ক্যাবচালক ভদ্রলোক কিছুতেই তাঁর নাম বলতে চাইতেন না। প্যাসেঞ্জারদের সবসময় বলতেন পদবিটুকু—বিশ্বাস। ওটাই নাম, ওটাই পদবি। ক্যাবচালক জানতেন, নামটা বললেই অবিশ্বাস, আতঙ্কের ছায়া ঘিরে ধরবে পিছনের সিটে বসে থাকা মানুষগুলোকে। কেউ নেমে যেতে চাইবে। কেউ খারাপ কথা বলবে। আর কেউ বের করবে ছুরি... রিভলভার। তাঁর পুরো নাম মহম্মদ আব্দুল বিশ্বাস। তাঁর চোখের সামনে ভেঙে পড়েছিল বাড়ি দু’টো! টুইন টাওয়ার... শখ করে বলত লোকে। প্লেন এল... মাঝ বরাবর ধাক্কা... আর ধুলোয় মিশে গেল ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। একটামাত্র ঘটনা মুহূর্তে কীভাবে সমাজ বদলে দিতে পারে, দেখেছিলেন তিনি। কী দোষ ছিল তাঁর? শুধু নামটুকু? নাকি দেশ...। সন্দিহান প্যাসেঞ্জার প্রশ্ন ছুড়তেন, ‘কোন দেশে বাড়ি আপনার?’ বাংলাদেশ? ‘সেটা কোথায়?’ চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করতেন অনেকে। এড়িয়ে যেতেন মহম্মদ। কখনও বলতেন, ‘লাতিন আমেরিকা’। মুখের সামনে তখন তাঁর ভাসত খবরের কাগজে, টিভির পর্দায় দেখা একটা ছবি—ওসামা বিন লাদেন।
* * *
হাঁটু মুড়ে বসে কোরান পড়ছেন মোল্লা মহম্মদ ওমর। এই সময় কেউ তাঁকে বিরক্ত করবে না। ওমর ভাবছেন... সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দ্রুত। আমেরিকা একটা এসপার-ওসপার চাইছে। লাদেন আর তাঁর ৩ হাজার সহযোগী জঙ্গিকে মার্কিন সেনার হাতে তুলে দিতে হবে। ওমর জানেন, এটা খুব সহজ কাজ নয়। ৬০০ ইসলাম ধর্মগুরু মিলিতভাবে আর্জি জানিয়েছেন, আমেরিকার কথা শুনতে হবে। না হলে হামলা করবে পশ্চিমী সেনা। বন্ধ হবে যাবতীয় সাহায্য, বাণিজ্যপথ। ছারখার হয়ে যাবে আফগানিস্তান। ঠিক যেমনটা হয়েছিল ঠান্ডা যুদ্ধের পর। সোভিয়েতের মোকাবিলায় মুজাহিদদের টাকা, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ... সবই জুগিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। লক্ষ্য ছিল একটাই, যেভাবে হোক রুখতে হবে সোভিয়েতের ক্ষমতা বিস্তার। পরমাণু শক্তিধর দেশ সোভিয়েত... সরাসরি যুদ্ধে যাওয়া যাবে না। কিন্তু ভেঙে দিতে হবে তাদের কোমর। উপায়? সমান্তরাল সেনা... ছায়াযুদ্ধ। পোশাকি নাম ছিল তাদের ‘পবিত্র বাহিনী’। পাশতুন ছাড়াও সেই সেনায় ছিল পাকিস্তানি, ইরাকি, তাজিক, উইঘুর মুসলিমরা। আর ছিলেন ওসামা বিন লাদেন। সন্ত্রাসের নেতৃত্বে। শুধুই রক্ত, ধ্বংসলীলা, ভেঙে পড়া আইন-শৃঙ্খলা... টানা ১০ বছর। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত টুকরো হয়ে যাওয়ার পরই ‘আশীর্বাদের হাত’ তুলে নিয়েছিল আমেরিকা। তখন শুরু হয়েছিল মার্কিন ছত্রচ্ছায়া থেকে বেরিয়ে আসা ‘যোদ্ধা’দের, সন্ত্রাসবাদীদের অত্যাচার। প্রতিটা আফগান প্রদেশে... ঘরে ঘরে। সোভিয়েতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি চোখ খুইয়েছিলেন ওমর। কান্দাহারের কাছের একটা গ্রাম থেকে উঠে আসা যুবক তিনি... ধর্মগুরুও। ঠিক করলেন, এবার সময় হয়েছে কিছু একটা করার। হাতে তুলে নিতে হবে আফগানিস্তানের শাসন। এভাবে যে চলতে পারে না! তৈরি হল শিক্ষার্থীদের ফৌজ। তালিবান। সাহায্য করবে কে? কেন! পাকিস্তান! কারণ, তাদেরও তো বাঁচতে হবে। আফগান রুট বন্ধ থাকায় বাণিজ্য ধসে পড়ছে। বেনজির ভুট্টো সমর্থন দিলেন তালিবদের। সঙ্গে অর্থ, অস্ত্র। আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠা হল তালিবান শাসন, শরিয়তি আইন। পরাধীন হল ব্যক্তি স্বাধীনতা। স্থাপত্য? সে আবার কী? মুক্তি পেলেন না বামিয়ান বুদ্ধও। নেপথ্যে তখন দীর্ঘতর হচ্ছে ওসামা বিন লাদেনের ছায়া। তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা তালিবান শাসনের মন্ত্রণাকক্ষে ঢুকে পড়েছে। বিদেশি গুপ্তচররা কানাঘুষো করছে, লাদেনই আসলে ওমরের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। এমন একজনকে কি আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়া যায়? সেই ’৯৪ সাল থেকে তালিবান শাসনকে বেগ দিয়ে গিয়েছে নর্দার্ন অ্যালায়েন্স। এই তো সেদিন... ৯ সেপ্টেম্বর খতম হয়েছে আহমেদ শাহ মাসুদ। লোকে বলেছে, লাদেনই নিকেশ করেছে ওঁকে। ওমর মনে মনে হেসেছেন। এবার ওরা দুর্বল হয়েছে। কিন্তু তার দু’দিনের মাথায় এতবড় হামলা মার্কিন হৃদপিণ্ডে! টুইন টাওয়ার, পেন্টাগন... আর একটা প্লেন ক্র্যাশ করেছে ফিলাডেলফিয়ায়। ওটার লক্ষ্য ছিল নাকি ক্যাপিটল হিল বিল্ডিং বা হোয়াইট হাউস। সত্যিই কি লাদেন এর নেপথ্যে? ওমর বিদেশের খোঁজ রাখেন না। রাখার ইচ্ছেও নেই। কিন্তু জানেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লু বুশ যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। আফগানিস্তানের তালিবান শাসককে তাঁর স্পষ্ট বার্তা, ‘লাদেন আর তার সঙ্গী সন্ত্রাসবাদীগুলোকে আমাদের হাতে তুলে দাও। দ্বিতীয় কোনও অপশন নেই। আমার লক্ষ্য এখন একটাই—সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। যে দেশ আমার পাশে থাকবে না, ধরে নেব সন্ত্রাসেই তার সমর্থন।’ কিন্তু না, ওমর কিছুতেই লাদেনকে ওদের সঁপে দিতে পারবেন না। তাতে যদি হামলা আছড়ে পড়ে, মোকাবিলা করব।
* * *
’৮৯ সালের পর একটা কথা আফগানিস্তানে প্রচলিত ছিল, ‘গ্রেট মার্কিন বিশ্বাসঘাতকতা’। গ্রাম-জনপদ নিশ্চিহ্ন, চাষের জমি বলতে কিছুই নেই। ছিল বলতে খুন, বর্বরতা, আর মাদক। লক্ষ লক্ষ মানুষ দেশছাড়া হয়েছিল তখন। সন্ত্রাসের জন্ম আকাশ ফুঁড়ে হয় না। হতে পারে না। মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান, তারপর গোটা বিশ্ব... অগ্নি বলয়ের মতো ঘিরে ধরেছিল সন্ত্রাস। দুই শক্তিধর দেশের লড়াই জন্ম দিয়েছিল এই ঘাতক ফ্র্যাঙ্কেস্টাইনের। যা হানা দিয়েছিল সেই শক্তিধর, সেই জন্মদাতারই বুকে। ৯/১১... ঠিক ২০ বছর আগের একটা তারিখ। যা বদলে দিয়েছিল মানুষের চরিত্র, মনস্তত্ত্ব। মানুষের উপর মানুষের আস্থা সেদিন আছড়ে পড়েছিল মাটিতে। ধর্মের দাঁড়িপাল্লায় শুরু হয়েছিল মনুষ্যত্বের বিচার। ওই একটা তারিখ... যা বদলে দিয়েছে বিশ্ব রাজনীতি। ঠান্ডা যুদ্ধ কিংবা তেলের মধুভাণ্ড দখলের লড়াই নয়, মূল শত্রু তখন সন্ত্রাসবাদ। আর হ্যাঁ, অর্থনীতির মোড়ও ঘুরেছিল ওই তারিখে। ধসে পড়া শেয়ারবাজার, মন্দা, মুখ থুবড়ে পড়া পরিষেবা সেক্টর। একমাত্র কারণ—আতঙ্ক। মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল বাজার থেকে। প্রতিরক্ষায় প্রায় সব উঁচুদরের দেশ বাড়িয়েছিল বাজেট বরাদ্দ। জোয়ার এসেছিল সমরসজ্জায়। কারণ ‘সন্ত্রাস’ নামক এই শত্রু কখন, কোথা থেকে হানা দেবে, কেউ জানে না। প্রস্তুত থাকতে হবে। অস্ত্র চাই তখন সবার। রাষ্ট্রের, জঙ্গির, সাধারণের। বাজারে এল এক নতুন পেশা—অস্ত্র মধ্যস্থতাকারী। সোজা কথায় দালাল। যারা প্রস্তুতকারক সংস্থা বা রাষ্ট্রের দুর্নীতিপ্রবণ অফিসার ও ক্রেতার মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজটা করবে। বদলে মোটা টাকা কমিশন। হেমন্ত লাখানি। ২০০৩ সালে এফবিআই গ্রেপ্তার করেছিল এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত অস্ত্র কারবারিকে। ফোন ট্যাপ করে ধরা পড়েছিল বিরাট এক ষড়যন্ত্র—মাঝ আকাশে মার্কিন বিমান উড়িয়ে দেওয়ার। ৫০টি ‘ইগলা মিসাইল’ বিক্রির কথাবার্তা চালাচ্ছিল লাখানি। রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্র, যা কাঁধে রেখেই রকেট লঞ্চারের মতো ছোড়া যাবে। এর বিশেষত্ব, মাটি থেকে এই মিসাইল সরাসরি আঘাত হানতে পারবে বিমানে। আকাশ-আতঙ্ক যে তখন সব সময়ের সঙ্গী! ডেনভার থেকে ওয়াশিংটনগামী বিমানের পাইলট হাতে গোনা কয়েকজন যাত্রীর উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আপনারা সাহসী। তাই বিমানে চড়েছেন। বিমান আকাশে পৌঁছে যাওয়ার পর কী হবে জানা নেই। সবটাই আমাদের দায়। আমাদের দায়িত্ব। তাই মাঝ আকাশে কেউ যদি দাঁড়িয়ে পড়ে, যদি প্লেন হাইজ্যাক করতে চায়... হাতের কাছে যা পাবেন তার দিকে ছুড়বেন। তাকে কাবু করে ফেলবেন। মনে রাখবেন, সুরক্ষার ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হবে।’ নাশকতার আতঙ্কই যে বিশ বছর আগের সমাজের সবচেয়ে বড় ব্যধি! সে রোগ সারানো যায়নি। লাখানির গ্রেপ্তারের পরও না। আতঙ্ক-ব্যাধি ঢুকে পড়েছে মজ্জায়। অথচ সে নিয়ে ঢালাও প্রচার চালিয়েছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা। সাফল্যের প্রচার। শোনা গিয়েছিল, এই লাখানির সঙ্গে নাকি লাদেনেরও যোগ ছিল। তা অবশ্য প্রমাণ হয়নি। আর আহত হওয়া সত্ত্বেও দায় চেপেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর। সেদিনও... আজও। এবারও ঘটনাস্থল আফগানিস্তান। এবারও ন্যাটো বাহিনীর বিদায় ঘোষণা মাত্রই তালিবানের পুনর্দখল। এবারও ‘বিশ্বাসঘাতক’ আমেরিকা। সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি।
* * *
ছুটছে অগুনতি মানুষ। কোলে একরত্তি শিশুকে নিয়ে ছুটছে মা... হাঁটার ক্ষমতা নেই, তাও বৃদ্ধ উঠতে চাইছেন বিমানে। দেশ ছাড়তে হবে। নিরুপায় মা পাঁচিলের ওপার থেকে সন্তানকে তুলে দিচ্ছেন সেনার হাতে... ও অন্তত বাঁচুক। জীবনের মূল্য এখন তালিবানি বন্দুকের নলে। পাকিস্তানি সেনা মদত দিচ্ছে... আসছে অস্ত্র। উল্লসিত আল কায়েদা, লস্কর, জয়েশ। তালিবানি শাসনে আফগানিস্তান আবার হয়ে উঠবে সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর। এবার লক্ষ্য হবে একটাই—কাশ্মীর। সন্ত্রাসের বিষে কোণঠাসা হচ্ছে ভারত। এরপর ছড়িয়ে পড়বে তা দেশে দেশে...। খুঁজতে হবে সেই যুবতীকে। তিনি এখন প্রৌঢ়া। হাতের ট্যাটু তাঁর পরিচয়। তাতে লেখা—৯/১১/০১-২:৫৪-২৯। প্রথমটা তারিখ... ১১ সেপ্টেম্বর, তারপর সময়... ২টো ৫৪ মিনিট। আর শেষেরটা? বয়স। ১০ তারিখ ২৯ বছর পূর্ণ করেছিলেন তিনি। ভুলতে পারেননি। ভুলতে চাননি। তাই খোদাই করে রেখেছিলেন হাতে। আতঙ্ক কি আরও একবার ঘিরছে তাঁকে? আবার মাথাচাড়া দেবে ফ্র্যাঙ্ক রকের মতো মানুষ। রেস্তরাঁর শিখ মালিককে গুলি করে খুন করার পর তার মুখে ছিল একটাই কথা—আমি আমেরিকান। খুঁজতে হবে মহম্মদ আব্দুল বিশ্বাসকে। নিউ ইয়র্ক ছেড়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে এসেছিলেন তিনি। বছর চারেক আগের কথা। তখনও পারেননি সেই স্মৃতি ভুলতে। ড্রাইভার সিটে বসে এখনও শিউরে ওঠেন... ঠিক যখন ক্যাবটা পেন্টাগনের পাশ দিয়ে যায়।
সন্ত্রাসের জন্ম দেয় রাষ্ট্র। তাদের স্বার্থ। শুধু অস্ত্রে ছায়াযুদ্ধ হয় না। অর্থ প্রয়োজন... প্রচুর অর্থ। ১৯৮৭ থেকে ’৮৯... আফগানিস্তানে ছিলেন মেজর জেনারেল আলেক্সান্ডার লিয়াকভস্কি। তিনি একটা কথা বলতেন, ‘আফগানিস্তানকে তুমি জয় করতে পারবে না। কিন্তু কিনে নিতে পারবে।’ সেটাই এখন করছে চীন।
এই কি সন্ত্রাসের নতুন শুরুয়াত?