বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

ব্যুমেরাং হবে বিজেপির
‘প্রেসার পলিটিক্স’
তন্ময় মল্লিক

ডিভাইড অ্যান্ড রুল। জনবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক দলের সরকার চালানোর এটাই সর্বাধিক জনপ্রিয় কৌশল। এই পলিসিতেই হাতে গোনা কয়েকজন ইংরেজ ভারতবর্ষের মতো একটা বিশাল দেশকে যুগ যুগ ধরে শাসন করেছিল। বিজেপির রাজ্যপাট চালানোর মূল ভিত্তি সেই বিভাজনের রাজনীতিই। কিন্তু বিরোধীদের শায়েস্তার জন্য অতিমাত্রায় কেন্দ্রীয় এজেন্সি ব্যবহারের ফল হচ্ছে উল্টো। সিবিআই, ইডি-র চাপে বিরোধীরা এখন অনেক কাছাকাছি। চাপ দিলে দু’টি বরফের টুকরো এক হয়। পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায়, পুনঃশিলীভবন। বিজেপির ‘প্রেসার পলিটিক্সে’ জাতীয় রাজনীতির সমীকরণেও কি ‘পুনঃশিলীভবন’ ঘটতে চলেছে? অনেকে বলছেন, ভবানীপুরের উপনির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের প্রার্থী না দেওয়া তারই ইঙ্গিত।
রাজনীতিতে একটা কথার খুব চল আছে, বাঘের পিঠে চড়ে বসা। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বাঘের পিঠে চড়ে বসাই রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতা ধরে রাখার এটাই সহজতম পথ। একই সঙ্গে খুব বিপজ্জনকও বটে। কারণ একবার বাঘের পিঠে চাপলে আর নামা যায় না। আবার দীর্ঘক্ষণ বাঘের দাপট সহ্য করাও কঠিন। তবে পিঠ থেকে নামলে সকলকেই যেতে হয় বাঘের পেটে। 
বাম জমানার শেষদিকে জনবিচ্ছিন্ন সিপিএমও এরাজ্যে ক্ষমতায় থাকার নেশায় বাঘের পিঠে চড়ে বসেছিল। ভেবেছিল, পুলিস আর মাসল পাওয়ার দিয়ে বিরোধীদের দুরমুশ করেই ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে। তাই প্রতিবাদ হলেই পুলিস আর হার্মাদ দিয়ে মোকাবিলার চেষ্টা করত। ক্ষোভের কারণ অনুসন্ধান অপেক্ষা দমনেই ছিল বেশি আগ্রহ। তাই দিকে দিকে তৈরি হয়েছিল সশস্ত্র হার্মাদ ক্যাম্প। এতকিছু করেও সিপিএম ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। তারা এখন শূন্য। ৩৪ বছরের রেকর্ড সৃষ্টিকারী শাসক দলকে শূন্যে নামিয়ে আনতে রাজ্যবাসী সময় নিয়েছে মাত্র দশটি বছর। তবে, এসব দেখেও রাজনৈতিক নেতাদের শিক্ষা হয় না। তাই একই ভুল হয় বারবার।
দিল্লির বিজেপির নেতারা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সেই বাঘের পিঠেই চড়ে বসেছেন। একের পর এক রাজ্যে হেরে চলেছে। তাই ২০২৪ সালে দেশ চালানোর সার্টিফিকেট পুনর্নবীকরণ হবে কি না তা নিয়ে ঘোর দুশ্চিন্তায় রয়েছে গেরুয়া শিবির। বাংলার নির্বাচনে নাস্তানাবুদ হওয়ায় সেই অনিশ্চয়তা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। তাই ক্ষমতায় টিকে থাকতে দেশজুড়ে চলছে বিরোধীদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা। সিবিআই, ইডির মতো এজেন্সিকে যথেচ্ছভাবে কাজে লাগানোর অভিযোগ দিন দিন তীব্র হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, এর আগে দিল্লির কোনও সরকার এত নির্লজ্জভাবে কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে ব্যবহার করেনি। বিজেপির বিরুদ্ধে মাথা তুললেই মেরে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আর লড়াইয়ে এঁটে উঠতে না পারলে আছে ইডি কিংবা সিবিআই। 
তৃণমূলের নজর এখন ত্রিপুরায়। আর তাতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছে বিজেপি। ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কায় এখন থেকেই সেখানে তৃণমূলের উপর চলছে লাগাতার আক্রমণ। তৃণমূল মাটি কামড়ে পড়ে থাকায় সিপিএম, কংগ্রেস ছেড়ে ঘাসফুল শিবিরে যোগদানের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। নির্ভরযোগ্য বিকল্প তৈরি হওয়ায় বিজেপিতেও মাথাচাড়া দিচ্ছে বিদ্রোহ। তৃণমূল দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করায় সিপিএমও জমি ধরে রাখতে নেমেছে রাস্তায়। ফলে তারাও বিজেপির হামলার মুখে পড়ছে। একের পর এক সিপিএম অফিস জ্বলছে। বাদ যায়নি সংবাদপত্রের অফিসও। এমন ঘটনার পরেও নেই কোনও অনুতাপ বা দুঃখ প্রকাশ। উল্টে বিজেপির দাম্ভিক আস্ফালন, ‘এটা জনরোষের ট্রেলার।’ এর অর্থ, এমন ঘটনা ঘটবে আরও অনেক।
ত্রিপুরায় সিপিএম ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বুলডোজার দিয়ে লেনিনের মূর্তি মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল বিজেপি। তারপরেও বাংলার সিপিএম নেতাদের ঘুম ভাঙেনি। তখনও তাঁদের চোখে তৃণমূল কংগ্রেসই ছিল প্রধান শত্রু। ত্রিপুরায় পঞ্চায়েতের ৯৪ শতাংশ আসন বিজেপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল নেওয়ার পরেও বাম নেতাদের সম্বিত ফেরেনি। উল্টে এরাজ্যে নিয়েছিল কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার কৌশল। মমতাকে হারাতে শুরু হয়েছিল নতুন ক্যাম্পেন, ‘একুশে রাম, ছাব্বিশে বাম।’ তার পরিণতি সকলেরই জানা। প্রায় গোটা দলটাই বিজেপিতে চলে গিয়েছে। ত্রিপুরায় রাজ্য পার্টি অফিস জ্বলার পর আলিমুদ্দিনের ম্যানেজাররা কি বিজেপি আর মমতা শাসনের ফারাকটা  বুঝতে পারছেন? নাকি এরপরেও জারি থাকবে তাঁদের জেগে ঘুমানো কর্মসূচি?
সিপিএমের সুজন চক্রবর্তী, মহম্মদ সেলিমরা না বুঝলেও সোনিয়া গান্ধী বুঝেছেন। তাই তিনি ভবানীপুরে মমতার বিরুদ্ধে কংগ্রেসের কোনও প্রার্থী দিচ্ছেন না। ভবানীপুরে কংগ্রেসের কত শতাংশ ভোট আছে, তাঁদের কতজন চড়া রোদ উপেক্ষা করে মমতাকে সমর্থন জানানোর জন্য ভোটের লাইনে দাঁড়াবেন, সেটা বড় কথা নয়। আসল কথাটা হল, সদিচ্ছা। বিজেপি বিরোধিতার ক্ষেত্রে সোনিয়া যে কোনও ফাঁক রাখতে রাজি নন, সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তাই রাহুল গান্ধীর বৈঠকে তৃণমূল না যাওয়ায় বিজেপি বিরোধী ঐক্যে ফাটল নিশ্চিত ভেবে যাঁরা নৃত্য জুড়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা সোনিয়ার সিদ্ধান্তে রীতিমতো মুষড়ে পড়েছেন।
এই মুহূর্তে দেশে মোদি বিরোধিতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ত্রিসীমানায় কেউ নেই। তাঁকে কোনও রকমে আটকে দিতে পারলেই মোদি সরকারের হ্যাটট্রিকের পথ হবে প্রশস্ত। সেজন্য যে কোনও মূল্যে মমতা ও অভিষেককে আটকাতে চাইছে বিজেপি। তবে সে কাজে কতটা সফল হবে, তা বলা কঠিন। কারণ বাংলায় বিধানসভা নির্বাচনে মোদি-অমিত শাহ জুটির সমস্ত কৌশল মাঠে মারা গিয়েছে। তাঁরা ‘পিসি-ভাইপো’কে আক্রমণ করেই ফায়দা তুলতে চেয়েছিলেন। কারণ তাঁরা ভেবেছিলেন, মমতা আর অভিষেককে কটাক্ষ করলেই বিদ্রুপের নীচে চাপা পড়ে যাবে গ্যাস, পেট্রল, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিকে ঘিরে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ। কিন্তু, বাজিমাত করেছে পিসি-ভাইপো জুটিই।
বাংলার নির্বাচনে ঘাড়ধাক্কা খাওয়াটা বিজেপির চাণক্য কিছুতেই হজম করতে পারছেন না। তাই বঙ্গের নির্বাচনের আগে যা ছিল শুধুই অভিযোগ, এখন তাকে আইনি স্বীকৃতি দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। নির্বাচনের আগেই কয়লা পাচার কাণ্ডে অভিষেকের স্ত্রীকে জেরা করেছিল ইডি। এবার সরাসরি অভিষেক।
নির্বাচনী প্রচারে আঙুল তোলা আর তাঁকে ইডির ডেকে পাঠানোর মধ্যে বিস্তর ফারাক। এতদিন ঢিলটা ছিল বিজেপির হাতে। মারব, মারব বলে ভয় দেখাত। কিন্তু এবার ঢিলটা ছুঁড়ে দিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, ইডি বা বিজেপির হাতে অভিষেকের বিরুদ্ধে তেমন কোনও অকাট্য প্রমাণ নেই। তাই নির্বাচনের আগে বেশিরভাগ বিজেপি নেতা তাঁর নাম নেওয়ার সাহস পেতেন না। ভাইপো, ভাইপো বলে চালিয়ে গিয়েছেন।
অভিষেকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে তা সঠিক নাকি মিথ্যে, সেটা এবার ইডিকেই প্রমাণ করতে হবে। প্রমাণ প্রকাশ্যে আনার আগেই ইডি বা সিবিআই অ্যাকশন নিলে বিজেপির ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’র তত্ত্ব আরও জোরদার হবে। প্রশ্ন উঠবেই, ক্যামেরার সামনে যাঁরা টাকা নিলেন তাঁরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন না কেন? আর ইডি যদি দোষ প্রমাণ করতে না পারে, তাহলে নিশ্চিত করে বলা যায়, অভিষেকই হবেন জাতীয় রাজনীতির অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র।
ইডি দিল্লিতে ডেকে পাঠানোর পর অনেকেই ভেবেছিলেন, অভিষেক হাজিরা এড়িয়ে যাবেন অথবা আদালত থেকে ‘রক্ষাকবচ’ জোগাড়ের চেষ্টা করবেন। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটেনি। উল্টে ইডির মুখোমুখি হওয়ার জন্য দিল্লি উড়ে গিয়েছিলেন। তিনি খুব ভালো করেই জানেন, জাতীয় স্তরে বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য দিল্লিই আদর্শ প্ল্যাটফর্ম। সেই প্ল্যাটফর্মকেও তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছেন। টানা ৯ ঘণ্টা ইডির বাঘা বাঘা অফিসারদের চোখা চোখা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পরেও টিভির পর্দায় তাঁকে একটুও ক্লান্ত মনে হয়নি। উল্টে তাঁর গলায় শোনা গিয়েছে বাঘের গর্জন, ‘প্রমাণ থাকলে জনসমক্ষে নিয়ে আসুন।’ হ্যাঁ, একেই বলে ‘চ্যালেঞ্জ’।
নির্বাচনের সময় সরাসরি অমিত শাহকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে অভিষেক বলেছিলেন, ‘ক্ষমতা থাকলে আমাকে গ্রেপ্তার করে দেখাক।’ সিবিআই তা করতে পারেনি। দিল্লিতে ইডির দপ্তরে ৯ ঘণ্টা কাটানোর পর ফের তাঁর হুঙ্কার, ‘প্রমাণ থাকলে জনসমক্ষে নিয়ে আসুন।’ মানুষও সেটাই চায়। কেউ অন্যায় করলে তার একবার নয়, হাজারবার শাস্তি হোক। তবে বিচার করে শূলে চড়ানোটাই নিয়ম। কিন্তু রাজনীতিতে? আগে শূলে চড়িয়ে দাও। তারপর হবে বিচার। তাই বছরের পর বছর চলতে থাকে তদন্ত। তবে, এবার তদন্তের কাজ দ্রুত শেষ করে ফেলাই ভালো। কারণ পাশা যে কখন ওলটায় কেউ বলতে পারে না।

11th     September,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ