিএমের সেই  নীতি ইতিমধ্যেই বাংলায় পুরোদস্তুর প্রয়োগ করে চলেছে। তাঁর দল তথা সরকারের নামে যুক্ত রয়েছে কংগ্রেস। কর্মসূচিতে বাম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার চালাচ্ছেন ‘বামপন্থী কংগ্রেস’ মডেলে। সাধারণ মানুষ ও দরিদ্র সম্প্রদায়ের জন্য যতরকম প্রকল্প এখন আছে, সেগুলির থেকে বেশি আর কী দেবে সিপিএম? 
সিপিএম একটি দুটি শব্দকে আজও ব্যবহার করে গর্বের সঙ্গে। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব, সর্বহারার একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি। এগুলোর একটাও বাংলা কিংবা ভারতে হবে? সিপিএম নিজেও কোনওদিন বিশ্বাস করতো যে এসব হবে? তাহলে ১৯৬৪ সালে গঠিত দল, কয়েক বছরের মধ্যেই অজয় মুখোপাধ্যায়ের বাংলা কংগ্রেসের সঙ্গে  জোট করে সরকারে যোগ দিল কেন? তার মানে জন্মমুহূর্ত থেকেই সিপিএম সংসদীয় ক্ষমতায় আরোহণের জন্য আত্মনিবেদিত। কিন্তু আগাগোড়া জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব, সর্বহারার একনায়কতন্ত্র, এসব বলে মানুষকে ফাঁকি দিয়ে গেল। সিপিএমের একনিষ্ঠ কর্মী সমর্থকদের কাছে প্রথমে মনে হয়েছিল সর্বহারা মানে পার্টির কাছে মূলত  কৃষক ও শ্রমিক।  আশির দশকের পর সেইসব কর্মী সমর্থকরা বুঝতে পারলেন, কৃষক, শ্রমিকদের থেকেও পার্টির কাছে প্রকৃতপক্ষে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ‘সর্বহারা’ হয়ে গিয়েছে, শিক্ষক, প্রোমোটার, ঠিকাদার এবং ক্যাডার। 
কংগ্রেস ভুল করে তাদের আমলে মাস্তানরাজের জন্ম দিয়েছিল। মানুষ তিতিবিরক্ত হয়ে গিয়েছিল। ভীতি তৈরি হয়েছিল মানুষের মনে। কারণ, মাস্তানদের মনে হয়েছিল সর্বশক্তিমান। সিপিএম সেই ভুল করেনি। তারা ওই ভীতিকর, সমীহ সৃষ্টিকারী এবং সর্বশক্তিমান শ্রেণিকে রেজিমেন্টেড ম্যানেজমেন্টে নিয়ে এসেছিল। তার নাম লোকাল কমিটি! পাড়ায় পাড়ায় এই কমিটির অফিস ছিল আর্থ সামাজিক বিচারালয়। সমাজকে, শিক্ষাকে, সরকারি চাকরিকে, রাজনীতির যাপনকে, এমনকী প্রগতিশীল চিন্তাকেও কন্ট্রোল করার নেশায় পড়ে গিয়েছিল সিপিএম। সর্বহারার একনায়কতন্ত্র মানে শ্রমের মর্যাদা। সিপিএম অসংখ্য শিল্প আর কারখানা বন্ধ করে দিয়ে শ্রম ব্যাপারটাই তুলে দিল। আর কৃষকদের জমি দেওয়া পার্টি একদিন সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে কৃষকদের থেকে জমি কেড়ে নিল। তাই সিপিএমকে অবাক করে দিয়ে ২০১১ সালে  কাউন্টার ‘জণগণতান্ত্রিক বিপ্লব’ হয়ে গেল! 
এ রাজ্যে বিজেপির উত্থানকে সিপিএম সর্বদাই একটি পুরনো রেকর্ড চালিয়ে বলে থাকে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাত ধরে নিয়ে এসেছেন। সিপিএম নিজেদের প্রশ্ন করে না যে, মমতা নিয়ে এলেন, আর মানুষ সিপিএমকে পরিত্যাগ করে বিজেপিকে গ্রহণ করল কেন? অর্থাৎ নতুন নতুন যে দলই আসুক, সিপিএম কেন নিজেদের সময়োপযোগী ও গ্রহণযোগ্য করে রাখতে ব্যর্থ হল? মানুষ তৃণমূল ও বিজেপিকে কেন ভোট দিচ্ছে? এসব বিশ্লেষণ না করে, সিপিএমের বিশ্লেষণ করা উচিত ছিল যে, আমাদের কেন দিচ্ছে না? এখন বিশ্লেষণ করে কাজ হবে? না হবে না। দেরি হয়ে গিয়েছে। বাংলায় সিপিএম ক্রমেই পরিণত হয়ে যাবে একটি অতীত পার্টিতে! স্মৃতির রাজনীতি হয়ে! বাঙালির নতুন নস্টালজিয়া-সিপিএম! 

8th     October,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ