বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

‘উপেক্ষিত নায়ক’ হয়েই
থেকে গেলেন দিলীপ
তন্ময় মল্লিক

বিজেপির দিল্লির নেতারা ৭৭-এ পৌঁছনোর অঙ্কটা ৩ থেকে শুরু না করে ১২১ থেকেই কষলেন। তাই মেয়াদ শেষের আগেই রাজ্য সভাপতির পদ থেকে অপসারিত হলেন দিলীপ ঘোষ। এটা কি বিজেপির ভাঙন ঠেকানোর পদক্ষেপ, 
নাকি শিক্ষিতদের পাশে পাওয়ার কৌশল! তবে, ব্যর্থতার দায় দিলীপ ঘোষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিল্লির নেতাদের হাত ধুয়ে ফেলার অভিসন্ধিও অস্বীকার করা যাচ্ছে না। অপসারণের কারণ যাই হোক না কেন, টাইমিং নিয়ে শুরু হয়েছে জোর চর্চা। অনেকে বলছেন, উপনির্বাচনের ফল খারাপ হলে দিলীপবাবুকে 
সরাতে পারত। তাতে সাপও মরত, লাঠিও ভাঙত না। আর বঙ্গে বিজেপিকে প্রতিষ্ঠিত করার মূল কাণ্ডারীর বিদায়পর্বটাও অসম্মানজনক হতো না। তা সত্ত্বেও কেন এই আচমকা ‘ঘাড়ধাক্কা’? এটা কি বিজেপির আদিদের প্রতি বিশেষ কোনও বার্তা? প্রশ্নটা তোলা থাকল।
বাংলায় মুখ থুবড়ে পড়ার জন্য দিলীপ ঘোষকে ‘বলির পাঁঠা’ করা হলেও তাঁকে ‘সাইড লাইনে’ রেখেই ‘মিশন-২০২১’ সফল করতে চেয়েছিলেন দিল্লির নেতারা। তারজন্য তাঁরা তৃণমূল ভাঙতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। ওজন না বুঝেই দলবদলুদের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন চার্টার্ড প্লেন। কারণ? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারিয়ে মরচে ধরা ‘মোদি ম্যাজিকে’র গায়ে রংয়ের প্রলেপ দিয়ে চকচকে করা। সেই বাসনা থেকেই নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ বঙ্গে শুরু করেছিলেন ডেলি প্যাসেঞ্জারি। বাঘের গুহায় ঢুকে বাঘ মেরে তাঁরা ‘বাঘাযতীন’ হতে চেয়েছিলেন। উল্টে বাঘই তাঁদের গিলে খেয়েছে।
দিলীপবাবুর হাত ধরেই এরাজ্যে বিজেপির উত্থান। সেটা তাঁর অতি বড় সমালোচকও মানেন। তবে, যেটা তাঁর সাফল্যের উপাদান, সেটাই সমালোচনার কারণ। দিলীপবাবু সমালোচিত হয়েছেন তাঁর আলটপকা ও গরম গরম মন্তব্যের জন্য। শাসক দলের মোকাবিলায় তাঁর হুমকির ভাষা কখনও কখনও সিনেমায় ভিলেনের সংলাপকেও হার মানিয়েছে। মিঠুন চক্রবর্তীর মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানের স্টাইলে তিনি তৃণমূলীদের উদ্দেশে বলেছেন, আসবে হেঁটে, ফিরবে খাটিয়ায় চেপে। মুখের ভূগোল এমন করে দেব, মা, বউ দেখলেও চিনতে পারবে না। বুদ্ধিজীবীদের সমালোচনার উত্তরে বলেছেন, ‘রগড়ে দেব’।
বহু ক্ষেত্রেই তাঁর ‘ভাষা-সন্ত্রাস’ শালীনতার গণ্ডি অতিক্রম করেছে। তার জেরে রাজ্যজুড়ে নিন্দার ঝড় বয়েছে। এমনকী, বিজেপির বহু নেতাও প্রকাশ্যে কড়া সমালোচনা করেছেন। কিন্তু, কখনও দিলীপবাবু নিজের কথা থেকে পিছিয়ে আসেননি। আর পাঁচজন রাজনীতিকের মতো বিপাকে পড়ে পাল্টি খাননি। একবারও বলেননি, আমার কথার অপব্যাখ্যা হচ্ছে। এটাই দিলীপ ঘোষের স্টাইল।
দিলীপবাবু এমন একটা সময় বিজেপির সভাপতি হয়েছিলেন, যখন এরাজ্যে বিরোধী বলে প্রায় কিছুই ছিল না। ভয়ে ঘরে ঢুকে গিয়েছিল সিপিএম। বিজেপি সবে অঙ্কুরিত হচ্ছে। ফাঁকা মাঠে তখন শুধুই শাসক দলের মাতব্বরদের দাপাদাপি। মানুষ ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পেত না। তেমনই এক সময়ে বিজেপির হাল ধরেছিলেন দিলীপবাবু। তিনি বুঝেছিলেন, সিপিএমের ঘরে ঢুকে যাওয়া কর্মীদের কাছে টানতে হলে আগে সাহস জোগাতে হবে। আর তার একটাই রাস্তা, গরম গরম ভাষণ। তাই কথার ফুলঝুরির আগুনে তিনি মিইয়ে যাওয়া বাম কর্মীদের মনোবল সেঁকেছিলেন। তাঁর সেই গেমপ্ল্যান যে সফল, সেটা সবচেয়ে বেশি বুঝতে পারছেন সিপিএম নেতারা।
সভ্য সমাজ যাকে মান্যতা দেয় না সেটাই অশালীন, অশোভন। দিলীপবাবুর বহু কথা সভ্য সমাজে পাতে দেওয়ার অযোগ্য। তবুও তিনি সেই রাস্তাতেই হেঁটেছেন। কারণ দিলীপবাবু রাজ্য সভাপতির দায়িত্ব নিয়েই বুঝেছিলেন, ঢাল, তরোয়াল বিহীন দলের তিনি হলেন ‘নিধিরাম সর্দার’। তাই সংগঠন দিয়ে তৃণমূলের মোকাবিলা অসম্ভব। টক্কর নেওয়ার রাস্তা একটাই, রক্ত গরম করা ভাষণ। রাজ্য সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সেটাই তিনি নিষ্ঠাভরে করে গিয়েছেন। তারজন্য সুশীল সমাজ তাঁকে অপছন্দ করলেও তিনি লাইন বদল করেননি। কারণ তিনি জানেন, তাঁর গরম গরম ভাষণ দলের নিচুতলার কর্মীদের কাছে ‘ভোকাল টনিকে’র কাজ করে।
ব্যর্থতার যাবতীয় দায় যে দিলীপ ঘোষের ঘাড়েই চাপতে চলেছে, তা তাঁকে দিল্লি তলবের দিন‌ই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। নাড্ডাজির জরুরি তলবের পরেও তাঁকে একটা দিন ‘ওয়েটিং রুমে’ ফেলে রাখা হয়েছিল। তখনই বোঝা গিয়েছিল, রাজ্য সভাপতির পদ থেকে তাঁর বিদায় স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। দিলীপবাবুকে না সরালে বঙ্গে ব্যর্থতার দায় 
বিজেপির দিল্লির নেতাদের ঘাড়ে গিয়ে চাপত। কিন্তু রাজা কখনও ভুল করতে পারেন না। তাই দিলীপই হলেন ‘বলির পাঁঠা’।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, রাজ্য সভাপতি বদলের টাইমিং। পরিবর্তন নির্দিষ্ট সময়ে হলে চর্চা হয় কম। মেয়াদ শেষে বা উপনির্বাচনের পর দিলীপবাবুকে সরানো হলে হয়তো কোনও প্রশ্নই উঠত না। কিন্তু মমতার উপনির্বাচনের মুখে বিজেপি রাজ্য সভাপতি বদল করায় অনেকের মনে প্রশ্ন জাগছে, এই সময়ে সভাপতি পরিবর্তনের পিছনে কি অন্য কোনও কৌশল রয়েছে?
ভবানীপুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব যে অনেকেই ফিরিয়ে দিয়েছেন, সেকথা নিজে মুখে কবুল করেছিলেন দিলীপ ঘোষ। শেষপর্যন্ত প্রিয়াঙ্কা টিবরিওয়ালকে প্রার্থী করে মুখরক্ষার লড়াইয়ে নেমেছে বিজেপি। মমতার সঙ্গে ধারেভারে কোনও কিছুতেই বিজেপি প্রার্থীর তুলনা চলে না। বিধানসভা নির্বাচনে মোদি-অমিত শাহ জুটি ‘ঝড়’ তোলার পরেও ভবানীপুরে তৃণমূল জিতেছিল প্রায় ২৮ হাজার ভোটে। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। মমতা একের পর এক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালন করেছেন। তাঁর লক্ষ্মীর ভাণ্ডার সমস্ত সামাজিক প্রকল্পের জনপ্রিয়তাকে ছাপিয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় মানুষের চর্চার মধ্যে থাকাটাই বিজেপির কাছে মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ।
বিজেপির ৩৮ শতাংশ ভোটের বেশিরভাগটাই সিপিএম থেকে আসা। মমতার সরকার উল্টে যাবে এমন আশায় বহু কট্টর বামকর্মীও বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তাঁরা বুঝেছেন, সবটাই ছিল প্রচারের ধাপ্পাবাজি। তাই তাঁদের অনেকেরই মোহভঙ্গ হচ্ছে। এর পাশাপাশি যত দিন যাচ্ছে বিজেপি ততই ভাঙছে। দলবদলু নেতারা একে একে ফিরছেন তৃণমূলে। এমনকী, ঘরের ছেলেদেরও বিজেপি ধরে রাখতে পারছে না। এই অবস্থায় বিজেপির ভোট কোথায় গিয়ে ঠেকবে বলা কঠিন।
ভবানীপুরের উপনির্বাচনের লড়াইয়ে কংগ্রেস না থাকলেও আছে সিপিএম। বিজেপির সেটাই চিন্তার জায়গা। ভবানীপুরে বিজেপিকে সিপিএম টেক্কা দিয়ে বেরিয়ে যাবে, এমনটা নয়। কিন্তু সিপিএমের কিছুটা শক্তি বাড়ালেই চাপে পড়বে বিজেপি। আচমকা দিলীপ ঘোষকে সরিয়ে সেই চাপ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন অমিত শাহরা। এর আগেও একইভাবে নানা ইস্যু তৈরি করে প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করেছে বিজেপি।
২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে ১৮টি আসন পাওয়ার পর দিলীপ ঘোষকে নিয়ে কর্মী সমর্থকদের বাড়াবাড়ি বিজেপির প্রভাবশালীরা ভালো চোখে দেখেননি। সম্ভবত তখন থেকেই দিলীপবাবুকে টেনে নামানোর ব্লুপ্রিন্ট তৈরি শুরু। তাঁর ‘ডানহাত’ বলে পরিচিত সুব্রত চট্টোপাধ্যায়কে সংগঠন থেকে সরিয়ে দেওয়াটা ছিল সেই নীল নকশার প্রথম পদক্ষেপ। বাংলার ভোটেও তাঁকে গুরুত্বহীন করে রাখা 
হয়েছিল। প্রার্থী ঠিক করার ব্যাপারে তাঁর চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছেন ‘দলবদলু’ নেতারা। এমনকী, বিজেপি ক্ষমতা দখল নিশ্চিত বোঝাতে মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য চার চারজন সাংসদকে বিধানসভার টিকিট দেওয়া হয়েছিল। সেখানেও দিলীপ ঘোষের নাম ছিল না। মোদিজির মন্ত্রিসভায় বাংলায় তাঁর হাঁটুর বয়সি নেতারা জায়গা পেলেও 
তাঁর ঠাঁই হয়নি। এরপরেও যাঁরা দিলীপবাবুর সর্বভারতীয় সহ সভাপতি হওয়াকে প্রোমোশন বলছেন, তাঁরা বিদ্রুপ করছেন।
মুখ বদলে ‘মুখরক্ষা’ মোদি-অমিত শাহ জমানার নয়া কৌশল। গুজরাত থেকে বাংলা, সর্বত্র একই ট্রেন্ড। কেন্দ্রের ব্যর্থতার দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে মানুষকে বোকা বানানোর এই টেকনিক তাঁদেরই আমদানি। দিলীপ ঘোষকে সরিয়ে দিয়ে সুকান্ত মজুমদারকে বসানো তারই অঙ্গ। 
এভাবে দলের ভাঙন ঠেকানো যাবে কি না, বিভাজনের রাজনীতি চালিয়ে গিয়েও সুশীল সমাজকে পাশে পাবে কি না, সেটা সময়ের উপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। তবে, বঙ্গে বিজেপিকে প্রতিষ্ঠিত করার কাণ্ডারীর এই ‘ঘাড়ধাক্কা’ খাওয়াটা দলের আদিদের জন্য অশনি সঙ্কেত। ৩ থেকে ৭৭-এ পৌঁছে দিয়েও দিলীপ ঘোষ সম্মান পেলেন না। বঙ্গ বিজেপির ইতিহাসে তিনি ‘উপেক্ষিত নায়ক’ হয়েই থেকে গেলেন।

25th     September,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ