বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

সমালোচক আছে... আপনিই চিনতে পারছেন না
শান্তনু দত্তগুপ্ত

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি সাংঘাতিক একটা কথা বলেছেন। তিনি নাকি প্রকৃত সমালোচকদের খুব মিস করেন। সবাই অভিযোগ করে। সমালোচনা কেউ করে না! সমাজের এই প্রবণতায় তাঁর দারুণ খেদ। তাঁর এমন একটা মন্তব্য শুনে খানিক ঝটকাই লাগল। আমরা, মানে মানবসমাজ মস্তিষ্কচালিত। খান পাঁচেক ইন্দ্রিয় আছে, সেগুলো কিছু তথ্য সংগ্রহ করে মস্তিষ্কে পাঠিয়ে দেয়। সে সব দিয়ে মাথার মধ্যে কিছু কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন হয়। তারপর আমরা বিষয়টি সম্যকভাবে জানতে বা বুঝতে পারি। দেখছি, মোদিজির খেদোক্তি মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে! তাহলে এতদিন তাঁর এবং বিজেপি সরকার সম্পর্কে যা জেনে বা বুঝেছিলাম, সবই কি ভুল? সেই ২০১৪ সাল থেকে দেখে এসেছি... নরেন্দ্র মোদি সাংবাদিক বৈঠক করেন না। সাংবাদিকরা তাঁকে প্রশ্ন করবেন, আর তিনি বাধ্য রাজনীতিকের মতো তাঁদের সকল চোখা চোখা প্রশ্নবাণের উত্তর দেবেন! এ তাঁর ধাতে নেই। প্রশ্ন পছন্দ না হওয়ায় সাক্ষাৎকার থেকে উঠে যাওয়ার নজির তাঁর রয়েছে। আর রয়েছে পেটোয়া কিছু চ্যানেলের বাছাই করা সঞ্চালকের সামনে বসে বাণীবর্ষণ। সেও হাতে গোনা। আর যাই হোক, এরা তো আর ‘আজেবাজে’ প্রশ্ন করবে না! 
এটাই আপনার ট্র্যাক রেকর্ড। আর সোজাসাপ্টা বলছি, প্রকৃত সমালোচকদের নিয়ে যে মন্তব্য আপনি করেছেন, তার সঙ্গে এই ট্র্যাক রেকর্ড খাপ খায় না। আপনার শাসনকালের প্রথম পাঁচ বছরে দেশজুড়ে ক’টা রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছে জানেন? ৩২৬টা। আর তার মধ্যে দোষী সাব্যস্ত মাত্র ছ’জন। অর্থাৎ, বাকি ৩২০ জনকে আপনার পাপেট প্রশাসন, এজেন্সি এবং পুলিস বিনা কারণে ফাঁসিয়েছে! কী অপরাধ ছিল তাঁদের? কেউ বিজেপি সরকারকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেছিল, কেউ তুলে ধরেছিল প্রশাসনিক অপদার্থতা, আবার কেউ সংবাদমাধ্যমে ফাঁস করেছিল দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িক হিংসা। গত ২৬ জানুয়ারি দিল্লিতে ট্র্যাক্টর মিছিল করেছিলেন আন্দোলনকারী কৃষকরা। তাতে একজনের প্রাণ গিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে সরকার দাবি করেছিল, ট্র্যাক্টর উল্টে গিয়ে ওই কৃষক মারা গিয়েছেন। আবার একাংশ অভিযোগ করল, গুলি করা হয়েছে তাঁকে। কোনটা ঠিক? সে বিচার তো আদালত করবে! কিন্তু সেই রিপোর্ট সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করার জন্য সব মিলিয়ে ১০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হল। সবচেয়ে বড় কথা, ওই ১০ জনই কিন্তু খবরটি লেখেননি বা সরাসরি সম্প্রচার করেননি! কেউ কেউ শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছিলেন। তাতেই ‘রাজার সেনা’র রোষানলে তাঁরা। চারটি বিজেপি শাসিত রাজ্যে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। আপনার ভাষায়, তাঁরা তো অভিযোগ করেছিলেন... বা নিন্দা। সমালোচনা তো নয়! তাই না? সমালোচনা করতে পারতেন। তাহলে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হতো না! 
আপনি বরং একটা ক্লাস নিতে পারেন। দেশবাসীর জন্য... ওই আপনার পছন্দের প্রাইম টাইম... রাত ৮টায়। অভিযোগ, নিন্দা এবং সমালোচনার ফারাকটা বোঝাতে পারেন আমাদের। বিশেষত আমাদের মতো স্বল্পবুদ্ধি সাংবাদিকদের অবশ্যই আপনার ক্লাস দরকার। তাহলে আগামী দিনে এমন ভুল আর আমাদের হবে না। আমরা তখন আপনার বা বিজেপি সরকারের সমালোচনা করতে পারব। অভিযোগের আঙুল তুলব না! কিন্তু কথায় বলে না... স্বভাব যায় না মলে। আমাদের মতো সাংবাদিকরা এরপরও হয়তো ভুলচুক করে ফেলবে... স্ট্যান স্বামীর মতো বৃদ্ধ যখন বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেন, কিংবা লখিমপুর খেরিতে বিক্ষোভরত কৃষকদের পিষে দেবেন আপনারই মন্ত্রিসভার কোনও বড়লোক সদস্যের ছোটলোক ছেলে। এগুলোও তো অভিযোগ... তাই না? প্রমাণ তো কিছুই হয়নি। কৃষকদের দাবি, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্রর সুপুত্র আশিস মিশ্র গাড়ি দিয়ে তাঁদের সঙ্গীদের পিষে দিয়েছেন। কিন্তু মন্ত্রীমশাই বলছেন, ‘ওরা ভুল বলছে। আশিস ঘটনার সময় ওখানে ছিলই না! তখন ও ছিল আমার সঙ্গে, অনুষ্ঠানের মঞ্চে।’ মোদিজি, দয়া করে বিষয়টা একটু পরিষ্কার করে দেবেন। আশিস যদি গাড়ির চালকের আসনে নাই বসে থাকেন, তাহলে উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার কেন তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রুজু করল? কেউ তো মিথ্যা বলছে! সেটা কে? উত্তরটা আপনাকেই দিতে হবে। কারণ, আপনিই যে আমাদের মাইবাপ! কৃষকদের নাকি বিরোধী দলগুলো ভুল বোঝাচ্ছে। আপনার সহকর্মীর কথা মতো ওই আন্দোলনকারীদের সংখ্যা কিন্তু ১০-১৫ নয়! বরং লক্ষাধিক। ১০ জনকে ভুল বোঝানো যায়। লক্ষাধিক কৃষককে নয়। একটাই তো দাবি তাঁদের... তিন কালা কানুন বাতিল করতে হবে। আর আপনি বলছেন, আলোচনায় বসুন। মোদিজি, একবার মনে করে দেখুন তো... এই কৃষক প্রতিনিধিরা ঠিক কতবার আপনার নানা মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন! তারপরও কি কাজের কাজ কিছু হয়েছে? না হয়নি। কৃষকরা তাঁদের অবস্থানে অনড়। তাঁরা তো আপনার দেশবাসী... আপনার ভোটার! এতদিন ধরে মানুষগুলো ঘরবাড়ি, সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে রাস্তার উপর বসে আছে মানে, নিশ্চয়ই বেঠিক কিছু হচ্ছে! তাহলে ঠিক কোনটা? 
খুঁজে বের করুন। তার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা বেতন দেওয়া হয় আপনাদের... আমাদের মতো করদাতাদের রক্ত জল করা টাকা থেকে। অথচ, সমাধানসূত্র 
না খুঁজে আপনার প্রশাসন কী করছে? উস্কানি 
দিয়ে চলেছে কৃষকদের... তাঁরা অহিংসার পথ ছেড়ে তাণ্ডব শুরু করলেই যে আপনাদের সুবিধা! আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নের অভিযোগ চাপিয়ে কঠোর থেকে কঠোরতম অ্যাকশন নিতে পারবেন আপনারা। আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে। তাই তো চান আপনারা! খুব ভুল বললাম কি? তাহলে মার্জনা করে দেবেন। মানুষ মরছে... এর থেকে দুর্ভাগ্যজনক সত্যি আপনার জমানায় আর কিছু নেই। আর কত হাজার মরলে মানবেন আপনি? কত হাজার মরলে আপনাদের মনে হবে, নাঃ... এবার একটু দেশবাসীর কথা শোনা উচিত! হয়তো ভুলে গিয়েছেন... ওটাই আপনার কাজ। দেশের কথা শোনা... মানুষের কথা শোনা। 
দয়া করে আমাদের কাজ আপনি মনে করাবেন না। ওটা আমরা জানি। প্রশ্ন মানুষ তুলবে। আপনাকে ভোট দিয়ে মাথার উপর বসিয়েছি আমরা। আর তাই প্রশ্ন তোলাটা আমাদের অধিকার। সেটা আপনি অভিযোগ হিসেবে নেবেন, নাকি সমালোচনা... সে আপনি নিজেই ঠিক করুন। 
আপনারাই তো বড় মুখ করে বলেন, সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের ভিত্তি! ১৬ নভেম্বর তারিখটা জাতীয় সাংবাদিকতা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। গত বছর ওই দিনটায় অমিত শাহ একটা টুইট করেছিলেন... ‘দেশের ভিতকে আরও মজবুত করতে আমাদের মিডিয়াকুল অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা যাতে ক্ষুণ্ণ না হয়, তার জন্য মোদি সরকার দায়বদ্ধ।’ এরপরও ‘ঘটনা’ ঘটেছে... ঘটছে। ক্যারাভান নামে একটি ম্যাগাজিন আপনাদের সমালোচনার (অভিযোগ) জন্য ‘কুখ্যাত’। সেই পত্রিকার তিনজন পদাধিকারীর বিরুদ্ধে ১০টি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছে কেন বলতে পারেন? তাও পাঁচটা বিজেপি শাসিত রাজ্যে! দিল্লির বুকে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে এই ম্যাগাজিনের চারজন সাংবাদিকের উপর হামলা হয়েছে... দু’বার। দিল্লি মানে তো রাজধানী! এখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পুলিস... অর্থাৎ দোর্দণ্ডপ্রতাপ অমিত শাহের। তখন বোধহয় আর মিডিয়া বা গণতন্ত্রের ভিতের কথা আপনাদের মনে থাকে না! মনে পড়ে না, এই সংবাদমাধ্যমই দেশের ভিতকে আরও মজবুত করে তোলে। মানুষ বা ভোটার শব্দটাও স্মৃতি থেকে উধাও হয়ে যায়... থেকে যায় শুধুই একটা হিংস্র অধিকারবোধ... যা আপনারা স্বাভাবিক বলে মনে করেন। তাই অমিত শাহ আবার কৌশলে বুঝিয়ে দেন, ‘সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার অপব্যবহার করলে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যও মোদি সরকার দায়বদ্ধ’। তারই ফল বোধহয় রাষ্ট্রদ্রোহ... কিংবা আওয়াজ তুললে গায়ে আরবান নকশালের মতো তকমা সেঁটে দেওয়া। জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরে... মানতেই হবে, এই শব্দবন্ধ আপনারা দারুণ মুন্সিয়ানার সঙ্গে ব্যবহার করে থাকেন। ২ অক্টোবর মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন... লালবাহাদুর শাস্ত্রীরও। তাঁরই একটা কথা আজ খুব মনে পড়ছে... ‘এদেশে মন্দির, মসজিদ, গির্জা, গুরুদ্বার সবই আছে। কিন্তু আমরা তাদের রাজনীতিতে টেনে আনি না।’ আর আজ ওটাই একমাত্র উদ্দেশ্য... ধর্ম... রাজনীতি... ক্ষমতা। শাস্ত্রীজি আরও একটা কথা বলতেন... ‘আমাদের দেশ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী’।
স্বাধীনতা আজ আছে তো?

5th     October,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ