বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

কাকদ্বীপের কান্না কি
গ্লাসগোতে শোনা যাবে?
মৃণালকান্তি দাস

সেদিন শোঁ শোঁ শব্দে উপকূলে আছড়ে পড়েছিল প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়। উমপুনের তাণ্ডবে তছনছ হয়েছিল সুন্দরবন। মাতলার জল ভাসিয়ে দিয়েছিল বহু গ্রাম। কান্না-হাহাকার গ্রামের পর গ্রামে। ঝড়ের তাণ্ডবে উড়ে গিয়েছিল ঘরবাড়ি। নোনা জল গিলে খেয়েছিল মাঠ-ঘাট। উমপুনের তাণ্ডবে ধ্বংসস্তূপের চেহারা নিয়েছিল পূর্ব মেদিনীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাগুলি। সেদিন কয়েক ঘণ্টার ঝড় সুন্দরবনের কথ্য পরিভাষাটা পাল্টে দিয়েছিল। ততদিন ২০০৯ সালের আয়লা ঝড় ছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শেষ মাপকাঠি। উমপুন সেই আয়লাকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল। আয়লার তুলনায় প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ বেশি গতিবেগ, আয়লার তুলনায় অনেক বেশিক্ষণের দাপট, এমন মাপের ঝড় সমুদ্র উপকূলে শেষ কবে এসেছে তা জানা নেই।
কোলে বছর দেড়েকের সন্তান নিয়ে মাতলার পাড়ে ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন ছায়রা খাঁ। দূরে জমির দিকে আঙুল তুলে বলেছিলেন, ‘‘ওই ওখানে আমার ঘর ছিল। এখন কেউ দেখে বলবে, ওটা বসত ভিটে?’’ ছায়রার চোখের কোণ ভিজে যাচ্ছিল বার বার। আঁচলের খুঁট দিয়ে মুছে ফের বলেছিলেন, ‘‘এখন নতুন করে ঘর বাঁধার ইচ্ছে থাকলেও সামর্থ্য কই।’ মাতলার ধারে বাড়ি হারিয়েছিলেন জিয়াউল লস্কররাও। তীব্র ঝড়ে প্রতিবারই লণ্ডভণ্ড হয় উপকূলের শ্বাসমূলীয় সুন্দরবন। সহায়সম্বল ও স্বজন হারানো অগণিত মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার আগেই আঘাত হানে নতুন ঝড়ের তাণ্ডব। ঠিক যেমন উমপুনের ক্ষত মেটার আগেই, ‘যশ’-এর আতঙ্কে সিঁটিয়ে গিয়েছিলেন সুন্দরবনের গোবিন্দ, সুনীল, মলিনারা। প্রত্যেকটা ঝড়ের পরেই সুন্দরবনের মানুষ নতুন করে ঘর বাঁধেন। আলোচনা শুরু হয়, থিতিয়েও যায়। যশ, উমপুনের পরেও আলোচনা চলে— ঘর ভাঙা আর ঘর বাঁধার এই চক্রের থেকে মুক্তির পথ কোথায়?
তবে সুন্দরবনের এই ভগ্নস্বাস্থ্যের পিছনে স্বাধীন ভারতের শাসকেরও অবদান যথেষ্ট। মাতলা পলিতে ঢাকা পড়েছে, বিদ্যাধরীকে আজ নদী বলে চেনাই যায় না। বাইপাসের ধারের খাল-বিল বুজিয়ে যে আকাশচুম্বী বহুতল তৈরি হচ্ছে, তার সঙ্গে কি সুন্দরবনের স্বাস্থ্যের সম্পর্ক নেই? সুন্দরবনকে মেরে ফেলার কলঙ্ক আমাদের উপরেও বর্তায়। সুন্দরবনকে রক্ষা করার দায় শুধু সেখানকার গরিব মানুষগুলোর নয়। শুধু উমপুনেই কত লক্ষ ঘর ভেঙেছে ইয়ত্তা নেই। দুই ২৪ পরগনা মিলে প্রায় ৯০ কিলোমিটার নদীবাঁধ হয় ধুয়েমুছে গিয়েছিল, নয়তো সাংঘাতিক ক্ষতিগ্রস্ত। পশ্চিম সুন্দরবনের যে অঞ্চলটা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত—সাগর, পাথরপ্রতিমা, নামখানা ও কাকদ্বীপ, সেই অঞ্চল তার কিছুদিন আগেই সাংঘাতিকভাবে ধাক্কা খেয়েছিল। সাইক্লোন বুলবুল ১৫৫ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বছর পার হলেও শুকোয়নি ক্ষত। করোনার ভয়কে সঙ্গী করে লক্ষাধিক মানুষ ত্রাণ শিবিরে। একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ে ঘরহারা, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে কি স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব?
রাষ্ট্রসঙ্ঘ আগামী দিনগুলিতে আরও ভয়ঙ্কর গল্প শুনিয়ে রেখেছে। সম্প্রতি বিশ্বের জলবায়ু বিপন্ন মানুষের দুর্ভোগ-দুর্দশার অভিজ্ঞতার চিত্র উঠে এসেছে ৬৬টি দেশের ১৩৪ জন বিজ্ঞানীর তৈরি করা রাষ্ট্রসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা, ইন্টার-গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে। আইপিসিসির প্রতিবেদনটি বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের ১১টি দেশে আগামী দিনে বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার ঘটনা বাড়বে। প্রতিবেদনটি সতর্ক করে দিয়ে বলছে, পরিস্থিতি এখন ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাই এমন সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে, যা গত দু’হাজার বছরেও বিশ্ববাসী দেখেনি।
প্রতি মরশুমেই ভেল্কি দেখাচ্ছে আবহাওয়া! কোথাও সাগরে একের পর এক ঘূর্ণিঝড় তৈরি হচ্ছে। কোথাও আবার আচমকাই হাজির তুষারঝড়। পারদ এক ধাক্কায় নেমে যাচ্ছে শূন্যের অনেকটা নীচে! রাষ্ট্রসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সংস্থা বলছে, এই ভেল্কি কিছুই নয়। আরও অনেক ভেল্কি দেখাবে আবহাওয়া। এবং এর পিছনে দায়ী মানুষেরই তৈরি দূষণ। পরিবেশবিদরা বলছেন, বিন্দু বিন্দু জলে যেমন সিন্ধু হয়, তেমনই দূষণের ফলে বিন্দু বিন্দু কার্বন-ডাই অক্সাইড জমে জমে বাতাসেও কার্বন-সিন্ধু তৈরি হয়েছে। শিল্প, কল-কারখানা রোজ বাতাসে যোগ করে লক্ষ কোটি বিন্দু কার্বন ডাই অক্সাইড। তার জেরেই বাড়ছে বিশ্বের গড় উষ্ণতা। খামখেয়ালি হয়ে পড়ছে আবহাওয়া। বঙ্গোপসাগরের গড় উষ্ণতা বাড়ায় যখন ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছে, তখন শীতে লাগাতার ঝড়ের দাপট সয়েছে ব্রিটেনও। আমেরিকার একাংশে তুষারপাত সাইবেরিয়াকেও হার মানিয়েছে! আমেরিকা ও কানাডার বিভিন্ন অংশে তীব্র দাবদাহ হচ্ছে, এমনকী তাপমাত্রা উঠছে ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপর। ভয়াবহ বন্যায় পশ্চিম ইউরোপে প্রায় ২০০ জন মারা গিয়েছেন, নিখোঁজ কয়েকশো মানুষ। মস্কো ইতিহাসের দ্বিতীয় উষ্ণতম জুন পার করেছে। বস্তুত চরম আবহাওয়া পরিস্থিতি দেখে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরাও। এর জন্য উষ্ণায়নকেই দায়ী করেছেন পরিবেশবিদরা। পরিবেশবিদরা বলছেন, ভেল্কির চরিত্র আরও মারাত্মক হবে ভবিষ্যতে। উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ফসল উৎপাদন মার খাবে। অতিবৃষ্টিতে দেখা দেবে বন্যা। প্রাণহানির ঘটনাও বাড়বে। প্রভাব পড়বে বাস্তুতন্ত্রে। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সংস্থা তো কবেই স্পষ্ট করে দিয়েছে, ২০৭০ সাল নাগাদ কলকাতা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে জলবায়ুবিপন্ন শহর হতে চলেছে!
শুধু তাই-ই নয়, এই বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রধান কারণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ আগামী চার বছরে পৌঁছবে শীর্ষবিন্দুতে। তার ফলে, আগামী দশকের মাঝামাঝি সময়ে কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনের সবক’টি কেন্দ্রই বন্ধ করে দিতে হবে গোটা বিশ্বে। ব্যাপক রদবদল ঘটে যাবে পৃথিবীর জলবায়ুর। তার ফলে, মানুষের জীবনযাত্রার ধরন আমূল বদলে যাবে। দেখা যাবে আচরণগত পরিবর্তনও।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের মাত্রা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে আর ৮০ বছরের মধ্যে ঋতুগুলি একেবারেই বদলে যাবে। সবক’টি ঋতুর মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে তীব্র দহন জ্বালায় জ্বালাবে শুধুই গ্রীষ্মকাল। উত্তর গোলার্ধে তা চলবে টানা ৬ মাস। কমে যাবে শীতকালের আয়ু। বছরে তা মেরেকেটে হবে ২ মাসেরও কম। কমবে বসন্ত ও শরৎ কালের মেয়াদও। ২১০০ সালে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা যেমন ভয়ঙ্কর ভাবে বেড়ে যাবে, তেমনই বেড়ে যাবে উত্তর গোলার্ধের শীতের সর্বনিম্ন তাপমাত্রাও। সাম্প্রতিক একটি গবেষণা এই উদ্বেগজনক খবর দিয়েছে। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটার্স’-এ। গবেষকরা জানিয়েছেন ঋতুগুলির মেয়াদ আর তাদের সময় শুধুই যে উত্তর গোলার্ধে বদলাবে তা নয়, বদলে যাবে দক্ষিণ গোলার্ধেও। কোথাও কিছুটা কম পরিমাণে কোথাও বা বেশি।
গবেষণাপত্রটি জানাচ্ছে, আর ৮০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর ক্রান্তীয় (‘ট্রপিক্যাল’) অঞ্চলের দেশগুলির মশা আরও বেশি পরিমাণে মানুষের পক্ষে ক্ষতিকারক ভাইরাস বহন করবে। আর সেই মশককূলের গতিপথ আরও উত্তরমুখী হবে। তারা আরও বেশি পরিমাণে ছড়িয়ে পড়বে উত্তর গোলার্ধের দেশগুলিতে। গ্রীষ্মকালের মেয়াদ ও তীব্রতা অনেক গুণ বেড়ে যাওয়ায় ভাইরাসঘটিত নানা ধরনের সংক্রমণ আরও বেশি পরিমাণে ছড়াবে মশককূল। তাতে কোভিড-১৯-এর চেয়েও বেশি সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে।
আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘নেচার কমিউনিকেশন্স’ জানিয়েছে আরও উদ্বেগজনক খবর। তাদের রিপোর্ট বলছে, গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন কমানো সম্ভব না হলে আর ৮০ বছরের মধ্যে বিভিন্ন মহাসাগর ও সমুদ্রোপকূলবর্তী বিশ্বের অন্তত ৪১ কোটি মানুষ চলে যাবেন জলের তলায়। মহাসাগর ও সমুদ্রের জলস্তর অনেকটা উপরে উঠে আসার ফলে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বেন ইন্দোনেশিয়ার মানুষ। জলের অতলে তলিয়ে যাবে নিরক্ষীয় অঞ্চলের দেশগুলির ৬২ শতাংশ স্থলভাগ। যার জেরে বিপদাপন্ন হয়ে পড়বেন নিরক্ষীয় অঞ্চলের দেশগুলির ৭২ শতাংশ মানুষ। তার মধ্যে শুধু এশিয়ারই ৫৯ শতাংশ মানুষ।
ব্রিটিশ দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’ বলছে, চীন, ভারত, আমেরিকা-সহ ১০ শতাংশ দেশ বিশ্বের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ৩৬ থেকে ৪৫ শতাংশের জন্য দায়ী। তারা একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে ঢুকেও সেই নির্গমনের পরিমাণে লাগাম পরাতে পারেনি। অর্থনীতির এগিয়ে চলার গতি বাড়াতে সব দেশই প্রচুর পরিমাণে কার্বন রয়েছে এমন সব জ্বালানির যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। তাতে পরিবেশ বিষিয়ে উঠছে উত্তরোত্তর। উষ্ণায়নের গতি বাড়ছে। ঢাউস এসইউভি গাড়ির ব্যবহার যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে জ্বালানি থেকে পরিবেশ বিষিয়ে ওঠার সম্ভাবনা। আগামী দশকের মাঝামাঝি সময়ে পৌঁছে সভ্যতাকে বদলে ফেলতে হবে তার জীবনযাপনের ধরনধারণ। খুব ঠান্ডা বা খুব গরম ঘরে থাকার অভ্যাস ছাড়তে হবে। হাঁটা আর সাইকেল চালানোর উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে। কমাতে হবে বিমানযাত্রা। কিন্তু সে কি সম্ভব?
ব্রিটেনের গ্লাসগোতে ১ নভেম্বর শুরু হবে রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। সেখানে আগামী দিনে রাষ্ট্রগুলো কী পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ কমাবে, তা নিয়ে আলোচনা হবে। একই সঙ্গে বিশ্বের নানা প্রান্তের জলবায়ু বিপন্ন মানুষের কষ্ট কমাতে কী করা যায়, তা নিয়েও আলোচনা হবে। কিন্তু গ্লাসগোতে কি কাকদ্বীপ, সাগরের মতো প্রান্তিক এলাকার মানুষের কান্না শোনা যাবে?
তিন বছর আগে অক্সফোর্ডের পদার্থবিদ রেমন্ড পিয়েরেহামবার্ট লিখেছিলেন, ‘এখন আতঙ্কিত হওয়ার সময় এসে গিয়েছে। আমরা ঘোর বিপদে রয়েছি।’

9th     September,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ