গত শনিবার, মানে ২৫ সেপ্টেম্বরের ওয়াশিংটন পোস্ট কাগজ ছিল ৫৬ পাতার। আগাপাশতলা খুঁজে একটা শিরোনামেও নরেন্দ্র মোদিকে পাওয়া গেল না। খবর একটা হয়েছে বটে ১৩ নম্বর পাতায়... বিষয়বস্তু, প্রথম কোয়াড বৈঠকে প্রচ্ছন্ন চ্যালেঞ্জ চীন। একটি সাদা-কালো ছবি রয়েছে তাতে... দূর থেকে নেওয়া ফ্রেম—বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এবং মোদিজি। অদ্ভুত ব্যাপার কিন্তু... আমেরিকার মাটিতে এত বড় সম্মেলন, সেখানে উপস্থিত বাঘা বাঘা সব রাষ্ট্রনেতা... অথচ বিশ্বখ্যাত একটা সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় খবর বলতে কি না দক্ষিণ আমেরিকার জলস্তর নেমে যাওয়া, আর বাইডেনের বুস্টার ভ্যাকসিন তত্ত্ব! স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি উপস্থিত মার্কিন মুলুকে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র এবং তার থেকেও বড় বাজার অর্থনীতির সর্বময় ‘কর্তা’ তিনি। বাইডেনের সঙ্গে তাঁর সখ্য নাকি ‘প্রাচীন’! আমেরিকার সঙ্গে মিলেমিশে মোদিজি এক নতুন অক্ষের সূচনা করছেন। সন্ত্রাসের আগুনে ইন্ধন দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের বাপ-বাপান্ত করছেন। অথচ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ওয়াশিংটন পোস্টের একটা হেডিংয়েও নেই! আরও দুর্ভাগ্যজনক, নিউ ইয়র্কে একপ্রকার খালি অডিটরিয়ামে ভাষণ দিতে হচ্ছে তাঁকে! আমাদের কাছে কিন্তু এই সফরের বা এই ভাষণের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই দেশের প্রায় সব সংবাদমাধ্যম ফলাও করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মোদিজির বাণীবর্ষণ ছেপেছে। ইমরান খানের দেশকে তিনি হুমকি দিচ্ছেন, তালিবানি শাসকদের হুঁশিয়ার করছেন, আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বন্ধুতার বীজ লাগাচ্ছেন... অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু একটা কথা ভেবেচিন্তে বলুন তো... নরেন্দ্র মোদির এই সফরে বা ভাষণে আপনার সংসারের কী উপকার হল? পেট্রলের দাম কি এক ধাক্কায় ৬০ টাকায় নেমে এল? নাকি রেশন দোকানে গিয়ে পাঁচ কিলো চাল বাড়তি পেলেন? এমনকী করোনাও দেশ ছেড়ে বিদায় নিল না! তাহলে আম আদমির কাছে মোদিজির আমেরিকা সফর কি মারাত্মক খবর?
বাংলার একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের নাগরিক হিসেবে বলতে পারি, বিদেশে মোদিজির প্রচার বেলুন ফোলানোর থেকে মানুষের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবর ভবানীপুরের উপনির্বাচন। এলাকার ভোটাররা বলছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিতবেন। সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। তৃণমূল কংগ্রেসও সে ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। প্রত্যয়ী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও। তারপরও তিনি ভোট প্রচারে বেরিয়ে বলছেন, ‘প্রত্যেকটা ভোট আমার কাছে প্রয়োজনীয়... এই উপনির্বাচনে জয় আমার দরকার... না জিতলে কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আমাকে আর পাবেন না...’। প্রশ্ন হল, কেন বলছেন তিনি এমন কথা? শুভেন্দু অধিকারী কটাক্ষ করছেন, মাননীয়া আত্মবিশ্বাস হারিয়েছেন। সত্যিই কি তাই? বিজেপির বিজাতীয় কর্তাব্যক্তিরা না হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চেনেন না। কিন্তু শুভেন্দুবাবু তো চেনেন... এবং হাড়ে হাড়ে। আজ তিনি রাজনৈতিক জাত-ধর্ম খুইয়ে বিজেপির হোতা হওয়ার আশায় হিল্লি দিল্লি করছেন। কিন্তু এক সময় যে তৃণমূল কংগ্রেসের অন্নে তিনি তথাকথিত ‘জননেতা’ হয়েছেন, সেই দলের সুপ্রিমো আত্মবিশ্বাস হারান না... হারাতে পারেন না। সেটা শুভেন্দুবাবু জানেন। তাহলে কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার আবেদন নিয়ে হাজির হচ্ছেন ভবানীপুরের মানুষের দরবারে? কারণ একটাই, এই বিধানসভা কেন্দ্রে জয় হাসিলটুকুই তাঁর লক্ষ্য নয়। দলের শীর্ষ নেতারা তাঁকে বলেছিলেন, এই উপনির্বাচনে আপনাকে প্রচারে নামতে হবে না। এত বছরে আপনি তো আমাদের তৈরি করেছেন! দেখুন না, আপনার হয়ে আমরা প্রচারপর্বটা সামলাতে পারি কি না? হয়তো তাঁরা পারতেন। তাও মাঠে নেমেছেন মমতা। ২১১টি কেন্দ্রে জয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হাতে নিয়েও। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তিনি... আছেন, থাকবেনও। তাও তিনি চাইছেন, ভবানীপুর হোক বিজেপির শেষের শুরু। এ এক অদ্ভুত লড়াই তাঁর। গত দু’টি লোকসভা নির্বাচনে বিরোধীদের পর্যুদস্ত করে দিল্লি দখল করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। তাঁর শাসনের প্রতিটি দিন একে একে কেড়ে নিয়েছে ভারতের নাগরিকদের অধিকার... মত প্রকাশের, ব্যক্তি স্বাধীনতার, বেঁচে থাকার। তারপরও বিরোধীরা এককাট্টা হয়নি। নেপথ্যে কংগ্রেসের নেতৃত্বহীনতা এবং দেশজুড়ে বিরোধী দলগুলির অঞ্চলভিত্তিক স্বার্থচিন্তা। তাই যেচে পড়েই দায়িত্বটা কাঁধে নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দিল্লি গিয়ে বিরোধীদের সম্মিলিত বৈঠকে জানিয়ে এসেছেন, ‘নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহকে হটাতে একজোট হতে হবে আমাদের। প্রধানমন্ত্রীর মুখ কে হবেন, সেটা পরের কথা। আগে জোটবদ্ধ হয়ে সরাতে হবে এই জগদ্দল পাথরকে।’ সিপিএম নামক এক জগদ্দল পাথরকে দশ বছর আগে হটিয়েছিলেন তিনি। এবার লক্ষ্য আর এক... এবার লক্ষ্য দিল্লি। তাই তাঁর কাছে ভবানীপুর গুরুত্বপূর্ণ। এখানকার মানুষ গুরুত্বপূর্ণ। এ এমন এক কেন্দ্র, যাকে সর্বধর্মের মানবজমিন বললেও ভুল বলা হয় না। এ যেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন রাজনৈতিক সংগ্রামের ড্রেস রিহার্সাল। শুভেন্দুবাবু এই সারসত্যটুকু বোঝার অনেক ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছেন। দিলীপ ঘোষ তাঁর মাথার উপর ছড়ি ঘোরাতে পারছেন না, উনি তাতেই খুশি। নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে জয়ের (যদিও বিচারাধীন) নেশায় ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন। নন্দীগ্রামে ঝড়ে বক মরেছিল। সব সময় মরবে না। আসলে ভয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাননি... পেয়েছে বিজেপি। মোদিজির অন্দরমহলের ব্যারিকেড ভেঙে ঢুকে পড়েছে আতঙ্ক... সাম্রাজ্য হারানোর। আপনার বন্ধুত্বের তালিকা কতটা দীর্ঘতর হল... তাতে জো বাইডেন উড়ে এসে জুড়ে বসলেন, নাকি জি জিনপিং আপনার প্রাণের সখা হয়ে উঠলেন, মানুষের কিছু আসে যায় না। এমনকী ওয়াশিংটন পোস্ট আপনাকে নিয়ে কী লিখল... আদৌ কিছু আপনার সফর উপাখ্যান ছাপল কি না, তাতেও আম জনতার বয়ে গিয়েছে। মানুষ চায় শান্তি... স্বস্তি... বেঁচে থাকার অধিকার। ধর্ম, জাতপাতের নামে ডুগডুগি বাজাতে পারেন, তাতে মানুষের পেট ভরে না। আর তখনই জন্ম নেয় অসন্তোষ, ক্ষোভ। সেই আঁচ পৌঁছে যায় দলের গভীরে। ঠিক যেভাবে এখন আপনাদের হচ্ছে... রাজ্যে রাজ্যে। আপনারই এক সময়ের বিশ্বস্ত নেতারা বোমা ফাটাচ্ছেন, ‘মোদি ম্যাজিকে আর ভোটে জেতা যাবে না। দলকে সেই মতো প্রস্তুতি নিতে হবে।’ মানেটা পরিষ্কার, আপনারা মানুষের থেকে দূরে সরে গিয়েছেন। আপনার দল সেটা বুঝছে... বুঝছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তাই তিনি আজ আর শুধু বাংলায় থমকে নেই। এতটুকু ফাঁক রাখতে নারাজ তৃণমূল নেত্রী। রাজনীতির প্রোটোকল মেনে, গা বাঁচিয়ে, ঠুনকো সম্মানের চাদর গায়ে দিয়ে ভাষণ নয়, বরং মানুষের সঙ্গে মিশে আর্জিটুকু পৌঁছে দেওয়া... আপনাদের প্রত্যেকটা ভোট আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
এই ভোট একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ আমাদের কাছে... আম জনতার কাছে। কারণ, নরেন্দ্র মোদি তাঁর বিদেশ সফরে ৬৫ ঘণ্টায় ২০টা বৈঠক করলেন কি না, তার থেকে অনেক বেশি জরুরি লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ফর্ম। কোথা থেকে মিলবে এই ফর্ম? কিংবা দুয়ারে সরকার আমাদের পাড়ায় আবার কবে বসবে? বেকারত্বের হার কি কমল? পশ্চিমবঙ্গ সরকার আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রে নিয়োগ শুরু করেছে... সেগুলো কবে, কীভাবে হবে? এই প্রশ্নগুলো আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে... সরাসরি কাজে লাগবে। আমরা জানি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়ের প্রত্যেকটা ইটের
সঙ্গে জুড়ে আছে মানুষের অন্ন সংস্থান, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মানুষের হাতে কয়েকটা টাকা... আরও কিছু পরিষেবার পথ সহজ হয়ে যাওয়া। কারও মেয়ের বিয়ের টাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢুকবে, কারও ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ঋণ পাবে। তাহলে এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয় কি?
প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে বহু ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যেতে হয় আম জনতাকে। রাজনীতির কারবারিরা ভুলে যান... পরীক্ষায় বসতে হয় তাঁদের। প্রতিনিয়ত। প্রতি পদক্ষেপে আম জনতার খাতায় তাঁরা নম্বর পেয়ে থাকেন। কখনও প্লাস, আবার কখনও মাইনাস। মাইনাস পয়েন্ট বাড়তে থাকলে ধীরে ধীরে তা রূপ নেয় প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার। ১০ বছরে তেমন নেগেটিভ মার্কিং তৃণমূল সরকারের হয়নি... মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়নি। তাহলে বিজেপির জয় কেউ রুখতে পারত না। উল্টো দিক থেকে দেখলে, সাত বছরে নম্বর অনেকটাই কাটা গিয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকারের। তাই পঞ্চায়েত, পুরসভা, বা রাজ্য... সূত্রপাত হয়েছে পতনের। মোদিজির সরকার এবং দলও বিরোধীদের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের সীমা পার করছেন। আর আমরা? দেখছি, শুনছি, বিচার করছি... নম্বর দেওয়ার পালাপার্বণ চলছে পরীক্ষার খাতায়। মোদিজি ভুলে যাবেন না, সুপ্রিম কোর্ট নয়... গণতন্ত্রে সর্বোচ্চ বিচারক কিন্তু দেশের নাগরিকই। ভুলবেন না আর একটি তথ্য—২০১১ সালের উপনির্বাচনে ভবানীপুর থেকেই ৫৪ হাজার ভোটে জিতেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কারণ, মানুষের মাঝে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। এবারও মিশে গিয়েছেন তিনি আম জনতার সঙ্গে। ১০ বছর আগের নিজের রেকর্ড নিজেই ভাঙবেন... এটাই যে তাঁর লক্ষ্য।