বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

ভবানীপুরের খেলা ও বামেদের
ফের ঐতিহাসিক ভুল
হিমাংশু সিংহ

মমতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে সার কথাটা বলে দিয়েছেন অশীতিপর বৃদ্ধ বাদল চট্টোপাধ্যায়। বাদলবাবু দীর্ঘদিনের বামপন্থী রাজনীতি করা লোক। দক্ষিণ কলকাতার সিপিএম মহলে পরিচিত মুখ। তিনি বুঝেছেন, এই মুহূর্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রার্থী দেওয়া মানে ঘুরপথে বিজেপিরই হাত ধরা, যা এ রাজ্যের মানুষের জনমতের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। মানুষের সামনে আর একবার প্রমাণ করা রাম বাম এক! বিশেষ করে কয়েক মাস আগের হাড্ডাহাড্ডি ভোটে বামপন্থীদের ছদ্ম সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি দেওয়া জোটকে বাংলার মানুষ যেভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে, তারপর তো বটেই। গত বিধানসভা নির্বাচনের দেওয়াল লিখনও একটাই, ‘নো ভোট টু বিজেপি’। হিন্দু মুসলিম নারী পুরুষ বাঙালি অবাঙালি সমস্তরকম নিকৃষ্ট বিভাজনের চেষ্টাকে হারিয়ে বাঙালির মন নিজের ঘরের মেয়ের কাছেই সুরক্ষিত আছে! প্রমাণ হয়ে গিয়েছে এই বাংলার ভোটের গন্তব্য অনিবার্যভাবে নেত্রীর কালীঘাটের কুটিরের দিকে ধাবমান। আগামী চব্বিশ সালের লোকসভা ভোটের আগে যে কোনও বিজেপি বিরোধী দলের কাছে যা আশীর্বাদ। কার্যত বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানুষ আর বামপন্থীদের একটুও বিশ্বাসযোগ্য মনে করে না বলেই বিগত বিধানসভা ভোটে লাল পার্টির ভরাডুবি হয়েছে। শুধু ভরাডুবি নয়, একটা আসনও জিততে না পারার কলঙ্ক তাড়া করে ফিরছে একদা সুসংগঠিত রাজ্য কাঁপানো দলটাকে। 
অশক্ত শরীরে অশীতিপর বামপন্থী মানুষটা যা বুঝেছেন, তা মরমে পৌঁছয়নি আলিমুদ্দিনের পোড় খাওয়া কর্তাদের। হার প্রায় নিশ্চিত জেনেও খামোকা গোঁ আর জেদের বশে তাঁরা অকিঞ্চিৎকর প্রার্থী খাড়া করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে অসম্মান না জানিয়েই প্রশ্ন করি, কাজটা কি ঠিক হল? এখন যেমন আলিমুদ্দিন বুঝতে পারছে গত বিধানসভা ভোটে একইসঙ্গে কংগ্রেস ও ভাইজানের সঙ্গে জোট করা ভুল হয়েছিল, তেমনি ভবিষ্যতেও আবার ভুল ভাঙবে। হয়তো পরবর্তী কোনও রাজ্য কমিটির বৈঠকে সেই ভুল বুঝতে পেরে ঘটা করে তা স্বীকারও করবে নেতৃত্ব। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে। 
আমাদের মনে আছে, ব্রিগেডের সভায় যখন ভাইজান মঞ্চে উঠেছিলেন সেই বিড়ম্বনাময় মুহূর্তটার কথা। সেই দুপুরটায় ফিরলে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখি, অকস্মাৎ হইহুল্লোড়ে ভাষণ থামিয়ে দিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। দৃশ্যতই বিরক্ত তিনি। অপমানিতও। বিমানবাবু তাঁকে প্রাণপণ শান্ত করছেন। আর কিছু অতি উৎসাহী নেতা তারমধ্যেই ভাইজানকে তোল্লাই দিচ্ছেন। ভাবটা এমন আবার সংখ্যালঘু ভোট বামেদের ঘরে ফিরল, দ্যাখ কেমন লাগে! কিন্তু তখন কে জানত, ব্রিগেডের ভরা 
সমাবেশ নিষ্ফলাই থেকে যাবে। উল্টে দলকে 
জোটের ভুল প্রকাশ্যে স্বীকার করতে হবে। আগামী চব্বিশের দিল্লির কুর্সি দখলের লড়াই যত জমাট 
বাঁধবে মমতার উপর মহাজোটের নির্ভরতাও বাড়বে। তখন বিমান সূর্যকান্তদের আবার ঘটা করে স্বীকার করতে হবে ভবানীপুরে মমতার বিরুদ্ধে প্রার্থী দেওয়াও মস্ত ভুল ছিল! কারণ দেশব্যাপী গেরুয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তিনিই আপসহীন মুখ। আর এই মুহূর্তে জাতীয় রাজনীতির লড়াইটাই যে আরএসএস বনাম অবশিষ্ট সব রাজনৈতিক শক্তির তা কি বামেদের অজানা?
কয়েক সপ্তাহ আগেই লিখেছিলাম, সিপিএমের রাজনীতির বর্তমান ভরাডুবির কারণ বিবিধ। প্রথমত, রাষ্ট্রশক্তি ও পুলিসকে ব্যবহার করে দীর্ঘদিন এ রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা। একদিন যেটা ছিল সাফল্য, আজ তাই অভিশাপ হয়ে ফিরে এসেছে। পুলিস আর প্রশাসন কাজে লাগিয়ে সংগঠনের কঙ্কাল ঢেকে রাখার বিষময় ফল এখন নেতারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে, ঠিক সময়ে ঠিক শত্রু চিনে নিতে ভুল করা। কংগ্রেস ও বিজেপিকে একাসনে বসিয়ে সমদূরত্বের রাজনীতি ভাবের ঘরে চুরি ছাড়া আর কিছুই নয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, আকস্মিক 
বুদ্ধবাবুর শিল্প আহ্লাদ ও সিঙ্গুরে জমি কেড়ে নেওয়ার হঠকারী সিদ্ধান্ত। যদি বলি জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দেওয়া যেমন ঐতিহাসিক ভুল ছিল, তার চেয়েও আরও কয়েকগুণ বড় ‘ব্লান্ডার’ ছিল পরমাণু চুক্তি নিয়ে মনমোহনের সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করা, খুব কি আপত্তি হবে? কিংবা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় যিনি দলের দুর্দিনেও দিল্লিতে ঘাঁটি আগলে রেখেছিলেন বহু যুগ, তাঁকে জীবনের শেষ পর্বে ওভাবে বহিষ্কার করা। এ তো দলকেই দুর্বল করা, ঘুরিয়ে দলের পায়ে কুড়ুল মারা। সোমনাথবাবু 
কিংবা জ্যোতিবাবুর মতো সব দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ওয়াকিবহাল, জাতীয় স্তরে সমীহ আদায় করা নেতা আজ আর সিপিএমে আছে নাকি! এভাবেই একের পর এক সিদ্ধান্ত পার্টির অস্তিত্বের শিকড়েই আঘাত করেছে। আর তাত্ত্বিকরা কেন্দ্রীয় কমিটি 
আর পলিটব্যুরোতে ঝড় তুলে বুক ফুলিয়েছেন। আসলে কমিউনিস্ট পার্টিতে সুসময়ে বিপ্লব মানে দলেরই কমরেডদের একাংশকে চুপ করিয়ে রাখা, একঘরে করা। মানুষের থেকে এভাবেই দূরে সরে 
যায় পার্টি। ক্ষমতা গেলে মালুম হয় অনেক আগেই জনভিত্তিটা নড়ে গিয়েছিল, দাম্ভিক নেতৃত্ব তা টের পেতে দেয়নি!
শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেস সাংগঠনিকভাবে আগোছালো দুর্বল একটা দলে পরিণত হলেও বিলক্ষণ বুঝতে পারছে, আগামী লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদিকে আটকাতে গেলে একটা সার্বিক মহাজোট দরকার। আর এই মুহূর্তে জাতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী জোট করতে গেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া কোনওমতেই তা সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে বিরোধী জোট গড়তে হলে মমতাই হবেন তার নিশ্চিত নিউক্লিয়াস। এককাট্টা হয়ে শপথ নিতে হবে শারদ পাওয়ার থেকে অখিলেশ, লালুপুত্র হয়ে দক্ষিণের স্ট্যালিন, সবাইকে। সোনিয়া গান্ধী তা ষোলোআনা অনুভব করেছেন বলেই অধীরবাবুরা একটু নিমরাজি থাকলেও ভবানীপুরে প্রার্থী দেওয়া থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। মুখে না বললেও হাইকমান্ডের ইঙ্গিত স্পষ্ট। বর্তমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ভবানীপুরে সর্বস্তরের কংগ্রেসি এবার ভোটটা মমতাকেই দিন। আগেই নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দিয়েছে, কেন দেশের আর কোথাও উপনির্বাচন না করে তারা শুধু ভবানীপুরকে বেছে নিয়েছে। সেখানেও ইঙ্গিত সাফ। কারণ না হলে দেশেরই একটা অঙ্গরাজ্যে সাংবিধানিক সঙ্কট উপস্থিত হবে। মুখ্যসচিবের অনুরোধে দেশের নির্বাচন কমিশনের এভাবে সিলমোহর দেওয়ার প্রধান কারণ গত বিধানসভা ভোটের স্পষ্ট জনাদেশ। আট দফার ঐতিহাসিক নির্বাচন, রেকর্ড সংখ্যক কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং করোনা বিধি উপেক্ষা করে এক মাসের বেশি সময় ধরে ভোট করিয়েও যাঁকে হারানো যায় না, সমগ্র রাজ্য যাঁকে মুখ্যমন্ত্রী দেখতে চায়, তাঁকে রোখে কার সাধ্য। 
২৯৪-টির মধ্যে ২১৩টি আসনে মানুষ তৃণমূলকে জিতিয়েছে তাঁকে দেখেই। সবকটি আসনে তিনিই ছিলেন প্রার্থী। বিমানে চেপে দুপুরে নেমে ক্ষমতা আর টাকার ধুলো উড়িয়ে সন্ধ্যায় পালিয়ে যাননি। তাঁর এই ভাঙা পায়ের খেলা দেখেই মোদি-অমিত শাহের নৌকোয় আশ্রয় নেওয়া দল ভাঙা নেতারাও পুরনো জায়গায় ফিরতে ২ মে থেকে নাকি কান্না কাঁদছেন। তার ফলেই তৃণমূলের বিধায়ক সংখ্যা রোজ বাড়ছে! পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে রাজ্যের মানুষ ঠিক কী চায়? এর মধ্যে হঠাৎ প্রার্থী দিয়ে বামপন্থীরা ২ মে’র জনাদেশকেই অসম্মানিত করার সস্তা প্রয়াস করেছে। এই বয়সে পৌঁছেও এখনও বিমানবাবুরা গোলপোস্ট চিনতে ভুল করছেন, দুঃখটা সেই কারণেই।
বামেরা ভুল করলেও গোলপোস্টটা চিনতে কিন্তু ভুল করেননি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সতীর্থ নেতারা। গত দু’মাসেই বিজেপির মতো ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক দলের সঙ্গে লড়াইয়ে ত্রিপুরায়  ইতিমধ্যেই শক্ত লড়াই গড়ে তুলেছে মমতার দল। যাঁরা উঠতে বসতে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে কংগ্রেসের, ইন্দিরা জমানার বাপান্ত করে তাঁদের হাতেই প্রতিদিন লাঞ্ছিত প্রহৃত হচ্ছেন বিরোধী দলের নেতারা। হামলা নেমে এসেছে খোদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রাত্য বসুদের উপরও। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে সিপিএমের কার্যালয়ে। সব মিলিয়ে ভয়ঙ্কর ছবি। বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করার যাবতীয় চেষ্টা সম্পূর্ণ। রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে এই নির্ণায়ক যুদ্ধ আলাদা আলাদাভাবে লড়া সম্ভব নয়। ত্রিপুরায় আগামী ভোটে গেরুয়া ঠ্যাঙারে বাহিনীকে রুখতে গেলে বামপন্থীদের হাত মেলাতেই হবে তৃণমূলের সঙ্গে। বেরিয়ে আসতে হবে ছুৎমার্গ ভেঙে। না হলে সেমসাইড গোলের সুবাদে অক্সিজেন পেয়ে যাবে সঙ্ঘ পরিবার ও তার বশংবদেরা। তাই এখন থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে এ কে গোপালন ভবনের সিপিএম নেতৃত্বকে।
ঠিক এই পটভূমিতে দাঁড়িয়েই ভবানীপুরে খেলা হবে। বিধানসভা ভোটে তিনি একপায়ে খেলা দেখিয়েছেন। ভবানীপুরে গোটা বাংলা তাঁর দু’পায়ের খেলা দেখার জন্য তৈরি। ৩০ সেপ্টেম্বর ভোট এবং ফল ৩ অক্টোবর। দেবীপক্ষ শুরুর ৭২ ঘণ্টা আগে। দেশ চায় ভবানীপুরের জয়ের দ্যুতি ছড়িয়ে একটা শক্তিশালী মোদি বিরোধী জোট আত্মপ্রকাশ করুক। কৃষক-শ্রমিক-খেটে খাওয়া মানুষ, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগপতি থেকে শুরু করে সরকারি কর্মীরা বঞ্চনার জবাব দিতে আগামী নির্বাচনে বিজেপি সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াক। রুখে দাঁড়ান মহিলারা। বাংলার অগ্নিকন্যার নেতৃত্বে তা সম্ভব হলে বাকিটা তো ইতিহাস হয়ে যাবে। এবারের পুজোয় মহাশক্তির আরাধনা তাই সমগ্র বিরোধী দলের একজোট হয়ে লড়াইয়ের শপথ নেওয়ার সময়।

12th     September,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ