বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

মোদির ভারতে প্রাইভেট ব্যবস্থার জয়গান
সমৃদ্ধ দত্ত

সঞ্জয় গান্ধী কি সত্যদ্রষ্টা ছিলেন? তিনি সত্তরের দশকে বুঝেছিলেন, ভারতবাসী ক্রমেই পাল্টে যাবে। সে হয়ে পড়বে আত্মকেন্দ্রিক। পরিবার নয়, সমষ্টি নয়, ব্যক্তিবৃত্ত হবে সমাজের চরিত্র। সঞ্জয় গান্ধী নিজে দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু তাঁর স্বপ্নের প্রজেক্ট আশির দশকের শুরুতেই বাস্তবায়িত হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল। সেটি আসলে কোনও প্রজেক্ট ছিল না। ছিল একটি সামাজিক আইডিয়া। আইডিয়ার নাম মারুতি। আশির দশকে ভারতে মারুতির আগমন ঘটেছিল একটি বিশেষ নাম নিয়ে। নামটি হল ‘ফ্যামিলি কার’। ছোট্ট একটি গাড়িকে ‘ফ্যামিলি কার’ বলার পিছনে যে মনস্তত্ত্বটি সেই সময় থেকে ক্রমেই ভারতীয় সমাজের মধ্যে প্রবেশ করল, তা হল, ফ্যামিলি মানে আসলে স্বামী স্ত্রী ও সন্তান। একটি অথবা দুটি। এই তিন চারজনের জন্য ওই ফ্যামিলি কার আদর্শ। অর্থাৎ তখন থেকেই ‘ফ্যামিলি’ শব্দটির দৃশ্যপট থেকে ধীরে ধীরে বিযুক্ত হতে শুরু করল একান্নবর্তী পরিবারের বাকিরা। অর্থাৎ মা, বাবা, দাদা, দিদি, পিসি, জ্যাঠা, কাকা নয়। পরিবার মানে আমরা চারজন। মারুতি নামক ফ্যামিলি কারে স্বামী স্ত্রী সন্তান ছাড়া আর কারও জায়গা হবে না। একই সঙ্গে ভারতে প্রবল জনপ্রিয় হল ফ্যামিলি কার এবং ফ্ল্যাট কালচার। একইসঙ্গে ভারতে পিছিয়ে পড়তে শুরু করল জয়েন্ট ফ্যামিলি এবং অ্যামবাসাডর গাড়ি। 
অ্যামবাসাডর গাড়ি আসলে ছিল একটি একান্নবর্তী পরিবার। সেখানে কখনও কখনও ৮ জনও ঢুকে পড়েছে। ফ্যামিলি কার, ফ্ল্যাট ইত্যাদি সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার পিছনে একটি কারণ পরোক্ষে কাজ করেছে। সেটি হল প্রাইভেসি। ভারতের আপার ও মিডল ক্লাস প্রাইভেট হতে চাইল। তাই অ্যামাবাসাডর গাড়ি পরবর্তীকালে তার মাহাত্ম্য হারাল। বন্ধ হয়ে গেল। সমাজের আর সবাইকে নিয়ে চলা বড় গাড়ির দরকার রইল না। সে এখন একা এবং কয়েকজন। 
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ভারতবাসীর ঘরোয়া বিনোদন আগে ছিল সমষ্টিগত তথা পারিবারিক। টেলিভিশনে রামায়ণ, মহাভারত, হামলোগ, বুনিয়াদ, চিত্রমালা, চিত্রহার ইত্যাদি সবই ছিল সকলে একসঙ্গে বসে উপভোগ করার বিনোদন। গোটা পরিবার এবং কখনও পাড়া প্রতিবেশী একই ঘরে একই টিভির সামনে বসেছে। রেডিওর গান, নাটক, সংবাদ সবই ছিল এরকমই সমষ্টিগত বিনোদন। রেকর্ড প্লেয়ার, ক্যাসেট প্লেয়ারও তাই। অর্থাৎ প্রকাশ্যে শোনা যাবে। বাড়ির সদস্যরা যে ঘরেই থাকুক, শোনা যেত সেই গান। বিনোদন ছিল একসঙ্গে উপভোগ করার। আশির দশকে শেষভাগে অত্যন্ত চুপিসারে আর একটি বস্তু ঢুকে পড়েছিল। সেটি হল ওয়াকম্যান। অর্থাৎ গান শুনবো, ক্যাসেট চালাব। কিন্তু অন্য কেউ শুনবে না। আমি একা শুনবো হেডফোন কানে লাগিয়ে। সেই ছিল সূত্রপাত প্রাইভেট অডিয়েন্সে সিস্টেমের। যা আজ নিয়মই হয়ে গিয়েছে। 
আজ এই ২০২১ সালে কী দেখছি আমরা? গোটা বিনোদন জগৎ হয়ে পড়েছে প্রাই঩ভেট। মোবাইলের মাধ্যমে। পারিবারিক তথা সমষ্ঠিগত বিনোদনের কালচারটিও এখন পর্যবসিত হয়েছে ব্যক্তিগত বিনোদনে। আজকাল সকলেই গান শোনে ইয়ার প্লাগ লাগিয়ে। ওয়েব সিরিজ, সিনেমা দেখে একা একা। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝগড়া করে, আনন্দ করে, রাগ প্রকাশ করে মোবাইলে ডুবে থেকে একা একা। সামাজিকভাবে আমরা যেমন প্রাইভেটাইজেশনের দিকে ঝুঁকেছি, ঠিক তেমনই রাষ্ট্র ঝুঁকেছে অন্যরকম প্রাইভেটাইজেশনে। 
বিগত ৪০ বছরের জার্নিতে ভারতের সমাজ সবথেকে দ্রুত, আগ্রাসী এবং অমোঘভাবে যার সাক্ষী হয়েছে, তা হল প্রাইভেটাইজেশন। দু’রকম। প্রথম প্রাইভেটাইজেশনটি হল ব্যক্তিগতকরণ। অর্থাৎ আমরা নাগরিকরা ক্রমেই হয়ে উঠেছি প্রাইভেট। শুধুই নিজে এবং নিজের পরিবারই আমাদের চিন্তাকে আবর্তিত করে। আবার, সরকারি সম্পদ, রাষ্ট্রের দায়িত্ব, রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা সবই ক্রমেই চলে গেল ও যাচ্ছে প্রাইভেট সংস্থার হাতে। অর্থাৎ নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলেও আর কিছু থাকছে না। ক্রমেই সবকিছু হয়ে উঠছে প্রাইভেট। আমরা মনে প্রাইভেট হলাম, রাষ্ট্রও আমাদের ভাগ্য প্রাইভেটের হাতে সমর্পণ করে দিচ্ছে। 
 রাষ্ট্র তার সামাজিক দায়-দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলছে।  নাগরিকের সংসার চলবে কীভাবে? রাষ্ট্র বার্তা দিচ্ছে, সেটা রাষ্ট্রের কোনও ভাবনা নয়। কল্যাণকামী গণতন্ত্রে যা হওয়ার কথা, হচ্ছে কিন্তু ঠিক উল্টো। ক্রমেই সরকারি চাকরি কমে যাচ্ছে। সরকারের হাতে থাকা কোম্পানি বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্র কিন্তু ধরেই নিচ্ছে এবং প্রচারও করছে পরোক্ষে, যে জীবিকা মানেই প্রাইভেট। সে ব্যবসাই হোক বা চাকরি। সরকারের ভূমিকা তেমন নেই। মানুষের জীবিকার প্যাটার্নটিও ক্রমেই দেখা যাচ্ছে প্রাইভেট হয়ে যাচ্ছে। 
আমাদের মোবাইল সিগন্যাল না থাকলে, ডেটা চার্জ বেশি মনে হলে, কল ড্রপ হলে, আমরা সরকারের ঘাড়ে আর দোষ চাপা‌ই না। আমরা বলি এয়ারটেল, জিও, ভোদাফোন, আইডিয়ার সার্ভিস খুব খারাপ। টেলিকম নামক একটি বিপ্লব চলছে দেশজুড়ে। কোটি কোটি ব্যবসা বাণিজ্য, ব্যাঙ্ক, পেমেন্ট, জীবিকা সবই এই টেলিকমের মাধ্যমে হচ্ছে। অথচ রাষ্ট্র তথা সরকারের কোনও দায়বদ্ধতাই নেই। রাষ্ট্র পুরোদমে সরে গিয়েছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর থেকে। সে মাঝেমধ্যে শুধু স্পেকট্র্যাম বিক্রি করে টাকা রোজগার করে। নাগরিকের স্বার্থ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। 
 ঠিক সেভাবেই পেট্রল ডিজেলের দাম বাড়ছে, কিন্তু সরকার বলে থাকে ওটা তো আমাদের হাতে নেই। তেল কোম্পানিগুলি তো স্বশাসিত। ওরাই ঠিক করে দাম। দাম বৃদ্ধি অথবা কমে যাওয়া তো অটো জেনারেটেড! অর্থাৎ সরকার জানিয়ে দিল, তোমাকে মূল্যবৃদ্ধিজনিত সুরাহা দেওয়াটা রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। জিনিসপত্রের দাম প্রবল হয়ে গেলে রাষ্ট্রের উদাসীনতা থেকে বার্তা পাওয়া যায় যে, এটা দেশবাসীর প্রাইভেট সমস্যা। প্রাইভেট সমস্যায় সরকার নাক গলাবে কেন? আমাদের পুত্রকন্যা চাকরি পাচ্ছে না? সরকার মোটেই উদ্বিগ্ন নয়। কারণ, ওটা আমাদের নাগরিকের প্রাইভেট উদ্বেগ। সরকারের কী করার আছে? সরকারি চাকরি কমে যাচ্ছে? রাষ্ট্রের সাফ কথা, প্রাইভেট চাকরি তো আছে! সেখানে চেষ্টা করো ক্ষমতা থাকলে। কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরিতে পেনশন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাহলে কীভাবে আমরা অবসরের পর বাঁচবো? রাষ্ট্র মনে করছে, ওটা তোমার প্রাইভেট প্রবলেম। রাষ্ট্র ভাবতে যাবে না। পেনশন না থাকলে আয়ের উপায় কী? ব্যাঙ্কে টাকা রেখে সুদ পাওয়া। অথচ রাষ্ট্র কি করছে? সেই সুদের হার ক্রমাগত কমিয়ে যাচ্ছে। 
লক্ষ্য করা যাবে, কেন্দ্রীয় সরকার একটি করে প্রকল্প অথবা স্কিম ঘোষণা করে এবং বলে যে, এই প্রকল্পের ফলে ১০ লক্ষ কর্মসংস্থান হবে, ২৫ লক্ষ পরোক্ষ জীবিকা হবে ইত্যাদি। এর মানে কী? মানে হল প্রাইভেট পেশা হবে। আগামী এক বছরের মধ্যে ১০ লক্ষ অথবা ২৫ লক্ষ সরকারি চাকরি দেওয়া হবে, এরকম কোনও সোজাসুজি ঘোষণা আমরা শুনেছি? কখনও শুনিনি। 
সুতরাং, একদিকে আমরা হয়ে যাচ্ছি সামাজিকভাবে প্রাইভেট এনটিটি, আবার অন্যদিকে, রাষ্ট্রব্যবস্থা আমাদের ভালোমন্দ সঁপে দিচ্ছে প্রাইভেট ব্যবস্থার হাতে। প্রাইভেটাইজেশনের বিপদ কী? বিপদ হল, নাগরিক কোনও একটি নালিশ নিয়ে আর সরকারের কাছে যেতে পারবে না। সেই কারণেই সার্ভিস তথা পরিষেবা ব্যাপারটা থেকে রাষ্ট্র নিজেকে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে সূক্ষ্মভাবে। ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণ হচ্ছে।  প্রাইভেট ব্যাঙ্ক হলে সেই ব্যাঙ্কজনিত কোনও সমস্যার দায়ই আর সরকারের থাকবে না। এটাই সরকার চাইছে। প্রাইভেট বিমা হলে কী হবে? সেই বিমা সংস্থা সময়মতো প্রাপ্য টাকা দিল কিংবা দিল না, তার কোনও দায় আর সরকারের থাকবে না।
ফেসবুক কী? একটি আমেরিকান সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানি। এই কোম্পানি সম্প্রতি কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে? ভারতে ক্ষুদ্র বাণিজ্যে তারা লোন দেবে। ইনডিফাই নামক সংস্থার সঙ্গে তারা চুক্তি করেছে। গত বছর ফেসবুক কী করেছিল? জিও মার্ট নামক সংস্থার ১০ শতাংশ শেয়ার কিনে নিয়েছিল। জিও মার্ট কী করে? সব্জি থেকে মুদিখানার দ্রব্য বিক্রি করে অনলাইনে। অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়ার পাশাপাশি ফেসবুক লোন এবং রিটেল বিজনেসে ঢুকে পড়ল ভারতে। আমাজন কী? একটি আমেরিকান ই-কমার্স সংস্থা? এয়ারটেল সংস্থার সঙ্গে তাদের গত বছর কী চুক্তি হয়েছে? ক্লাউড বিজনেস করবে। এসব কী খারাপ? মোটেই না। ভারতের বাণিজ্য বৃত্ত বাড়লে তো আমাদেরই লাভ। কিন্তু রাষ্ট্রের হাতে থাকা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিষেবাগুলি কেন ক্রমেই ঢালাও প্রাইভেট হাতে চলে যাচ্ছে? দৈনিক সব্জি বাজার, মুদিখানা, কৃষিপণ্য, ফুড প্রোডাক্ট কেন বেশি করে চলে যাচ্ছে কর্পোরেটের হাতে? লক্ষ্য কী? 
 ট্রেন, ব্যাঙ্ক, বিমা, সরকারি সংস্থা, হাসপাতাল, টেলিকম, কৃষি, প্রতিরক্ষা, পেট্রলিয়াম..। আগামী দিনে ভারতের নতুন নাম তাহলে কি হবে? ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড? ইয়ারপ্লাগ কানে লাগানো প্রাইভেট বিনোদনে ডুবে থাকা নাগরিকের ভাগ্যকেও রাষ্ট্র কিন্তু সূক্ষ্মভাবে প্রাইভেটের হাতেই তুলে দিচ্ছে!

10th     September,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ