বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

স্বচ্ছ ভারতের প্রবক্তার অস্বচ্ছ ফান্ড
মৃণালকান্তি দাস

দাতাদের তালিকা দেখলে আপনার মাথা ঘুরে যাবে!
অভিনেতা অক্ষয় কুমার ২৫ কোটি টাকা। রামদেবের পতঞ্জলি যোগপীঠও ২৫ কোটি। টাকার অঙ্ক না বললেও বিরাট কোহলি ও অনুষ্কা শর্মাও রয়েছেন সেই তালিকায়। রয়েছেন দীপিকা পাড়ুকন, রণবীর সিং, শাহরুখ খান, করণ জোহর। রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতি দিয়েছেন একমাসের মাইনে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ছাড়াও বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক এবং আর্থিক সংস্থার কর্মীদের বেতন থেকে ২০০ কোটিরও বেশি অর্থ জমা পড়েছে এই তহবিলে। ৩৮ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা দিয়েছে ২,১০৫ কোটি টাকা। ২ কোটি ১২ লক্ষ টাকা দান করেছেন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ও বেসরকারি ব্যাঙ্কের অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরাও। কেবলমাত্র পিএসইউ, পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্ক নয়, দেশের তিন সশস্ত্র সেনাবাহিনী একযোগে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল পিএম কেয়ার্স ফান্ডে প্রায় ২০৩.৬৭ কোটি টাকা দিয়েছে। সেনাদের একদিনের বেতন কেটে সেই টাকা জমা পড়েছে এই ফান্ডে। তথ্যের অধিকার আইন (আরটিআই)-এ প্রকাশিত এক রিপোর্ট বলছে, শুধুমাত্র জীবনবিমা নিগমই সেই তহবিলে জমা দিয়েছে ১১৩ কোটি ৬৩ লক্ষ টাকা। এর মধ্যে ৮ কোটি ৬৪ লক্ষ টাকা এসেছে ওই সংস্থার কর্মীদের বেতন থেকে। ঘরবন্দি সাধারণ মানুষও অনেকে সাধ্যমতো চাঁদা দিয়েছেন।
প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স ৫০০ কোটি, টাটা গোষ্ঠী ৫০০ কোটি, আদিত্য বিড়লা গোষ্ঠী ৪০০ কোটি এবং আদানি গোষ্ঠীর তরফে ১০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে 
এই তহবিলে। এ ছাড়া মাহিন্দ্রা গোষ্ঠী, টেক মাহিন্দ্রার মতো বেসরকারি সংস্থার তরফেও বিপুল অনুদান জমা পড়েছে। বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির মধ্যে আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক সর্বোচ্চ ৮০ কোটি, এইচডিএফসি ব্যাঙ্ক ৭০ কোটি টাকা দিয়েছে। এমনকী রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে ইয়েস ব্যাঙ্ককে খাদের মুখ থেকে টেনে তুলেছে, তারাও এই তহবিলে ১০ কোটি টাকা এবং কর্মীদের একদিনের বেতন বাবদ ১.৯ কোটি টাকা দিয়েছে। সেই তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হয়েছে। দেখে মনে হতেই পারে, এ যেন তহবিলে টাকা ঢালার প্রতিযোগিতা। যদিও দেশবাসী এখনও জানে না, মোট কত অর্থ জমা পড়ল এই রহস্যময় তহবিলে।
সমালোচকরা বলছেন, করোনার মতো দুর্যোগকেও কাজে লাগিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। তাই নাম বেছেছিলেন— পিএম কেয়ার্স। প্রাইম মিনিস্টার’স সিটিজেন অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যান্ড রিলিফ ইন এমারজেন্সি সিচ্যুয়েশনস ফান্ড। যেন মহামারীকালে নরেন্দ্র মোদি একাই পরিত্রাতা। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন দেশে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গেও ভিডিও কনফারেন্স করে এই তহবিলে অর্থ জোগাড়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সরকারি-তন্ত্র ব্যবহার করে বিভিন্ন সরকারি ফান্ডের টাকা স্রেফ হুকুমের জোরে এই ফান্ডে ঢেলেছে। কলেজ, ব্যাঙ্ক, বিমা কোম্পানির ফান্ড— কিছুই ছাড়েনি। খোদ অর্থ মন্ত্রকের রাজস্ব দপ্তর গত বছরের এপ্রিলে সার্কুলার জারি করে জানিয়েছিল, কারও আপত্তি না থাকলে এক বছর পর্যন্ত ইচ্ছুক কর্মীদের প্রতি মাসে একদিনের বেতন কেটে পিএম কেয়ার্সে জমা করা হবে।
গত বছরের ২৮ মার্চ করোনার মোকাবিলায় ‘পিএম কেয়ার্স’ তহবিল গঠন করে নরেন্দ্র মোদি সরকার। ২ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা দিয়ে ওই 
তহবিল চালু হয়েছিল। যা প্রধানমন্ত্রী নিজেই দান করেছিলেন। শুরু থেকেই বিরোধীদের প্রশ্ন ছিল, প্রধানমন্ত্রী জাতীয় ত্রাণ তহবিল থাকতে কেন পিএম কেয়ার্স তহবিল গঠনের প্রয়োজন দেখা দিল? এই তহবিলের টাকা কীভাবে খরচ হবে, কীভাবে তার হিসাব পরীক্ষা হবে, সেই সব নিয়মকানুনই বা কোথায়? জাতীয় দুর্যোগকেও ব্যক্তিপুজোর কাজে লাগানো হচ্ছে কেন?
কম জলঘোলা হয়নি!
মোদি দুর্নীতি মুক্ত ভারতের স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসেন। আর গত জুনে একটি আরটিআইয়ের জবাবে তাঁর গড়া তহবিল নিয়ে তথ্য জানাতে অস্বীকার করে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর সাফ জানিয়ে দেয়, পিএম কেয়ার্স তহবিল আরটিআইয়ের আওতায় পড়ে না। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের যুক্তি, পিএম কেয়ার্স তথ্যের অধিকার আইনে না এলেও সমস্ত তথ্য ওয়েবসাইটেই রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে গত বছর ২৭ মার্চ তৈরি হওয়া পিএম কেয়ার্সের ওয়েবসাইটে গত বছরেরই ৩১ মার্চ পর্যন্ত, অর্থাৎ মাত্র চার দিনের আয়-ব্যয়ের হিসেব রয়েছে। তাতে দেখা যায়, মার্চের শেষে তহবিল গঠনের পর প্রথম কয়েক দিনেই অর্থাৎ ২০২০ সালের ৩১ মার্চের মধ্যেই ৩০৭৬ কোটি ৬২ হাজার টাকা জমা পড়েছে। এর মধ্যে দেশের ভিতর থেকে সংগ্রহ হয়েছে ৩০৭৫ কোটি ৮৫ হাজার টাকা। এবং বিদেশ থেকে জমা পড়েছে ৩৯ লক্ষ ৬৭ হাজার টাকা এসেছে। এ ছাড়াও, সুদ মিলেছে প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা। তবে এই তথ্য তুলে ধরা হলেও কারা এই টাকা দিলেন, তা জানানো হয়নি। তারপরে দেড় বছরের বেশি সময় কেটে গেলেও আর কোনও আয়-ব্যয়ের হিসেব নেই। স্বাভাবিকভাবেই বিরোধীরা এই তহবিলের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। টুইট করে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী চিদম্বরম প্রশ্ন তোলেন, ‘যিনি দান গ্রহণ করেছেন, তাঁকে সবাই চেনেন। ট্রাস্টিদেরও চেনেন সকলে। তাহলে অনুদানকারীদের নাম প্রকাশে ভয় কীসের?’ আসলে এই তহবিল নিয়ে রহস্য বাড়িয়েছে মোদি সরকারই!
প্রধানমন্ত্রীর নামেই তহবিল। তিনিই চেয়ারম্যান। তহবিলের ঠিকানা সাউথ ব্লকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। ওয়েবসাইট খুললেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ছবি। নামের সঙ্গে জাতীয় প্রতীক অশোক স্তম্ভও। তাতে চাঁদা চেয়ে সরকারি খরচে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, ব্যাঙ্কের কর্মীদের বেতন কেটে তহবিলে টাকা জমা করা হয়েছে। রেল থেকে বিদেশ মন্ত্রক, শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রক— সরকারের প্রতিটি মন্ত্রকই কোটি কোটি টাকা এই তহবিলে অনুদান হিসেবে জমা করেছে। পিএম কেয়ার্সের ওয়েবসাইটে যোগাযোগের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারির নামই রয়েছে। এই তহবিলে অনুদানে ১০০ শতাংশ কর ছাড়, এমনকী বিদেশ থেকে অনুদানেও ছাড় দেওয়া হয়েছে।
অথচ, গত ২৪ সেপ্টেম্বর হলফনামা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের দাবি করেছে, পিএম কেয়ার্স ফান্ড সরকারি তহবিল নয়! পিএম কেয়ার্স তহবিলের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও সম্পর্ক নেই। এই তহবিল কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন নয়। এর কাজকর্মেও সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। সংবিধান বা সংসদের তৈরি কোনও আইনের মাধ্যমে এই তহবিল তৈরি করা হয়নি। এমন একটা তহবিলের কোনও হিসাব পরীক্ষাও হয়নি গত দেড় বছর ধরে।
এ যেন মগের মুলুক!
কোটি কোটি টাকা জমা পড়লেও গোড়া থেকেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এই তহবিলের হিসেব পরীক্ষা করতে দেওয়া হবে না সরকারি সংস্থা সিএজি (কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল)-কে। তার বদলে অন্য কোনও বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে এই কাজ করানো হবে। এর অর্থ, শুধুমাত্র কেন্দ্র-নিযুক্ত অডিট সংস্থা, বা বলা ভালো বিজেপি-ঘনিষ্ঠ সংস্থাই অডিট করতে পারবে। এর কর্ণধার আবার নিযুক্ত হয়েছেন সুনীল গুপ্ত। যিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-সহ বিজেপির একাধিক প্রভাবশালী নেতার ঘনিষ্ঠ। ফলে প্রথম থেকেই অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠেছে।
শুনলে অবাক হবেন, যে চীনের সঙ্গে এত আকচাআকচি, যে চীনের সঙ্গে লড়াইয়ে মোদি সরকারের রক্তের তেজ টের পায় গোটা দেশ, সেই চীনের সংস্থা হুয়ায়েই কোভিড মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর তৈরি ‘পিএম কেয়ার্স’ তহবিলে ৭ কোটি টাকা দিয়েছে। এত দিন বিজেপির অভিযোগ ছিল, চীন ও দিল্লিতে চীনের দূতাবাস কংগ্রেসের ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ রাজীব গান্ধী ফাউন্ডেশনে চাঁদা ঢেলেছে। আর আজ সেই কংগ্রেস অভিযোগ তুলছে, মোদি সরকার চীন সম্পর্কে সুর নরম করছে কেন তার পর্দা ফাঁস হয়ে গিয়েছে। কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘পিএম কেয়ার্সে চীনা সংস্থা টিকটক কি ৩০ কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছে? পেটিএম, যাদের মালিকানার ৩৮ শতাংশ চীনের কাছে, তারা কি ১০০ কোটি টাকা দিয়েছে? চীনের শাওমি কি ১৫ কোটি টাকা দিয়েছে? ওপ্পো কি ১ কোটি টাকা দিয়েছে? উত্তর দিন!’
দুর্নীতির পরম্পরা বন্ধের গল্প শুনিয়ে গোটা দেশকে যিনি আচ্ছন্ন করে রাখেন, সেই মোদিজির পিএম কেয়ার্স কতটা স্বচ্ছ? গত অক্টোবরেই ভেন্টিলেটরের বরাতে পিএম কেয়ার্সের দেওয়া টাকায় দুর্নীতির গন্ধ মিলেছে। জানা যায়, ২০২০-র এপ্রিলে চেন্নাইয়ের একটি মেডিক্যাল প্রযুক্তি সংস্থাকে সাত হাজার ‘বেসিক’ এবং তিন হাজার ‘অ্যাডভান্স’ ভেন্টিলেটরের বরাত দেওয়া হয়। যার অর্থ বরাদ্দ করা হয় পিএম কেয়ার্স তহবিল থেকে। একটি সংবাদমাধ্যমের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দাবি করে, ট্রিভিট্রন যখন বরাত পায়, সেই সময়ে বেসিক কিংবা অ্যাডভান্স কোনও ধরনের ভেন্টিলেটর তৈরির অভিজ্ঞতাই ছিল না তাদের। আর এখানেই উঠেছে প্রশ্ন। একেবারে অনভিজ্ঞ একটি সংস্থাকে কীসের ভিত্তিতে ৩৭৩ কোটি টাকার বরাত দেওয়া হল? ভেন্টিলেটরগুলি কত টাকায় কেনা হচ্ছে, তথ্যের অধিকার আইনে তা জানতে চেয়েছিলেন ভেঙ্কটেশ নায়েক নামে এক সমাজকর্মী। তারপরেই জানা যায়, বেসিক মডেলের এক-একটির দাম এক লক্ষ ৬৬ হাজার ৩৭৬ টাকা। অ্যাডভান্স মডেলের ভেন্টিলেটরের প্রতিটির মূল্য এর পাঁচ গুণেরও বেশি। ৮ লক্ষ ৫৬ হাজার ৮০০ টাকা। একে ঘোটালা বলবেন না?
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, আসলে এই তহবিল বিশ্বের সব থেকে অস্বচ্ছ ও অন্ধকারে ঢাকা। ওরা আদালতে বলেছে, এটা সরকারের নয়, তাহলে অশোক স্তম্ভের ছবি কেন? পিএম কেয়ার্সের জন্য প্রধানমন্ত্রী নিজের পদের অপব্যবহার করেছেন? সাধারণ মানুষের শ্রমের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা এভাবে নয়ছয় কেন? তাহলে কি ‘স্বচ্ছ ভারতের প্রবক্তা’-ও ঘোটালার পচা জলে ডুব দিয়েছেন!

30th     September,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ