বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

মোদি জমানায় শিক্ষার গেরুয়াকরণ
মৃণালকান্তি দাস

বিজেপির ছাত্র সংগঠন ‘অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ’ এবং আরএসএস ঘনিষ্ঠ শিক্ষক সংগঠন ‘ভারতীয় শিক্ষণ মণ্ডল’ ছাড়া নাকি দেশে আর কোনও ছাত্র বা শিক্ষক সংগঠনের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
‘গণতান্ত্রিক’ পদ্ধতিতে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ রচনা করতে গিয়ে নাকি এমনই তথ্য মিলেছিল। গোটা প্রক্রিয়ায় মোদি সরকার দাবি করেছিল, দেশের ৬৭৬টি জেলার ৬৬০০ ব্লকের আড়াই লক্ষ গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে দু’লক্ষ মতামত তারা সংগ্রহ করেছে। অথচ, কস্তুরিরঙ্গন রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, যারা মতামত দিয়েছে তারা মুখ্যত প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও প্রতিষ্ঠান, নানা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। দেশের বাকি শিক্ষক–শিক্ষাবিদ–ছাত্র বা তাঁদের সংগঠনগুলির মূল্যবান মতামত ঠাঁই পেয়েছিল ডাস্টবিনে!
গেরুয়া অ্যাজেন্ডায় আটকে
২০১৭ সালের জুন মাসে ইসরোর প্রাক্তন প্রধান কে কস্তুরিরঙ্গনের নেতৃত্বে ‘খসড়া জাতীয় শিক্ষনীতি’ রচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। এই কমিটি ২০১৯ সালের ৩১ মে ‘খসড়া জাতীয় শিক্ষনীতি–২০১৯’ মন্ত্রীর কাছে জমা দেয়, যা ২০২০-র ২৯ জুলাই মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেয়ে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি–২০২০’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। মাঝে শুধু ১৯৯২ সালের ‘সামান্য সংশোধন’। সেটুকু সরিয়ে রাখলে, সেই ১৯৮৬ সালের পরে এই প্রথম নতুন শিক্ষানীতি ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। এর হাত ধরে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ফিরে গিয়েছে তার পুরনো নামে— শিক্ষা মন্ত্রক।
আমরা কী দেখছি? মৌলিক শিক্ষার পরিবর্তে কর্মমুখী শিক্ষার উপর জোর। মাধ্যমিক পরীক্ষার অবলুপ্তি। স্কুলে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সেমেস্টার। সংস্কৃত শিক্ষার উপর জোর। ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব হ্রাস। শিক্ষক–ছাত্র পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে পরিচালিত শ্রেণি–কক্ষ শিক্ষার পরিবর্তে অনলাইন শিক্ষার উপর জোর। কিছু স্কুল একত্র করে গুচ্ছ–স্কুল ব্যবস্থার প্রবর্তন। তিনটি অসম মানের বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি। ইউজিসি–এআইসিটিই প্রভৃতি ঐতিহ্যমণ্ডিত উচ্চশিক্ষার নিয়ন্ত্রক সংস্থার অবলুপ্তি ঘটিয়ে হায়ার এডুকেশন কমিশন নামে একটি সংস্থা তৈরি করা। ‘ভারতীয়ত্ব’ ও ‘ভারতীয় ঐতিহ্য’ প্রভৃতি হিন্দুত্ব–সুলভ আবেগে সুড়সড়ি দেওয়ার মতো শব্দের আড়ালে শিক্ষার গৈরিকীকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণের ঝোঁক। বর্তমান শিক্ষানীতিতে ত্রিভাষা ফর্মুলার মাধ্যমে ইংরেজিকে কেড়ে নিয়ে হিন্দিকে সুকৌশলে চাপানোর অপচেষ্টা করছে। বস্তা পচা কিছু যুক্তির আড়ালে হীন উদ্দেশ্যে সংস্কৃতকে পুনরায় চাপানোর চেষ্টা চলছে। 
এই শিক্ষানীতির পরিবর্তন কতটা হাল ফেরাবে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রের, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন শিক্ষামহলেরই একাংশ। নতুন শিক্ষা নীতি ঘোষণার দিনেই ট্যুইটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দাবি ছিল, এটি বদলে দেবে লক্ষ লক্ষ পড়ুয়ার জীবন। তাঁর দাবি, এই নীতিই হবে বিশ্বের দরবারে ভারতের শীর্ষে ওঠার সিঁড়ি। অথচ, শিক্ষাবিদদের খটকা, তার জন্য জরুরি শিক্ষায় সরকারি বরাদ্দ বৃদ্ধি। অথচ, কেন্দ্র ও সব রাজ্যের মিলিত বরাদ্দ ৫২ বছর ধরে আটকে আছে জিডিপির ৬ শতাংশের নীচে। মোদি জমানায় কেন্দ্রীয় বরাদ্দ ০.৫৩ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ০.৪৪ শতাংশে! বিরোধীদের অনেকেই বলছেন, মোদি সরকার আসলে শিক্ষার বিদেশিকরণ, বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যকরণের রাস্তা প্রসারিত করেছে। যার পকেটে রেস্ত, সে—ই পাবে শিক্ষা।
প্রাথমিক শিক্ষার সর্বনাশ
এখন সরকারি নিয়মে বিদ্যালয় স্তর ৬ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু হয় এবং ১০+২ বা ১২ বছরে তা শেষ হয়। দশমের পর মাধ্যমিক এবং দ্বাদশের পর উচ্চমাধ্যমিক হিসেবে দু’টি বোর্ডের পরীক্ষা হয়। প্রথম শ্রেণির আগে নার্সারি বা প্রি–স্কুল গ্রামে সরকারিভাবে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত। নতুন নীতিতে (১০+২)–র পরিবর্তে (৫+৩+৩+৪) প্রথা প্রবর্তন করা হচ্ছে। এর ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের সঙ্গে। পড়ুয়া প্রথম ৩ বছর প্রি-প্রাইমারির পরে ২ বছর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি অঙ্গনওয়ারিতে পড়বে। এই হল তাদের প্রথম ৫। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাস নেওয়ার যোগ্যতামান না থাকলেও অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের কর্মী বা সহায়িকাদের উপরই পড়ানোর দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে নাকি পড়ুয়ার ভিত তৈরি হবে! এর ফলে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলো, যা এমনিতেই অর্থাভাবে ধুঁকছে, সেগুলি আরও বিপর্যস্ত হবে। সর্বনাশ হবে আগামী প্রজন্মের।
যে সেমেস্টার প্রথা কলেজ স্তরে এই মুহূর্তে আছে তা বহুল সমালোচিত। তার প্রতি কর্ণপাত না করে সরকার সেই প্রথাকে বিদ্যালয় স্তরে প্রবর্তন করতে চাইছে কী কারণে? বুনিয়াদি শিক্ষার বুনিয়াদটাই তো নড়বড়ে হয়ে যাবে। দশম শ্রেণিতে মাধ্যমিক হিসাবে যে বোর্ডের পরীক্ষা আছে এবং যে পরীক্ষায় পাশ করলে সার্টিফিকেট পাওয়া যায় তার অবলুপ্তি ঘটানো হয়েছে। মাধ্যমিক–পাশ এ দেশে সরকারি-বেসরকারি নানা চাকরি পাওয়ার একটা যোগ্যতামান। দশম শ্রেণির পর বোর্ড পরীক্ষার অবলুপ্তি ঘটিয়ে বিদ্যালয় স্তরের শেষ পরীক্ষা দ্বাদশে নিয়ে যাওয়ার ফলে দু’ধরনের বিপত্তি তৈরি হবে। দশমের পর বহু ছাত্রের ‘ড্রপ–আউট’ হবে এবং যারা টিকে থাকবে তাদের আরও দু’বছর অপেক্ষা করতে হবে এই শংসাপত্র পাওয়ার জন্য। 
বহু প্রশ্নের উত্তর নেই
বর্তমান শিক্ষানীতিতে গ্রামে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি অন্তর্ভুক্তির ফলে সরকার পোষিত বুনিয়াদি শিক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হবে। স্বভাবতই বিত্তশালী পরিবারগুলি বেসরকারি স্কুল বেছে নেবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কর্পোরেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রমরমা বাড়বে। ‘বহুত্ববাদিতা’, ‘বৈচিত্র্য’ প্রভৃতি মূল্যবোধের শিক্ষা পড়ুয়াদের দেওয়া হবে। এসব বলতে বলতেই এই শিক্ষানীতি বহুজাতি, বহুভাষী, বহুসংস্কৃতির দেশে এক পাঠ্যবিষয়, এক পরীক্ষা, এক প্রবেশিকা পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর জোর দেওয়ার প্রতিশ্রুতির কথা যখন আওড়াচ্ছে তখন শিক্ষা যে যুগ্ম তালিকায় আছে তা তারা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছে। ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ’-এর শিক্ষা ছাত্রদের দেবে যখন বলছে তখন সংসদ এড়িয়েই জাতীয় শিক্ষানীতি চূড়ান্ত করে ফেলেছে।
প্রধানমন্ত্রীর দাবি, এই নীতি প্রণয়নের অন্যতম লক্ষ্য, মুখস্থবিদ্যা-নির্ভর পড়াশোনা থেকে মুক্তি। অন্যের পছন্দের বিষয় নিতে বাধ্য না-হয়ে নিজের মনের কথা শোনার সুযোগ। ভালো লাগলে, অঙ্কের সঙ্গে সঙ্গীতের চর্চা। যাতে তৈরি হয় যুক্তিবাদী, প্রশ্নমুখর মন। প্রতিবাদী পড়ুয়াদের প্রশ্ন, যুক্তির জায়গা থেকেই তো সিএএ-এনআরসির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা। তা হলে সেই প্রতিবাদকে দুরমুশ করার এত চেষ্টা কেন?
মোদির মতে, এই নীতির হাতিয়ার একুশ শতকের প্রযুক্তি। যার ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা চাকরি প্রার্থী না-হয়ে নতুন কাজের সুযোগ তৈরি করবেন। কিন্তু বিরোধীদের কটাক্ষ, প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিকাঠামোই যে সকলের নেই, প্রধানমন্ত্রী তা কি জানেন? ইংরেজির ভিত নড়বড়ে হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও করছেন অনেকে। মূল্যবোধের শিক্ষা তাঁরাই দিতে পারেন যাঁরা নিজেরা সততার সঙ্গে তার চর্চা করেন। বিজ্ঞানভিত্তিক মননের জন্ম তাঁরাই দিতে পারেন যাঁরা সর্বপ্রকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তা এবং অনৈতিহাসিক ভাবনা-ধারণা থেকে মুক্ত। এই শিক্ষানীতিতে ছাত্রমনকে ‘বিজ্ঞান ও যুক্তি নির্ভর’ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। সাংবিধানিক পদমর্যাদাসম্পন্ন নানা ব্যক্তির মুখনিঃসৃত বাণী শুনছি যে, ‘মহাভারতের যুগে ইন্টারনেট’, ‘ডারউইন তত্ত্ব ভুল’, ‘বেদের যুগে এরোপ্লেন’ ইত্যাদি। সেই তাঁরাই ছাত্রদের বিজ্ঞানসম্মত মনন বিকাশের দায়িত্ব নেবেন? সন্দেহ তো জাগবেই।
ভারতীয় সংবিধান মতে, শিক্ষা যৌথ তালিকার অন্তর্গত, এখনও। তবে কীভাবে কোনও রাজ্যের বিশেষজ্ঞদের মতামত ছাড়াই সেই রাজ্যের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার রূপরেখা তৈরি হয়? কেন্দ্রীয় নীতি ঘোষিত হওয়ার পর একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করেছিল পশ্চিমবঙ্গও। আপত্তির স্থানগুলি চিহ্নিত করে কেন্দ্রের কাছে রিপোর্টও পাঠিয়েছিল। কিন্তু আপত্তি না শুনেই যদি নীতি প্রযুক্ত হয়, তবে সব পদ্ধতি, সব কমিটিই অর্থহীন। উল্টে রাষ্ট্রীয় শিক্ষা আয়োগ গঠনের আড়ালে সমগ্র পরিচালন ব্যবস্থাটিকে কেন্দ্রীয় সরকার কুক্ষিগত করতে চাইছে।
কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল নিশঙ্ক জানিয়ে দিয়েছেন, দেশের স্বার্থে শিক্ষায় সংস্কার চালু করার বিষয়ে আর বিলম্ব চলবে না। কীসের স্বার্থ? কাদের স্বার্থরক্ষার কথা ভাবছে মোদি সরকার? বিপদগ্রস্ত সময়ে বিপদের মীমাংসার চেষ্টায় না গিয়ে তাড়াহুড়ো করে নয়া নীতির প্রয়োগই দেশের স্বার্থরক্ষার প্রকৃষ্ট উপায়? দেশের নাগরিককে কি শিক্ষামন্ত্রী অবোধ শিশু ভাবেন?

16th     September,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ